সারফুদ্দিন আহমেদ: রিউভেন বলেছিলেন, ‘আমরা জায়নবাদীরা এই বাস্তবতা কি মেনে নিতে পারি? আমরা কি এই বাস্তবতা মেনে নিতে পারি যে, ইসরায়েলের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক (আরব ও ফান্ডামেন্টালিস্ট ইহুদি) নিজেদের জায়নবাদী মনে করে না এবং আমাদের জাতীয় সংগীত গায় না?’২০১৭ সালে ইসরায়েলের হারেৎজ পত্রিকায় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছিলেন, ইসরায়েলকে অবশ্যই অস্তিত্ব বিষয়ক হুমকির কথা মাথায় রেখে এক হয়ে থাকতে হবে। তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের মাথায় রাখতে হবে, ১৪০ বছর ধরে কেনান শাসন করা হাসমোনিয়ান ইহুদিরাও ৮০ বছরের বেশি একতা ধরে রাখতে পারেনি।’চলতি দফায় প্রধানমন্ত্রিত্ব নেওয়ার আগে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছিলেন, ইসরায়েলকে আট দশকের অভিশাপ থেকে মুক্তি দেওয়ার নিশ্চয়তা তাঁর নেতৃত্বাধীন সরকারই দিতে পারে।
আর এর আগের প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেট ২০২০ সালে তাঁর নির্বাচনী প্রচারে বলেছিলেন, একমাত্র তাঁর সরকারই অষ্টম দশকের অভিশাপকে মিথ্যা প্রমাণ করে দিতে পারে। তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের অবশ্যই দেশের ভেতর থেকে ভেঙে না পড়ার দিকে মনোনিবেশ করতে হবে; কারণ ইসরায়েলের মুখোমুখি সবচেয়ে গুরুতর সমস্যা হলো অভ্যন্তরীণ বিচ্ছিন্নতার ঝুঁকি। আমরা সেই বিলুপ্তির ঝুঁকিতে আছি যা ইহুদিদের পূর্ববর্তী রাজ্যগুলোর সঙ্গে ঘটেছিল।’অর্থাৎ এই ‘অষ্টম দশকের অভিশাপ’ নিয়ে যে একটি ধারণা ইহুদিদের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে, সেটি এই নেতাদের কথায় বোঝা যায়।দ্য মিডল ইস্ট মনিটর পত্রিকায় ২০২২ সালের ১২ মে প্রকাশিত একটি কলামে লিগ অব পার্লামেন্টারিয়ানস ফর আল কুদস-এর মহাপরিচালক মোহাম্মাদ মাকরাম বালাবি বলেছেন, ইসরায়েলিদের মধ্যে নানা বিভেদ ইতিমধ্যেই দৃশ্যমান হচ্ছে। হেরেদি সম্প্রদায় ও ধর্মীয় জায়নবাদীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব অনেক গভীর হয়েছে। হেরেদি সম্প্রদায় জায়নবাদীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে থাকেন, তারা তাওরাতের শিক্ষার পরিপন্থী কাজ করে থাকেন এবং তাঁদের জুলুমের কারণেই মুসলমানদের দিক থেকে ইহুদিদের ওপর পাল্টা আঘাত আসে। আর জায়নবাদীরা হেরেদি সম্প্রদায়কে আরবদের তোষণকারী বলে থাকে। এ ইস্যুতে আদর্শগতভাবে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব গভীর হচ্ছে।‘অষ্টম দশকের অভিশাপ’ শুধু যে ইহুদি সমাজে আলোচিত হয় তা নয়, ফিলিস্তিনি ও আরব নেতাদের কথার মধ্যেও সেই শাস্ত্রীয় অভিশাপের উল্লেখ অনেকবার এসেছে। ২৫ বছর আগে হামাসের প্রতিষ্ঠাতা শেখ আহমাদ ইয়াসিন বলেছিলেন, ইসরায়েলের ভেঙে পড়ার সময়কাল শুরু হয়ে গেছে।হামাসের বর্তমান মুখপাত্র আবু উবায়দাও তাঁর সর্বশেষ ঘোষণায় ইহুদিদের উদ্দেশে বলেছেন, ইসরায়েলের সময় শেষ। এই যুদ্ধই চূড়ান্ত যুদ্ধ। অবশ্য ইতিহাসবেত্তাদের অনেকে বলছেন, যেহেতু এর আগের সবগুলো ইহুদি রাজ্য ৮০ বছরের মধ্যে ভেঙে পড়েছে, সে কারণে ভবিষ্যতে যাতে ইহুদিরা নিজেদের মধ্যে হানাহানি করে শেষ না হয়ে যায়; তাঁরা যাতে একতাবদ্ধ থাকে; সে জন্য ধর্মীয় নেতারা এই অভিশাপের কথা বলেছেন।অনেকে বলছেন, ৮০ বছরে তৃতীয় প্রজন্মের উদ্ভব হয়। তাঁরা বলছেন, একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর প্রতিষ্ঠাকালীন প্রজন্ম সাধারণত ঐক্যবদ্ধ থাকে। তাঁদের সন্তানদের মধ্যে, অর্থাৎ দ্বিতীয় প্রজন্মের মধ্যে কিছুটা বিরোধ তৈরি হয়। আর দ্বিতীয় প্রজন্মের সন্তানদের মধ্যে, অর্থাৎ তৃতীয় প্রজন্মের মধ্যে সেই বিরোধ চূড়ান্ত রূপ নেয়। এতে মোটামুটি ৮০ বছর সময় লেগে যায়। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে ইসরায়েলের নাগরিকদের পারস্পরিক মতানৈক্য হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু ২০২৮ সালের মধ্যে ইসরায়েল নামক শক্তিশালী রাষ্ট্রটি অন্তর্কোন্দলে ভেঙে যাবে তা কোনো যুক্তির কথা নয়।তাঁরা এই অভিশাপের ধারণাটিকে ধর্মীয় কুসংস্কার বলে উড়িয়ে দিতে চান। কিন্তু যেহেতু ইসরায়েলের জনগণের মনে এ নিয়ে একটা আতঙ্ক রয়ে গেছে, সেহেতু হামাসের সর্বশেষ এই হামলাকে তাঁদের অনেকে ‘অষ্টম দশকের অভিশাপের’ সঙ্গে মিলিয়ে ফেলছেন। এতে তাঁরা প্রচণ্ড ভয় পাচ্ছেন এবং সে কারণেই হয়তো ইসরায়েল সরকার সাধারণ জনমানসকে আশ্বস্ত করতে দানবের মতো প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে।
সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct