কেন্দ্রের মসনদে দ্বিতীয়বারের মতো ‘সম্রাটের’ ভূমিকায় নরেন্দ্র মোদি। তার শাসনামলে দেশের মুদ্রাস্ফীতি তলানিতে, বৃদ্ধি পেয়েছে বিদ্বেষের মাত্রা। যদিও নির্বাচনে ডাক দিয়েছিলেন ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ’। বাস্তবে তার যথার্থ প্রতিফলন না ঘটলেও প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসে নিজের ইমেজ তৈরি করতে সিদ্ধহস্ত হয়ে উঠেছেন। তা নিয়ে আলোকপাত করেছেন ড. দিলীপ মজুমদার।
আইটি সেলের শেলবর্ষণ
তাঁর নাম স্বাতী চতুর্বেদী। দিল্লিতে থাকেন। সাংবাদিক। ২০১৬ সালে তিনি লিখলেন একটি বই। নাম ‘আই অ্যাম আ ট্রোল : ইনসাইড দ্য সিক্রেট ওয়ার্ল্ড অব বিজেপি’জ ডিজিটাল আর্মি। ‘ নামটা শুনেই আতঙ্কে রোমাঞ্চিত হতে হয়। বিজেপির ডিজিটাল সৈন্যবাহিনী ! ঠিক তাই। সৈন্যরা যুদ্ধ করে শত্রুর বিরুদ্ধে। নরেন্দ্র মোদি এবং তাঁর সহযোদ্ধাদের শত্রু কে? কেন, বিরোধীরা। এই বিরোধীদের বিরুদ্ধে বিজেপির ডিজিটাল বাহিনীর যুদ্ধ। শুধু বিরোধীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ নয়, দেশের মানুষকে নিজেদের পক্ষে আনারও যুদ্ধ।
চোখ আটকে যাবে বইটির মুখবন্ধে। যেখানে লেখিকা লিখছেন যে তাঁর বিরুদ্ধেও এই প্রচার শুরু হয়েছিল। বিজেপির টুইটার হ্যাণ্ডেল থেকে ক্রমাগত প্রচার হয় যে একজন রাজনীতিবিদের সঙ্গে তাঁর শারীরিক সম্পর্ক আছে।
প্রত্যেকদিন তাঁর ফোনে নোটিফিকেশন আসে : রাতে তাঁর রেট কত, গতকাল তাঁর যৌন সম্পর্ক কেমন ছিল…ইত্যাদি।
তাই বিজেপির আইটি সেলের কাজকর্ম নিয়ে গবেষণা শুরু করেন তিনি। ভয়াবহ ছবি উঠে আসতে থাকে। বিরাট এই দেশে কোটি কোটি সমর্থক ও স্বেচ্ছাসেবীদের কাজে লাগিয়ে ডিজিটাল মাধ্যমে নিজেদের ভাবধারা প্রচার করে যাচ্ছেন নরেন্দ্র মোদি ও তাঁর দল। অনলাইন ট্রোলদের ( যাঁরা মূলত হিন্দু দক্ষিণপন্থী মতাদর্শ ও উগ্র জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী ) সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করেন তাঁরা। স্বাতী লিখেছেন, “এঁরা নিজেদের ডিপি-তে সাধারণত হিন্দু দেবদেবীদের ছবি ব্যবহার করেন। কেউ কেউ আবার বেশি ফলোয়ার টানতে বিকিনি-পরা সুন্দরীদের ছবি দেন ; তাঁদের মূল নিশানা হল লিবারেল রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী অ্যাক্টিভিস্ট ও সাংবাদিকরা---আর তিনি নারী হলে তো কথাই নেই। “
বিজেপির যে আইটি সেলের কথা আমরা বলছি তার পোশাকি নাম হল : ‘ইনফর্মেশন অ্যাণ্ড টেকনোলজি ডিপার্টমেন্ট’। এর প্রধান কর্মকর্তা হলেন অমিত মালভিয়া। ভারতের রাজনৈতিক মানচিত্রে এটাই সবচেয়ে শক্তিশালী ডিজিটাল হাতিয়ার। এই হাতিয়ারের শক্তি ? দুটো উদাহরণ পেশ করছি আমরা।
ক] ২০১৭ সালে। তখন অমিত শাহ বিজেপির সভাপতি। তিনি রাজস্থানের একটি সমাবেশে বলেছিলেন : ”সত্যিই হোক বা ফেক, জেনে রাখবেন যে কোন মেসেজকে আমরা নিমেষে ভাইরাল করার ক্ষমতা রাখি। ”উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনে আমরা তার প্রমাণ পেয়েছি। যে রাজস্থানে অমিত শাহ গর্বের সঙ্গে উপরোক্ত কথাগুলি বলেছিলেন, সেই রাজস্থানে বিজেপি দুটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ চালাত, যার মোট সদস্য সংখ্যা ৩২ লক্ষ। গর্বের সঙ্গে অমিত শাহ বলেছিলেন, “এই ৩২ লক্ষ লোকের কাছে রোজ সকাল আটটায় গুড মর্নিং বার্তার সঙ্গে একটা করে মেসেজ চলে যেত। সেই মেসেজ প্রাপক তাঁর নিজের পরিচিত মহলে ফরোয়ার্ড করে দিতেন।” অমিত শাহ বলেছিলেন আর একটা মেসেজের কথা। যে মেসেজে বলা হয়েছিল অখিলেশ যাদব তাঁর বাবা মুলায়েম সিং যাদবকে থাপ্পড় মেরেছেন। যেদিন থাপ্পড় মারার কথা বলা হচ্ছে সেদিন অখিলেশ ছিলেন বাবার কাছ থেকে ৬০০ মাইল দূরে। কিন্তু মানুষ জেনে গেল এই মিথ্যেটাই। তারা বিরূপ হল অখিলেশের প্রতি।
বিবিসি নিউজ বাংলায় শ্রুভ্রজ্যোতি ঘোষের লেখা ( ‘বিজেপির আইটি সেল কীভাবে এত শক্তিশালী আর বিতর্কিত হয়ে উঠল’ ) জানা যায় শ্রুভ্রকমল দত্তের কথা। ইনি দক্ষিণপন্থী চিন্তাবিদ। বহু দিন ধরে ইনি বিজেপি ঘনিষ্ঠ। শ্রুভ্রকমল বলেছেন যে বিজেপি যে এত আগে থেকে ইন্টারনেটকে রাজনৈতিক প্রচারণার কাজে ব্যবহার করে আসতে পারছে, তার কৃতিত্ব বিজেপির প্রয়াত নেতা ও বাজপেয়ী জমানার তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রী প্রমোদ মহাজনের প্রাপ্য।
শ্রুভ্রকমল বলেন, ”আমার মনে আছে অশোকা রোডে বিজেপির পুরানো দপ্তরে প্রমোদ মহাজনের উদ্যোগেই দলের আইটি উইং খোলা হয়েছিল। ক্যাবিনেট মন্ত্রী ও সরকারের মুখপাত্র হিসেবে হাজার ব্যস্ততার মধ্যেও প্রতিদিন সন্ধের দিকে তিনি নিয়ম করে একবার সেখানে আসতেন।
”বেশ কয়েকজন উচ্চশিক্ষিত তরুণ ও প্রকৌশলী সেখানে যোগ দিয়েছিলেন। বিদেশ থেকে বিজেপির বহু সমর্থকও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। টেকনিক্যাল পরামর্শ দিতেন প্রফেশনালরাও।
”ফেসবুক-ইনস্ট্রা বা হোয়াটসঅ্যাপ তখন ওসব কিছুই আসেনি। অর্কুট নামে একটি প্লাটফর্ম ক্রমশ জনপ্রিয় হচ্ছিল, আর ছিল ইয়াহু ও এম এস এম মেসেঞ্জার। বিজেপি সোশ্যাল মিডিয়ার দুনিয়ায় তাদের যাত্রা শুরু করেছিল এগুলোর হাত ধরেই। ”
শ্রুভ্রকমল মনে করেন, ”ইন্টারনেটই যে রাজনৈতিক প্রচারের ভবিষ্যৎ, এটা বিজেপি ঠিক সময়ে বুঝেছিল এবং সেই অনুযায়ী তাতে প্রচুর শ্রম ও সম্পদ লগ্নি করেছিল বলে পরে তারা সেটা থেকে এত ডিভিডেন্ট পেয়েছে। “
বিজেপি প্রথম ডিজিটাল প্রচার শুরু করে ২০০৪ সালে। অটলবিহারী বাজপেয়ীকে আবার জেতাবার জন্য ডিজিটাল মাধ্যমে শুরু হয় ‘ইণ্ডিয়া শাইনিং’ প্রচার। ২০১০ সাল থেকে বিজেপি অনলাইন ও ডিজিটাল মাধ্যমে ধারাবাহিক প্রচার শুরু করে দেয় গুজরাটের রাজধানী গান্ধীনগর থেকে। তখন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করে বিজেপি। আর তার জন্য প্রয়োজন হয় প্রচার মেশিনারির। সেইজন্য প্রযুক্তিবিদ অরবিন্দ গুপ্তাকে নিযুক্ত করা হয়। অরবিন্দ গুপ্তা স্টার্ট-আপের ধাঁচে প্রচার চালাতে শুরু করেন।
এই সময়ে যে সব ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় সেগুলি হল :
ক] পার্টি অফিসগুলিতে ভিডিয়ো কনফারেন্সিং।
খ] বড় বড় নেতাদের জনসভাগুলি ইউটিউব বা ফেসবুকের মতো ডিজিটাল মাধ্যমে লাইভ সম্প্রচারের ব্যবস্থা।
গ] অনলাইনে মাত্র ৫ টাকা দিয়ে বিজেপির সদস্য তৈরির উদ্যোগ। ২০১০ সালে এই পদ্ধতি চালু হয় এবং মাত্র ২ বছরের মধ্যে ৫ লক্ষ সদস্য সংগ্রহ করা হয়।
ঘ] ডিজিটাল মাধ্যমে ধারাবাহিক প্রচার চালিয়ে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীর গায়ে ‘পাপ্পু’ ছাপ লাগিয়ে দেওয়া।
বিজেপির আইটি সেলের পরবর্তী প্রধান অমিত মালভিয়া ডিজিটাল ক্যাম্পেনকে ৩টি মূল স্ট্র্যাটেজির ভিত্তিতে পরিচালনা করেছিলেন :
ক] একটি সলিড টেকনিক্যাল প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা, যা ওয়ার্কলোড বহন করতে পারবে।
খ] সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে সমর্থক বা বিলিভার এবং স্বেচ্ছাসেবী বা ভলান্টিয়ারদের এক বিপুল বাহিনী তৈরি করা, যাদের ঐক্যবদ্ধ করে ‘স্লোগান ২৭২ প্লাসে’র পক্ষে কাজে উদ্বুদ্ধ করার উদ্যোগ গ্রহন করা।
গ] অনলাইন পেশাদার, ব্র্যাণ্ড অ্যাম্বাসাডার ও তৃণমূল স্তরে ৪০০টি সংসদীয় কেন্দ্রে ছড়িয়ে থাকা প্রায় ২২ লক্ষ ভলান্টিয়ারদের নিয়ে একটি সর্বাত্মক ‘থ্রি সিক্সটি ডিগ্রি ক্যাম্পেন’ চালু করার উদ্যোগ গ্রহণ করা ; এখানে তাঁরা নিজেদেরই ‘টুল’ ব্যবহার করবেন এবং বিজেপির হয়ে ‘ফ্রি কনটেন্ট’ তৈরি করে যাবেন।
শুভ্রজ্যোতি ঘোষ তাঁর রচনার উপসংহারে বলেছেন যে আসলে সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যবহারের যাবতীয় টেকনিক্যাল কৌশল, পেশাদারের যোগদান, লক্ষ লক্ষ স্বেচ্ছাসেবীর সক্রিয়তা, রাজনৈতিক বিচক্ষণতা এবং একটা মতাদর্শগত ন্যারেটিভের সফল বিপণন –এই সব উপাদানই বিজেপির আইটি সেলকে এত প্রভাবশালী ও সেই সঙ্গে এত বিতর্কিত করে তুলেছে।
‘দ্য ইণ্ডিয়ান এক্সপ্রেসে’র সাবেক সিনিয়র সাংবাদিক পামেলা ফিলিপোজ কিছুটা রসিকতা করে বলেছিলেন, ‘ আমি এর অনেকটা কৃতিত্ব দেব অমিত মালভিয়াকে ---কারণ এককালে ফিনান্স সেক্টরে কাজ করার সুবাদে তিনি কোম্পানির ‘মার্জার’ ( সংযুক্তি ) ও ‘অ্যাকুইজিশন’ ( অধিগ্রহণ) গুরুত্বটা ভালো বোঝেন।“
যে বিজেপি বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তারাই আবার নিজেদের প্রয়োজনে ব্যাপকভাবে বিজ্ঞানকে ব্যবহার করে যাচ্ছে। বিজেপির এই দ্বিচারিতা সর্বত্রই।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct