আব্দুর রহমান, আল রাশেদ : বন্ধ হয়নি হামাস-ইসরাইল যুদ্ধ। ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি বেড়েই চলেছে। মুত্যুপুরীতে পরিণত হওয়া গাজার ভয়াবহ পরিস্থিতি কীভাবে ঠান্ডা হবে, তা চিন্তার বিষয়। এই যুদ্ধের পটভূমি ও বর্তমান গতিপথ নিয়ে নানা রকম আলোচনা শোনা যাচ্ছে বিশ্লেষকদের মুখে। যুদ্ধ কীভাবে শেষ হবে, কে প্রথমে সাদা পতাকা হাতে নিয়ে এগিয়ে আসবে এবং কী ও কোন মূল্যের হিসাবের ভিত্তিতে সংঘাতের ইতি ঘটবে—এমন অগণিত প্রশ্ন ক্রমশ জটিল আকার ধারণ করছে।চলমান ইসরাইলি সামরিক হামলা গাজার বেসামরিক নাগরিকদের জীবনকে একেবারে তছনছ করে দিয়েছে। গত ৭ অক্টোবর ইসরাইলের ভূখণ্ডে হামলা চালিয়ে হামাস যে ধ্বংসযজ্ঞের অবতারণা করে, গাজায় ইসরাইলি বাহিনীর আক্রমণ পরিস্থিতিকে এমন পর্যায়ে নিয়ে গেছে, যা কেবল ব্যাপক ধ্বংসস্তূপই বয়ে আনেনি, সৃষ্টি করেছে চরম মানবিক সংকটের। হামাসের হামলার পর ইসরাইল যেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে আসছে, তা এখন আর ‘নিছক ঘটনা’ নেই, বরং রাজনৈতিক বাস্তবতায় তা ক্রমশ জটিল হয়ে উঠছে।হামলার পর ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, ‘এই অঞ্চল আর কখনো আগের মতো হবে না।’ আমরা দেখেছি, নেতানিয়াহুর কথা প্রতিধ্বনিত হয়েছে পশ্চিমা বিশ্বে। গাজা থেকে হামাসকে বিতাড়িত করার মিশনকে পশ্চিমের যেসব দেশ সমর্থন জানিয়ে আসছিল, এ কাজে রসদ জোগাচ্ছিল, তারা নেতানিয়াহুর কথাকে টেনে আরো লম্বা করার কাজে নেমে পড়ে দ্বিগুণ উত্সাহে।এক ভয়াবহ মানবিক সংকট, রক্তক্ষয়ী সামরিক যুদ্ধ এবং এক ভিন্ন রাজনৈতিক বাস্তবতার সামনে দাঁড়িয়ে আছে গাজা তথা ফিলিস্তিন—এতে কোনো সন্দেহ নেই। ইসরাইল তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা অর্জনে সব ধরনের রাস্তায় হাঁটবে—এ কথা যেমন সত্য, তেমনিভাবে এ-ও চরম সত্য, হামাসকে নির্মূল করতে গেলে তথা হামাসকে মাঠের বাইরে রেখে হিসাব করার কথা চিন্তা করলে ফিলিস্তিনের ভাগ্যে কী ঘটবে, তা অজানা।মনে রাখতে হবে, বছরের পর বছর ইসরাইলের অবরোধ ও কঠোর নজরদারি সত্ত্বেও হামাসের হামলা আটকানো যায়নি। এতে প্রমাণিত হয়, হামাসের ভয়ে ইসরাইল এখনো বিপদের প্রহর গুনছে! এই অবস্থায় ইসরাইল-হামাস যুদ্ধের হাত ধরে নতুন কোনো ঘটনা দেখা যাবে কি না, তা-ও বড় প্রশ্ন। যাহোক, পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে মনে হচ্ছে, হামাস-ইসরাইল যুদ্ধে সামনের দিনগুলোতে তিন ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে।প্রথমত, নেতানিয়াহু ও হামাস উভয়ই শত্রুতে পরিণত হতে পারে। সেক্ষেত্রে এই অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠা প্রক্রিয়াকে ব্যর্থ করার দোষ গিয়ে পড়বে উভয়ের কাঁধে।দ্বিতীয়ত, এই যুদ্ধে কোনো পক্ষই বিজয়ী হবে না! হামাস গাজা হারাতে পারে, নেতানিয়াহু হারাতে পারেন গদি। ৭ অক্টোবরের হামলা ঠেকানোর ব্যর্থতার দায়ে নেতানিয়াহু শুধু ইসরাইলি সরকারের নেতৃত্বই হারাবেন না, বরং তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির যে অভিযোগ, তাতে তিনি জেলেও যেতে পারেন।
তৃতীয়ত, যুদ্ধ আরো মারাত্মক পর্যায়ে যেতে পারে! নতুন কোনো সমীকরণ সামনে আসতে পারে। ইয়াসির আরাফাত ও সামরিক সংগঠন ফাতাহর কথা মনে আছে নিশ্চয়? ফাতাহকে লেবানন থেকে বহিষ্কার করার পর আরাফাত কিন্তু ঠিকই ‘রাজনৈতিক কার্ড’ খেলেছিলেন সফলভাবে। অসলো চুক্তি অনুসরণ করে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের (প্যালেস্টাইনিয়ান অথরিটি) নেতা হিসেবে নিজ দেশের মাটিতে ফিরে এসেছিলেন তিনি। ৫০ বছরের ফিলিস্তিন-ইসরাইল সংঘাতের সবচেয়ে খারাপ মানবিক সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে সেই ধরনের ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটলে অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না। সম্ভবত আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে এই যুদ্ধ শেষ হবে। যুদ্ধের ময়দান সুনসান হয়ে পড়বে। ফ্রন্টগুলো নীরব হয়ে যাবে। আর সেই সময় শুরু হবে নতুন রাজনীতি! অনেকে খেয়াল করে থাকবেন, আকাশ থেকে যখন গাজার ওপর ইসরাইলি বাহিনী মুহুর্মুহু বোমাবর্ষণ করছিল, তখন হামাসের রাজনৈতিক নেতা ইসমাইল হানিয়েহর মুখ থেকেও একটা বোমা পড়তে দেখা গেছে। দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধানের ভিত্তিতে শান্তির পথে হাঁটার ক্ষেত্রে হামাসের প্রস্তুতির রূপরেখা ঘোষণা করেছিলেন তিনি। অর্থাত্, দুটি পৃথক রাষ্ট্রের রূপরেখা আঁকার বিষয়ে ‘রাজনীতি’ হবে নিঃসন্দেহে এবং এর ফলে শুরু হবে ‘নতুন লড়াই’! আর সেই লড়াইয়ে ঠিক কী করতে হবে, তা বেশ ভালো করেই জানে হামাস। ইয়াসির আরাফাত ও ফাতাহ ‘লুকিয়ে রাখা রাজনীতি’ কীভাবে মোকাবিলা করেছিলেন, তার দিকে দৃষ্টি দিলেই বিষয়টা পরিষ্কার বোঝা যাবে। বাস্তবতা হলো, মার্কিন সমর্থিত ইসরাইলকে প্রতিহত করার মতো যথেষ্ট শক্তিশালী নয় হামাস। বিশেষ করে মিত্ররা সমর্থন না করলে হামাস অসহায় পরিস্থিতিতে পড়ে যাবে। এই বিবেচনায় হানিয়েহ সম্ভবত চান হামাসের একটা রাজনৈতিক ফ্রন্ট তৈরি হোক, যাতে করে ৭ অক্টোবরের হামলার সুফল পাওয়া যায়। এর জন্য অবশ্য হানিয়েহদের বিদেশে সক্রিয় হওয়াটা অনেক বেশি জরুরি। যদিও এক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হামাসকে সন্ত্রাসী কালো তালিকাভুক্ত করে রেখেছে। তবে এ-ও সত্য, শান্তির স্বার্থে যদি কোনো একটা সময়ে মার্কিন পক্ষ উদ্যোগ গ্রহণ করে, তাহলে তাতে কাজ হতে পারে।আরাফাতকে একসময় যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ বা মার্কিন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল। ১৯৯১ সালে মাদ্রিদে এক শান্তি আলোচনায় তার জায়গায় বিকল্প হিসেবে ডাকা হয় হায়দার আবদেল-শাফি ও হানান আশরাভির মতো নেতাদের। মজার ব্যাপার হলো, তাতে কোনো কাজ হয়নি। অবশেষে আরাফাতের সঙ্গে বসতে বাধ্য হয়েছিল মার্কিনরা। কারণ, তাকে ছাড়া কোনো শান্তি বা আলোচনা সম্ভব ছিল না। এটা ঠিক যে, হামাসের আন্দোলন ফাতাহর মতো নয়। তবে হামাসকে উপেক্ষা করা সম্ভব হবে না কোনোভাবেই। পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের অবস্থান আরো শক্তিশালী হতে পারে আগামী দিনগুলোতে। যদিও রাস্তা ফাঁদে ভরপুর। প্রশ্ন হলো, বেসামরিক নাগরিক ও নিজের যোদ্ধাদের প্রাণহানি ঠেকাতে হামাস কি চুপচাপ সরে যেতে রাজি হবে? সম্ভবত না। আবার নিরস্ত্রীকরণে হামাস রাজি হলেও কোনো আরব রাষ্ট্রই এই আন্দোলনকে ঘিরে থাকা সম্ভাব্য বিপদের ভার বহনে রাজি হবে না। সুতরাং, চলমান দ্বন্দ্ব মেটাতে উভয় পক্ষের আপসের পথে হাঁটা ছাড়া জুতসই কোনো উপায় নেই। এ কাজে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের চেয়ে ভালো পক্ষ আর কেউ হবে না। ঠিক এমনটা ঘটলেই কেবল গাজার অন্ধকার সুড়ঙ্গের শেষে আবার আলো জ্বলবে। রাস্তাটা কঠিন বইকি!
লেখক: জ্যেষ্ঠ কলামিস্ট। আল আরাবিয়া নিউজ চ্যানেলের সাবেক জেনারেল ম্যানেজার ও আশরক আল-আওসাতের সাবেক প্রধান সম্পাদক
আরব নিউজ থেকে অনুবাদ:
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct