কবি কাজী নজরুল ইসলামের বহুল পরিচিত গান ‘কারার ওই লৌহ কপাট’ একটি হিন্দি সিনেমায় ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছিল কবির পরিবারই। তবে এআর রহমানের সংগীত পরিচালনায় যেভাবে গানটি এখন উপস্থাপন করা হয়েছে, তাতে আপত্তি রয়েছে নজরুল পরিবারের। বরং বিতর্ক তৈরি হওয়ার পরে কবি পরিবারের মধ্যে থেকে দাবি উঠেছে, যে চুক্তি অনুযায়ী গানটি সিনেমায় ব্যবহার করা হয়েছে, তা প্রকাশ করা হোক। লিখেছেন অমিতাভ ভট্টশালী।
বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের বহুল পরিচিত গান ‘কারার ওই লৌহ কপাট’ একটি হিন্দি সিনেমায় ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছিল কবির পরিবারই। তবে এআর রহমানের সংগীত পরিচালনায় যেভাবে গানটি এখন উপস্থাপন করা হয়েছে, তাতে আপত্তি রয়েছে নজরুল পরিবারের। বরং বিতর্ক তৈরি হওয়ার পরে কবি পরিবারের মধ্যে থেকে দাবি উঠেছে, যে চুক্তি অনুযায়ী গানটি সিনেমায় ব্যবহার করা হয়েছে, তা প্রকাশ করা হোক।যে হিন্দি ছবিতে গানটি ব্যবহৃত হয়েছে, ‘পিপ্পা’ নামের সেই সিনেমাটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া ভারতীয় সেনাবাহিনীর এক সদস্যকে কেন্দ্র করে সত্য ঘটনা অবলম্বনে তৈরি হয়েছে। সিনেমাটির সংগীত পরিচালনা করেছেন অস্কারজয়ী সংগীত পরিচালক এআর রহমান।কিন্তু কথা ঠিক রাখলেও গানটির আসল সুর বদল করায় এ নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশে বিতর্ক শুরু হয়েছে।কবি নজরুল ইসলামের পরিবারও অভিযোগ করেছে, তাদের কাছ থেকে গান ব্যবহারের অনুমতি নেয়া হলেও যেভাবে সুর বদল করা হয়েছে, সেই অনুমতি তারা দেননি। সম্ভব হলে গানটিতে তারা ওই সিনেমা থেকে বাদ দিয়ে দেয়ারও দাবি করেছেন।প্রসঙ্গত, গানটির কথায় ‘কপাট’ শব্দটি বহুল প্রচলিত হলেও ১৯৪৯ সালে যে প্রথম রেকর্ড বেরিয়েছিল, সেখানে শব্দটি ছিল ‘কবাট’। এক নজরুল গবেষক অবশ্য বলছেন কবি ঠিক কী লিখেছিলেন, তা জানার উপায় নেই, কারণ তার হাতে লেখা কবিতাটি সংরক্ষণ করা নেই।গবেষক অর্ক দেবের কথায়, “২৫ বছর গানটি গণস্মৃতিতে ছিল। সেকারণে কপাট ও কবাট দুটোই রয়েছে। একটা অন্যটার অপভ্রংশ, আর তা ভাষার মান্য ঘটনাই। “যে হিন্দি ছবিতে গানটি ব্যবহৃত হয়েছে, ‘পিপ্পা’ নামের সেই সিনেমাটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া ভারতীয় সেনাবাহিনীর এক সদস্যকে কেন্দ্র করে সত্য ঘটনা অবলম্বনে তৈরি হয়েছে। সিনেমাটির সংগীত পরিচালনা করেছেন অস্কারজয়ী সংগীত পরিচালক এআর রহমান।নজরুল পরিবারের ক্ষোভবহুল প্রচলিত ওই গানটি সিনেমায় ব্যবহারের জন্য ২০২১ সালে প্রযোজনা সংস্থা ও কবির পুত্রবধূ কল্যাণী কাজীর মধ্যে চুক্তি হয়েছিল। বিনিময়ে পরিবার দুই লক্ষ টাকা রয়্যালটিও পেয়েছিল।তবে তার পরিবার বলছে ওই চুক্তি অনুযায়ী কখনই কাজী নজরুলের গানটির সুর ‘বিকৃত’ করার অনুমোদন দেওয়া হয় নি।কবির পুত্রবধূ কল্যাণী কাজী এবছর মে মাসে মারা গেছেন।“ওই চুক্তিতে সাক্ষী হিসাবে আমি ছিলাম, কিন্তু সেখানে কোনভাবেই সুর বা কথা বদলানোর অনুমতি আমার মা দেন নি,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন কবি নজরুলের নাতি ও কল্যাণী কাজীর ছেলে কাজী অনির্বাণ।
কাজী অনির্বাণ বিবিসিকে জানিয়েছিলেন, “বছর দুয়েক আগের ওই চুক্তির কথা আমাদের মাথাতেও ছিল না। ইতিমধ্যে মা মারা যান এ বছরের ১২ই মে। হঠাৎই কয়েকদিন আগে প্রযোজনা সংস্থা থেকে আমাকে গানটির লিঙ্ক পাঠিয়ে শুনে নিতে অনুরোধ করা হয়। আমি তো গানটার উপস্থাপনা শুনে আকাশ থেকে পড়ি, এটা কী করেছেন এআর রহমান!”তিনি বলেন, “মা ভেবেছিলেন এআর রহমানের মতো বিখ্যাত সঙ্গীত পরিচালক গানটা ব্যবহার করলে তা বিশ্বব্যাপী একটা প্রচার পাবে। সেজন্যই বিশ্বাস করে দাদুর গানটা ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছিলেন তিনি। এমন কি এটাও বলেছিলেন মা যে, গানটা তৈরি হওয়ার পরে যেন আমাদের শোনানো হয়। এটা স্পষ্টতই চুক্তি ভঙ্গ।“এই বিতর্ক শুরু হওয়ার পর চুক্তিটি প্রকাশের দাবি তুলেছেন নজরুল পরিবারের আরেকজন সদস্য।কাজী অনির্বোণের বোন, কবি নজরুলের নাতনি অনিন্দিতা কাজী যুক্তরাষ্ট্র থেকে টেলিফোনে বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, “এরকম একটা যে চুক্তি যে হয়েছিল, এআর রহমানের মতো একজন সঙ্গীত পরিচালক দাদুর গান নিয়ে কাজ করবেন, এত বড় খবরটা মা বা দাদারা কেউ আমাকে গত দুবছরে জানালেন না! মায়ের যে ছাত্রীদের সঙ্গে সব কিছু শেয়ার করতেন, তাদেরও মা কিছু জানালেন না! এটাই আমাকে অবাক করছে।“ওই চুক্তিটা প্রকাশ কেন করছেন না আমার দাদা? চুক্তিটা সামনে এলেই তো স্পষ্ট হয়ে যাবে সব কিছু। দাদুর গানের সুর বদল করার বা ‘রিক্রিয়েট’ করার অনুমোদন দেবেন আমার মা, এটা অবিশ্বাস্য,“ বলছিলেন অনিন্দিতা।সুর বদলের প্রতিবাদ করেছেন কাজী নজরুল ইসলামের ঢাকায় বসবাসরত নাতনি খিলখিল কাজীও।তিনি বাংলাদেশের গণমাধ্যমকে বলেছেন, যেভাবে এআর রহমান গানটির সুর বদল করেছেন, তা তিনি মেনে নিতে পারছেন না। একে ‘অপরাধ’ হিসাবে তিনি বর্ণনা করেছেন।‘ইতিহাসের বিকৃতি’কবির পরিবারের সদস্য এবং নজরুল বিশেষজ্ঞরা অস্কার জয়ী সঙ্গীত পরিচালক এআর রহমানের এই কাজকে ইতিহাসের বিকৃতি বলে মনে করছেন।নজরুল পরিবার বলছে, কবির সৃষ্টি বদলিয়ে দেওয়ার অধিকার কারও নেই।কবির আরেক পৌত্র কাজী অরিন্দমের কথায়, “এআর রহমানের মতো একজন সঙ্গীত পরিচালক এরকম একটা গর্হিত কাজ কী করে করলেন, সেটাই বুঝতে পারছি না। শুধু যে ভাবাবেগে আঘাত তা নয়, কারার ওই লৌহ কপাট তো একটা আন্দোলন-সংগ্রাম, যার জন্য আমাদের দাদুকে অনেক মূল্য চোকাতে হয়েছিল, সেই ইতিহাস বিকৃত করে দেওয়া হল।“ভারতের আইন অনুযায়ী, ২০৩৬ সাল পর্যন্ত কাজী নজরুলের সব সাহিত্য কীর্তির কপিরাইট তার পরিবারের হাতে রয়েছে।নজরুল পরিবারের এখন দাবি, সিনেমায় তাদের পরিবারের প্রতি যে বিশেষ কৃতজ্ঞতা জানানো হয়েছে, সেটা যেন টাইটেল থেকে তুলে নেওয়া হয় আর সম্ভব হলে গানটিকেই বাদ দিয়ে দেওয়া হোক সিনেমা থেকে।কিন্তু যদি প্রযোজনা সংস্থা চুক্তি ভঙ্গ করে থাকে, সেক্ষেত্রে তারা আইনী ব্যবস্থা নেবেন কী না, তা স্পষ্ট নয়।কীভাবে সুর দিয়েছেন এআর রহমান?যে গানটি ইউটিউবে আপলোড করা হয়েছে, তার গোড়ায় কিছুটা লোকসঙ্গীতের যন্ত্রানুষঙ্গ রয়েছে, তারপরেই সমবেত কণ্ঠে, অপরিচিত সুরে গাওয়া হয়েছে কারার ওই লৌহ কপাট গানটিকে।সামাজিক মাধ্যমে অনেকেই মন্তব্য করছেন যে গানটির মূল ভাবটাই সম্ভবত ধরতে পারেন নি অস্কার জয়ী সুরকার।
কলকাতার শিল্পী বাবজী সান্যাল বলছেন, “এই গানটি অথবা রবীন্দ্রনাথ – নজরুলের গানগুলোর সঙ্গে তো মানুষের ভাবাবেগ জড়িয়ে আছে। মি. রহমান যেভাবে সুর করেছেন, তার সঙ্গে গানটির ইতিহাস, প্রেক্ষিত এগুলো একেবারেই মেলে না। তিনি গানটিকে আধুনিক করতে চেষ্টা করেছেন, কিন্তু শেষমেশ এই বিখ্যাত গানটির একটি বিকৃত রূপ সামনে এনেছেন।“ নব্বইয়ের দশকে আধুনিক বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করে রবীন্দ্র সংগীত গেয়ে অনেকের বিরোধিতার মুখে পড়েছিলেন ঢাকার জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পী মাকসুদুল হক। তবে তিনিও সুর বদলের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। মাকসুদুল হক বলছেন, “কোনও পরিচিত গানের সুরটা ঠিক রেখে কেউ যদি যন্ত্রানুষঙ্গ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে চায় সেটা করতেই পারে। কিন্তু সেই পরীক্ষা করতে গিয়ে যদি সুরটা ধ্বংস হয়ে যায়, তাতে মানুষের কাছে আপত্তিকর মনে হতেই পারে।“সামাজিক মাধ্যমে তুমুল বিতর্ক সিনেমার গানটি ইউটিউবে আপলোড হতেই এ নিয়ে ভারত আর বাংলাদেশের সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারীরা সঙ্গীত পরিচালক এআর রহমানের তুমুল সমালোচনা শুরু করেছেন ।বেশিরভাগই তাকে দুষছেন বহুল প্রচলিত সুরটি বদলিয়ে ফেলার জন্য। আবার গানটি গেয়েছেন যে বাঙালী শিল্পীরা, তাদেরও দোষারোপ করা হচ্ছে।গায়িকা ফাহমিদা নবী লিখেছেন, ‘’এ আর রহমান নিজেই গুনি সুরকার।নিজের সুরে অন্য কথায় ছবির প্রয়োজনের গান করতেই পারতেন। সঠিক সুরে গানটি ব্যবহার করতে পারতেন।আমাদের জাতীয় কবির প্রতি এই অসম্মানের তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি।’’লেখিকা তামান্না ফেরদৌস সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে লিখেছেন, ‘’এ আর রহমানের সুর করা লৌহ কপাট গানটা শুনে মনে হলো, এই গান এবং এই গানের সাথে জড়িয়ে থাকা বাঙালির আবেগ সম্পর্কে তার কোনো ধারণা নেই কিংবা থাকলেও উনি সেভাবে আমলে নেননি। একজন অস্কার বিজয়ী শিল্পীর কাছ থেকে এই ধরনের উদ্ধতপূর্ণ অপেশাদার আচরন কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না।’’‘’উনার অবশ্যই তার এই অপেশাদার আচরনের জন্য পুরো বাঙালি জাতির কাছে ক্ষমা এবং দুঃখ প্রকাশ করা উচিৎ।’’নজরুল সঙ্গীত শিল্পী ফেরদৌস আরা টেলিভিশন চ্যানেল আইকে দেয়া একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘’নতুনের কাজ নতুন কিছুই হবে, এটি যদি একধরনের ফিউশনও হতো, তাতেও আমার আপত্তি ছিল না। কিন্তু গানটি এতটাই আলাদা, হঠাৎ করে সুর শুনলে বুঝবোই না এটা কোন গান ছিল। আইডেন্টিফিনেশনের যদি সমস্যা হয়ে যায়, তাহলেই প্রশ্ন এসে যায়।...নজরুলের গান নিয়ে তিনি কাজ করে, এর চেয়ে ভালোলাগার কিছু ছিল না। যখন গানটির কথা ঠিক ছিল নজরুলের ভাষায়, সুর হয়ে গেছে আলাদা কিছু, এখানেই যত সমস্যা।’’তবে ভিন্ন মতও দেখা যাচ্ছে একটু খোঁজ করলে। এই অংশটির কারও কাছে এআর রহমানের দেওয়া সুরটি খারাপ লাগে নি, কেউ বলছেন শিল্পীর স্বাধীনতা আছে যে কোনও গান নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা চালানোর।কলকাতার এক ফেসবুক ব্যবহারকারী ও সাংবাদিক জয়ন্ত চৌধুরী যেমন উদাহরণ দিয়েছেন ‘দিনের শেষে ঘুমের দেশে’ রবীন্দ্রসঙ্গীতটির সুর তো দিয়েছিলেন পঙ্কজ কুমার মল্লিক! তিনি লিখেছেন, “অসুবিধা কোথায়? একটা ভালো লেগেছে, একটা লাগেনি। ব্যাস। খারাপ লাগলে শুনবেন না।“নজরুলের লেখা কবিতায় কেউ নতুন করে সুর চাপিয়েছেন, তা নিয়ে এমন মায়াকান্না কেন? কেন ব্যক্তি আক্রমণ? পছন্দ না হলে বলুন। সমালোচনা করুন। পারলে রহমানকে সুর সঙ্গীত ইত্যাদি নিয়ে জ্ঞান ঝাড়ুন। কিন্তু এই হাহাকার, বাঙালির সাংস্কৃতিক রাষ্ট্রবাদ চাগিয়ে ওঠার কারণ কি?
সৌজন্যে: বিবিসি(বাংলা)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct