হোর্হে হাইনা: গত ২৬ অক্টোবর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে গাজায় ‘মানবিক বিরতির’ জন্য আনা প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয় বিশ্বের ১২০টি দেশ। বিপরীতে মাত্র ১৪টি দেশ বিপক্ষে ভোট দেয়। কিন্তু এ সংখ্যা শুধু গল্পের অর্ধেকটা। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেওয়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশ ছিল মাত্র চারটি। আর ভোটদানে বিরত থাকা ৪৫টি দেশের মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ১৫টি দেশ এবং যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও জাপানও রয়েছে।বৈশ্বিক দক্ষিণকে আমরা ‘উন্নয়নশীল’, ‘স্বল্পোন্নত’, ‘অনুন্নত’ দেশ বলে বর্ণনা করি। বৈশ্বিক দক্ষিণের জাগরণ বিষয়ে একজন লেখক ও গবেষক হিসেবে আমি বিস্ময়ে দেখেছি যে রাজনৈতিকভাবে বৈশ্বিক উত্তর ও বৈশ্বিক দক্ষিণের মধ্যকার বিভাজনটা বেড়েই চলেছে।ইন্দোনেশিয়া ও তুরস্ক—মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ দুটিই গাজায় ইসরায়েলের বোমাবর্ষণের কড়া সমালোচক। ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং বৈশ্বিক দক্ষিণের অন্য দেশগুলোর সঙ্গে ইন্দোনেশিয়া ও তুরস্ক এই ইস্যুতে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছে। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা দা সিলভা গাজায় ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডকে ‘গণহত্যা’ বলে মন্তব্য করেছেন। ২০২৩ সালের ৬ নভেম্বর দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসাও একই মন্তব্য করেন। ইসরায়েল থেকে দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রদূতকে প্রত্যাহার করে নেন।
গাজা যুদ্ধে আন্তর্জাতিক যে প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে, সেটা বিশ্বরাজনীতির গভীর ও দীর্ঘস্থায়ী একটি প্রবণতার প্রতিফলন। এটা যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত আইনের শাসনভিত্তিক বিশ্বব্যবস্থায় ফাটল। চীনের প্রভাব এবং ইউক্রেন যুদ্ধের বিপর্যয় (দক্ষিণ বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ নিরপেক্ষ অবস্থান নেয়) আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দিচ্ছে। অনেক বিশ্লেষক ব্যাখ্যা করছেন, বহুমেরুকেন্দ্রিক একটি বিশ্বের জন্ম হচ্ছে।২০২৩ সালটি বৈশ্বিক দক্ষিণের উত্থানের বার্তা আরও স্পষ্টভাবে সামনে এসেছে। এর মধ্যে কিছু কাঠামোগত উদ্যোগ আমরা দেখেছি। আগস্ট মাসে জোহানেসবার্গে যে ব্রিকস সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল, সেখানে বৈশ্বিক দক্ষিণের ২১টি দেশ সদস্য হওয়ার আবেদন করে। আর্জেন্টিনা, মিসর, ইথিওপিয়া, ইরান, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত—এই ছয় দেশকে সদস্য করা হয়। ব্রিকস এখন ব্রিকসপ্লাস। ব্রিকসের সদস্যভুক্ত ১১টি দেশ বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৪৬ শতাংশ জনসংখ্যা এবং বিশ্বের মোট দেশজ উৎপাদনের ৩৮ শতাংশের প্রতিনিধিত্ব করে। এর বিপরীতে শিল্পোন্নত দেশগুলোর জোট জি-৭ বিশ্বের জনসংখ্যার ১০ শতাংশের কম এবং বিশ্ব অর্থনীতির ৩০ শতাংশের প্রতিনিধিত্ব করে।৭ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন জি-৭ জোটের সদস্যদেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এই বৈঠকের উদ্দেশ্য ছিল মধ্যপ্রাচ্য সংকট নিয়ে একটা ঐকমত্যে আসা। জাপানে গিয়ে তাঁর আহ্বান ছিল, পশ্চিমা প্রভাবের জি-৭ জোট মধ্যপ্রাচ্য সংকট নিয়ে যেন ‘স্পষ্ট একটি স্বরেই’ কথা বলে। প্রশ্ন হচ্ছে ব্রিকসপ্লাস আরও স্পষ্ট করে বললে, ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালু থাকা বৈশ্বিক দক্ষিণের দেশগুলো কি গাজার ব্যাপারে একই ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে পারবে?ইসরায়েল-হামাস সহিংসতার ঘটনায় যে প্রতিক্রিয়া আমরা দেখতে পাচ্ছি, তাতে করে আমার মনে হয়েছে, বৈশ্বিক দক্ষিণে একই স্বরে কথা বলার সামর্থ্য রয়েছে। যদি একই স্বরে সেটা না বলা যায়, অন্তত সমস্বরে তারা সেটা বলতে পারে। এটা বিসদৃশ হবে না।ঐতিহাসিকভাবেই আফ্রিকা ও এশিয়ার অনেক দেশ ফিলিস্তিনকে সমর্থন দিয়ে আসছে। ইন্দোনেশিয়া তো ইসরায়েলকে রাষ্ট্র হিসেবেই স্বীকৃতি দেয়নি। গাজায় ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর প্রতিক্রিয়া, সত্যিই বিস্ময়কর।বলিভিয়া ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছেদ করেছে। চিলি ও কলম্বিয়া জেরুজালেম থেকে তাদের রাষ্ট্রদূতদের ডেকে এনে সলাপরামর্শ করেছে। কোনো একটি দেশের কর্মকাণ্ডের প্রতি অনাস্থা জানিয়ে কূটনৈতিক অস্ত্রকে ব্যবহার করার দৃষ্টান্ত। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে চেয়ার হিসেবে ব্রাজিল গাজায় যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব পেশ করে। জাতিসংঘে নিযুক্ত মেক্সিকোর স্থায়ী প্রতিনিধি ‘দখলদারি শক্তি’ ইসরায়েলের প্রতি ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড থেকে সরে আসার আহ্বান জানান।প্রশ্নটি হলো বৈশ্বিক দক্ষিণ যদি এই উপায়ে কথা বলে, পশ্চিম কি সেটা শুনবে? জাতিসংঘে পশ্চিমা প্রতিনিধিত্বের যে ভোট ব্যবস্থা, তার ওপর ভিত্তি করে উত্তরটি হবে, না। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে যে কাঠামো এবং সেখানে দক্ষিণ বিশ্বের প্রতিনিধিত্বের অভাবে উন্নয়নশীল বিশ্বে অসন্তোষ বাড়বেই।এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত, হোর্হে হাইনা বোস্টন ইউনিভার্সিটির ফ্রেডরিক এস পারডি সেন্টার ফর লঙ্গার-রেঞ্জ ফিউচারের অন্তর্বর্তীকালীন পরিচালক
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct