স্টিফেন ব্রায়েন : ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে সরিয়ে দিতে চাওয়ার ব্যাপারে পশ্চিমাদের (যুক্তরাজ্যের সহযোগিতা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র) মধ্যে ঐকমত্য বাড়ছে।আমার বন্ধু ও সহকর্মী লরি জনসন মনে করেন সিআইএ ও এমআই-৬-এরই মধ্যে জেলেনস্কিকে সরানোর মঞ্চ সাজিয়ে ফেলেছে। হয় জেলেনস্কিকে মার্চ মাসে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন দিতে বাধ্য করা হবে এবং নির্বাচনের মাধ্যমে তাঁকে ক্ষমতা থেকে সরানো হতে পারে। জেলেনস্কি যদি সেটাতে রাজি না হন, তাহলে মায়দান (২০১৪ সালে এই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা হারা রুশপন্থী প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ) ঘরানার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করা হতে পারে।যুক্তরাষ্ট্র এর আগেও ইউক্রেনে নির্বাচিত সরকার বদল করেছিল। যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী ভিক্টোরিয়া ন্যুল্যান্ড সে সময় নেপথ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। ২০১৪ সালে এ বিষয়ে ন্যুল্যান্ড ও কিয়েভে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন রাষ্ট্রদূত জেফরি প্যাটের মধ্যকার ফোনালাপ ফাঁস হয়েছিল। গণমাধ্যমে সেটি প্রকাশিত হয়েছিল।ন্যুল্যান্ড ও প্যাটের ফোনালাপটি ছিল কৌতূহল-উদ্দীপক। কেননা, তাঁরা ইউক্রেনের জন্য একজন গ্রহণযোগ্য প্রেসিডেন্ট প্রার্থী বাছাই করছিলেন। এ জন্য তাঁদের যাঁরা সহযোগিতা করতে পারেন, তার যে তালিকা তাঁরা করেছিলেন, সেখানে তখনকার ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন (বর্তমান প্রেসিডেন্ট) এবং বর্তমান জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভ্যানের নাম ছিল।
মার্কিন কংগ্রেসের রিপাবলিকান দলীয় সদস্যরা কয়েক বছর ধরে ইউক্রেনে বাইডেনপুত্র হান্টারের কর্মকাণ্ড নিয়ে তদন্ত করে আসছেন। তাঁদের এই অভিযোগও (যদিও এর সাপেক্ষে এখনো কোনো প্রমাণ নেই) রয়েছে যে বাইডেন নিজে তাঁর ছেলের ব্যবসা রক্ষায় হস্তক্ষেপ করেছেন।ইউক্রেন যে স্বাধীন দেশ নয়, সেটা বলার যথেষ্ট যৌক্তিক কারণ আছে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে শুধু সেনা সহায়তা দিচ্ছে না, তারা দেশটির সরকারি কর্মকর্তা ও সেনাবাহিনীর সদস্যদের বেতনও জোগাচ্ছে, অবসর ভাতার অর্থও ওয়াশিংটন দিচ্ছে।বাইডেন, সুলিভ্যান ও ন্যুল্যান্ড—সেই তিন আমেরিকান খেলোয়াড়ই আবার ইউক্রেনের ব্যাপারে নতুন করে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, এই তিনজন কেন জেলেনস্কিকে পরিত্যাগ করতে চাইছেন?ওয়াশিংটন এ ব্যাপারে ওয়াকিবহাল যে ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর জন্য তারা যে পাল্টা আক্রমণ অভিযানের পরিকল্পনা করেছিল, সেটা জেলেনস্কি অনুসরণ করেননি। নিজের সেনাপ্রধান ভ্যালেরি জালুঝনি ও আরেক জেনারেল সিরোস্কিকে বিরোধিতা করে জেলেনস্কি তাঁর নিজের খেয়ালখুশিতে বাখমুত শহর পুনর্দখলে সেনা পাঠান। ইউক্রেনের এই শহরটি রাশিয়ার সেনাবাহিনী ও প্রিগোশিনের ভাগনার বাহিনীর হাতে পতন হয়েছিল।রাশিয়ার বিরুদ্ধে বড় পরিসরের যুদ্ধক্ষেত্রে লড়াই করার অর্থ হচ্ছে, ইউক্রেনের সেরা সেনা ইউনিটগুলোকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দেওয়া।এখানেই শেষ নয়, জেলেনস্কিকে সরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে আরও কিছু বিষয় রয়েছে। পাল্টা আক্রমণ অভিযানে ওয়াশিংটনের লক্ষ্য ছিল রাশিয়া যাতে ইউক্রেনের সঙ্গে একটা চুক্তিতে আসতে বাধ্য হয়। তথাকথিত সুরোভিকিন প্রতিরক্ষা রেখা ভেঙে দিয়ে ইউক্রেনীয় বাহিনী ক্রিমিয়ার ওপর হুমকি তৈরি করতে পারে। (যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের অনেক গণমাধ্যমে এই গল্প প্রকাশ হয়েছে, ইউক্রেনীয় বাহিনী সফলভাবে সুরোভিকিন প্রতিরক্ষা রেখা ভেঙে দিয়েছে। কিন্তু এই গল্পগুলো পুরোপুরি প্রোপাগান্ডা।)দক্ষিণ অঞ্চলে ইউক্রেনীয় বাহিনী যখন রাশিয়ার বিরুদ্ধে পাল্টা আক্রমণ অভিযান পরিচালনা করছিল, সে সময় কাকতালীয়ভাবে ইউক্রেনীয় বাহিনী ক্রিমিয়ার সেভাস্তোপল বন্দরে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা করেছিল। একই সঙ্গে রাশিয়ার সঙ্গে ক্রিমিয়ার সংযোগকারী কার্চ সেতুতেও তারা ড্রোন হামলা চালিয়েছে। এই হামলায় সেতুটির কিছুটা ক্ষতি হলেও সেটি পুরোপুরি ধ্বংস করতে ইউক্রেনীয় বাহিনী ব্যর্থ হয়।বিস্তর পরিকল্পনা ও প্রশিক্ষণ শেষে ওয়াশিংটনের পক্ষ থেকে পাল্টা আক্রমণের অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। রাশিয়াতে প্রিগোশিনের নেতৃত্বে ভাগনাররা যে বিদ্রোহ শুরু করেছিল, তার সমান্তরালে পাল্টা আক্রমণ অভিযান শুরু হয়েছিল। এ ব্যাপারে যথেষ্ট তথ্য প্রমাণ আছে যে ইউক্রেনের সামরিক গোয়েন্দাপ্রধান কিরিলো বুদানভের সঙ্গে প্রিগোশিন কথা বলেছিলেন।ইউক্রেনের গোয়েন্দাদের সঙ্গে প্রিগোশিনের সরাসরি কথাবার্তা আফ্রিকায় (সম্ভবত সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক) হয়েছিল। প্রিগোশিন রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণ নিতে পারলে তাৎক্ষণিকভাবে তিনি ইউক্রেনের সঙ্গে একটা চুক্তি করে ফেলতেন। কোন শর্তে তিনি চুক্তি করতেন, সেটা অবশ্য অজানা থেকেই গেছে। এরপরও এমনটা হওয়া অস্বাভাবিক নয় যে বিশেষ সামরিক অভিযান থেকে সরে আসার বিনিময়ে ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার হাতে পুরোপুরি দিয়ে দিতে চেয়েছিল ইউক্রেন। উপরি হিসাবে রাশিয়ার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিতে পারত ওয়াশিংটন।
প্রিগোশিনের অভ্যুত্থান ব্যর্থ হওয়ায় রাশিয়ায় সরকার বদল করার ওয়াশিংটনের স্বপ্নেরও মৃত্যু হয়েছে। ইউক্রেন দাবি করেছে তাদের পাল্টা আক্রমণ অভিযান অচলাবস্থার মধ্যে পড়েছে। এর কারণ হলো তারা পশ্চিমাদের কাছ থেকে ঠিকঠাকমতো অস্ত্র পায়নি। কিন্তু পশ্চিমা অস্ত্রশস্ত্র ও সাঁজোয়া যানে সুসজ্জিত ও প্রশিক্ষিত ইউক্রেনের তিনটি ব্রিগেডও ইতিবাচক ফলাফল অর্জন করতে পারেনি। পশ্চিমা অনেক সমরাস্ত্র যুদ্ধক্ষেত্রেই পুড়ে ছাই হয়েছে। এর মধ্যে অপরাজেয় বলে পরিচিত জার্মানির লিওপার্ড ট্যাংকও রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের এম১ আব্রাহামস ট্যাংক থেকেও লিওপার্ডকে কার্যকর বলে ধরা হয়।জেলেনস্কির আরেকটি সমস্যাও আছে। এ সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসা তাঁর পক্ষে আরও কঠিন। এই সমস্যার কারণে ব্রিটিশ ও আমেরিকান প্রভুদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক খারাপ হয়েছে। সেই সমস্যাটি হলো তাঁর মধ্যে ক্রমাগত এই ধারণা বেড়েছে যে যুদ্ধে ইউক্রেন হারতে চলেছে।এ ব্যাপারে যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য তথ্যপ্রমাণ আছে যে যুদ্ধ চালিয়ে নেওয়ার জন্য ইউক্রেন তাদের ক্ষয়িষ্ণু সেনাবাহিনীতে লোকবল নিয়োগ দিতে কঠোর সব পদক্ষেপ নিয়েছে। ইউক্রেনের এখন বেশির ভাগটাই তৃতীয় সেনাবাহিনী (আগের দুটি সেনাবাহিনী জনবল ও অস্ত্রশস্ত্র খুইয়ে ফেলায় যুদ্ধ করতে অনুপযোগী হয়ে পড়েছে)। যদিও ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর কাছে এখন সুসজ্জিত এবং শীর্ষ মানের কয়েকটি ব্রিগেড রয়েছে। কিন্তু একেবারে অদক্ষ সেনাদের পক্ষে ন্যাটোর অস্ত্রশস্ত্র পরিচালনা করা দুঃস্বপ্ন ছাড়া আর কিছু নয়। বলা চলে, ইউক্রেনীয় বাহিনী একটি বিপর্যয়ের দিকে এগোচ্ছে।ওয়াশিংটনের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে সবচেয়ে ভালো সমাধান হচ্ছে রাশিয়ার সঙ্গে একটি বন্দোবস্তে পৌঁছানো। কিন্তু রাশিয়া এরই মধ্যে জানিয়ে দিয়েছে, বন্দোবস্তের ক্ষেত্রে যুদ্ধবিরতির কোনো প্রস্তাবে তারা রাজি নয়। রাশিয়ার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে এই যুদ্ধ কেবল তখনই শেষ হতে পারে, যদি ইউক্রেন থেকে ন্যাটো পুরোপুরি সরে যায়।কোনো বন্দোবস্ত না হলে ইউক্রেন অনিবার্যভাবে সামরিক দিক থেকে ব্যর্থ হবে। তাতে রাশিয়াকে বাধা দেওয়ার ক্ষেত্রে ন্যাটোর সক্ষমতাও কমবে। কিন্তু জেলেনস্কি রাশিয়ার সঙ্গে যেকোনো বন্দোবস্তের বিরোধী। মার্কিন কংগ্রেসে ইউক্রেনের জন্য আরও ৬০ বিলিয়ন ডলার অনুমোদনের প্রস্তাব উঠেছে। সেটা অনুমোদন করতে কংগ্রেস যদি দেরি করে কিংবা প্রস্তাবিত বাজেটের চেয়ে অনেক কম বরাদ্দ দেয়, তাহলে জেলেনস্কি ব্যাপক চাপে পড়বেন। এ ক্ষেত্রে ওয়াশিংটন মনে করতে পারে তাদের সামনে একটাই বিকল্প আছে। যা-ই হোক, জেলেনস্কি চুপচাপ সরে যাওয়ার পাত্র নন, ফলে মূল সমস্যা হচ্ছে তাঁকে কীভাবে সরানো যাবে। সবচেয়ে ভয়ংকর বিষয় হচ্ছে, মার্চের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন পর্যন্ত দেরি হলে ইউক্রেনকে বাঁচানোর চেষ্টাটিও অনেক দেরি হয়ে যাবে।স্টিফেন ব্রায়েন যুক্তরাষ্ট্র সিনেটের পররাষ্ট্র সম্পর্ক বিষয়ক কমিটির সাবেক সদস্য এবং বর্তমানে সেন্টার ফর সিকিউরিটি পলিসি অ্যান্ড দ্য ইয়র্কটাউন ইনস্টিটিউটের সিনিয়র ফেলো
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct