সনাতন পাল: লোকগীত মানেই জীবনের আত্ম কথা আর জীবন যন্ত্রণার ব্যথা সুরের মাধ্যমে আপন ভঙ্গিতে সুরের মাধ্যমে প্রকাশ পাওয়া। প্রাণের ব্যথা আর হৃদয়ের ব্যাকুলতা এবং যন্ত্রণার ছোঁয়ায় জীবনের ভাব বোধের নীল দিগন্তে জীবন গাঁথার পদ চিহ্ন এঁকে যাওয়া। হৃদয়ে প্রস্ফুটিত ব্যথার বকুলের গন্ধ সুরের মাধ্যমে আকাশে বাতাশে ছড়িয়ে যাওয়ার নামই হলো লোকগীতি। আবার প্রেমে কিংবা বিরহে আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে নিজস্ব তাল আর ছন্দ হৃদয়ের গভীরে পুঞ্জিভূত ভাবকে পল্লীগীতিই খুব সহজে স্পর্শ করে। পল্লীগীতির মধ্যে যেমন যন্ত্রণার্ত, ক্ষুধার্ত, তৃষ্ণার্ত মানুষের মন ভবঘুরের মত ঘুরে বেরায়, তেমনি তা থেকে মুক্তি পেতে খাঁচার ভেতরে অচিন পাখিটাও ছটফট করে। তাই তো আমরা করুণ সুরে শুনতে পাই, “ খাঁচার ভেতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়.....।” পল্লীগীতিতে বোধহয় চোখে জল আনা বা হাহুতাশ করানোর চাইতে অনুতাপ ভোগই বেশি করায়। কোনো সঙ্গীত মানব হৃদয়ের আনন্দের চেয়ে যন্ত্রণাকে যদি বেশি স্পর্শ করতে পারে,তাহলে সেই সঙ্গীতই মানুষের হৃদয়ে স্থায়ীত্ব লাভ করবে, এটাই স্বাভাবিক। ‘ রসবোধ,যন্ত্রণা বোধকে হারিয়ে দেয়’- এই প্রবাদের চাইতে ‘ যন্ত্রণা বোধ কম থাকলে তবেই রসবোধের সৃষ্টি হতে পারে’- এই যুক্তিই বোধহয় অধিক শক্তিশালী। আর ভাটিয়ালি, পল্লীগীতি, ভাওয়াইয়া মানব হৃদয়ের যন্ত্রণা বোধকে বেশি ভেদ করে বলেই হয়তো এই সঙ্গীত জন্ম লগ্ন থেকেই মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে। এই জন্যেই হয়তো এই সঙ্গীতের মানুষের মনে দাগ কাটতে কোনো কৃত্রিম ব্যবস্থাপনার দরকার হয় না। ঠিক যেমন বনাঞ্চলে গুল্ম লতাপাতা আপন ইচ্ছায় নিজে থেকেই জন্মায়, আবার আমাদের বিশেষ যত্ন ছাড়া তারা বেড়েও ওঠে।
কিন্তু পল্লীগীতি আমাদের মনে জায়গা করে নেবার ক্ষেত্রে সঙ্গীত শিল্পীদের আপন কন্ঠস্বরের গুণাবলী অবশ্যই বিশেষ কৃতিত্বের দাবী রাখে। তবে গানের কথা এবং সুর দুটোই যেন জীবন আর প্রকৃতির মাঝে থেকেই উঠে আসে। একটা সময়ে মানুষ কখনও জমিতে লাঙল দিতে দিতে, কখনও ধান লাগানোর সময়, আবার কখনও ভাটির গাঙে উজানের দিকে নৌকা নিয়ে যেতে বৈঠা চালানোর সময় আপন তালে, নিজস্ব ছন্দে ভাওয়াইয়া,পল্লীগীতি, ভাটিয়ালি গান গাইতেন। বর্তমান সময়ে আদল পাল্টালেও এমনটা এখনও দেখা যায়। আধুনিক ভাবধারায় সঙ্গীত জগতে মহা আলোড়নের পল্লীগীতির অবস্থান খানিকটা বদল ঘটলেও মূল আঙ্গিককে আশ্রয় করে আধুনিক যন্ত্রপাতি সহযোগে একটা আলাদা মাত্রা পেয়েছে। যার সাথে একাত্ম হয়েছেন শহুরে বাবুরা। পল্লীগীতি গ্রামবাংলার সেকেলে গান হলেও বর্তমান প্রজন্মের অনেক শিল্পী পল্লীগীতিকে আধুনিক ভাবধারায় গ্রামবাংলার মেঠো পথ ছাড়িয়ে সবুজ ধান খেতের মাঝের আল পথ বেয়ে শহরের রাজপথে শ্রোতার সামনে হাজির করেছেন। এই পল্লীগীতির প্রাণ পুরুষ তথা ভাওয়াইয়া সম্রাট আব্বাস উদ্দীনের জন্ম হয়েছিল উত্তরবঙ্গের মাটিতে কালজানি নদীর খানিকটা দূরে। নিজের জীবন বোধ থেকে গানের কথা সৃষ্টি করে প্রকৃতির কাছ থেকে সুর নিয়ে আব্বাস উদ্দীন যে ভাওয়াইয়া, পল্লীগীতি শুরু করেছিলেন পরবর্তীকালে তারই হাত ধরে সেই গান কলকাতা গ্রামোফোন কোম্পানির কাছে পৌঁছায়। তারপরে দেশ ভাগের পরে উনি বাংলাদেশে চলে যান। “ কোন বিরহীর নয়নজলে বাদল ঝরে গো “ এটিই ছিল তাঁর জীবনের প্রথম রেকর্ড করা গান। রেকর্ড করেছিল গ্রামোফোন কোম্পানি। এই কাজে তাঁকে সহযোগিতা করেন কাজী নজরুল ইসলাম। তাঁর রেকর্ড করা গানের সংখ্যা কমপক্ষে সাত শো। সঙ্গীতের জগতে তাঁর কোনো ওস্তাদের তালিম ছিল না। নিজের চেষ্টা এবং প্রতিভা বলে সকলের সামনে নিজেকে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছিলেন। পরে অবশ্য তিনি কিছু সময়ের জন্য ওস্তাদ জমিরউদ্দীন খাঁর কাছে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শিখেছিলেন। ভাওয়াইয়া, ক্ষীরোল, চটকা, জারি, সারি, ভাটিয়ালি, মুর্শিদি, বিচ্ছেদি, দেহতত্ত্ব, মর্সিয়া, পালা গানের এই বিখ্যাত গায়ক আব্বাস উদ্দীন আহমেদ ১৯০১ সালের ২৭ শে অক্টোবর জন্ম গ্রহণ করেছিলেন উত্তরবঙ্গের কোচবিহার জেলার তুফানগঞ্জ মহকুমার বলরামপুর গ্রামে। পাহাড়ের পাদদেশ থেকে নেমে আসা ডুয়ার্সের স্যাঁত স্যাঁতে ভূমিতে এমন বনফুল ফুটেছিল, যে ফুল নিজ গুণে সারা দেশে তার নিজস্ব সৌরভ ছড়িয়ে দিয়েছে। এ যে পাঁকে পদ্ম হয়ে ফুটে পল্লীগায়ের মানুষের হৃদয়ের নন্দন কাননে পল্লী সুরের হাত ধরে পাঁপড়ি মেলে ধরা। মেঠো পথ ধরে বেয়ে আসা তার গানের স্পর্শ গ্রাম বাংলার মানুষ পেয়েছেন। অনুন্নত পাড়া গায়ে জন্ম গ্রহণ করা এই মানুষটিই প্রথমে শহুরে বাবুদের মনে পল্লীগীতিকে জনপ্রিয় করে তোলেন।
তিনি শৈশবে বলরামপুর স্কুলে শিক্ষা জীবন শুরু করেছিলেন। ১৯১৯ সালে তুফানগঞ্জ কলেজ থেকে প্রবেশিকা এবং ১৯২১ সালে কোচবিহার কলেজ থেকে আই এ পাশ করেন। এখানে বি এ পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ হয়ে তিনি সঙ্গীত জগতে প্রবেশ করেন। পথাগত শিক্ষায় ফেল করলেও তিনি সঙ্গীত জগতে ফেল করেননি। তিনি প্রথমে ছিলেন পল্লীগায়ের একজন গায়ক। যাত্রা, থিয়েটার ও স্কুল-কলেজের সংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গান শুনে তিনি গানের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন এবং নিজ চেষ্টায় গান গাওয়া রপ্ত করেন। রংপুর ও কোচবিহার অঞ্চলের ভাওয়াইয়া, ক্ষীরোল, চটকা গেয়ে আব্বাস উদ্দীন প্রথমে সুনাম অর্জন করেন। তারপর জারি, সারি, ভাটিয়ালি, মুর্শিদি, বিচ্ছেদি, দেহতত্ত্ব, মর্সিয়া, পালা গান ইত্যাদি গান গেয়ে জনপ্রিয় হন। তিনি তার দরদভরা সুরেলা কণ্ঠে পল্লী গানের সুর যেভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তা আজও অদ্বিতীয়। গানের কথা আর সুর তার কন্ঠগুণে স্বরের টান এবং কখনও গলাকে ভাঙিয়ে মনের ব্যথাকে এমন ভাবে তুলে ধরতেন যে শ্রোতা তখন নিজের মনের তৃপ্তি এবং শান্তির জন্য তাঁর সেই গানকে কখনও স্বর্ণলতার মত জড়িয়ে ধরেন আবার কখনও গানের সুরেই বটবৃক্ষের ছায়ায় বোধহয় একটু আঁচল বিছিয়ে মনকে জিরিয়ে নেন। তিনি কাজী নজরুল ইসলাম, জসীম উদ্দীন, গোলাম মোস্তফা প্রমুখের ইসলামি ভাবধারায় রচিত গানেও কণ্ঠ দিয়েছেন। শহুরে জীবনে লোকগীতিকে জনপ্রিয় করার কৃতিত্ব আব্বাস উদ্দিনের, একথা কারো অস্বীকার করার উপায় নেই। আবার তিনি বাংলার মুসলমান সমাজকে উদীপ্ত করেছিলেন ইসলামি গান গেয়ে। পল্লীগীতির সংগ্রাহক কানাইলাল শীলের কাছে তিনি কৃতজ্ঞ ছিলেন। আব্বাস উদ্দিন ছিলেন প্রথম মুসলমান গায়ক, যিনি আসল নাম ব্যবহার করে এইচ এম ভি থেকে গানের রেকর্ড বের করতেন। রেকর্ডগুলো বাণিজ্যিকভাবে সফল ছিল। তাই অন্যান্য হিন্দু ধর্মের গায়করা মুসলমান ছদ্মনাম ধারণ করে গান করতে থাকেন। আব্বাস উদ্দীন ১৯৩১ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত কলকাতায় বসবাস করেন। প্রথমে তিনি রাইটার্স বিল্ডিংয়ে ডিপিআই অফিসে অস্থায়ী পদে এবং পরে কৃষি দপ্তরে স্থায়ী পদে কেরানির চাকরি করেন। এ কে ফজলুল হকের মন্ত্রীত্বের সময় তিনি রেকর্ডিং এক্সপার্ট হিসেবে সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করেন। চল্লিশের দশকে আব্বাস উদ্দিনের গান পাকিস্তান আন্দোলনের পক্ষে মুসলিম জনতার সমর্থন আদায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দেশ বিভাগের পর (১৯৪৭ সালে) ঢাকায় গিয়ে তিনি সরকারের প্রচার দপ্তরে এডিশনাল সং অর্গানাইজার হিসেবে চাকরি করেন। পাকিস্তানের প্রতিনিধি হিসেবে ১৯৫৫ সালে ম্যানিলায় দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় সঙ্গীত সম্মেলন, ১৯৫৬ সালে জার্মানিতে আন্তর্জাতিক লোকসংগীত সম্মেলন এবং ১৯৫৭ সালে রেঙ্গুনে প্রবাসী বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনে তিনি যোগদান করেন। দেশ ভাগের পরে আব্বাসউদ্দীন বাংলাদেশে চলে যাওয়ার ফলে এই কৃতিত্ব বাংলাদেশ নিলেও তাঁর গায়ে লেগে থাকা উত্তরবঙ্গের মাটির গন্ধ কে কোনো মতেই অস্বীকার করার উপায় নেই। আব্বাস উদ্দিন সম্পর্কে ফরহাদ মজহার বলেছেন, “ আব্বাস উদ্দিন কেবল গায়ক ছিলেন না, এই প্রজন্মের গায়করা যদি ভাবেন আব্বাস উদ্দিন শুধু গান গেয়ে এদেশের মানুষের মন জয় করেছেন তাহলে তা মস্ত বড় ভুল হবে। আব্বাস তার সময়কালের আকাঙ্ক্ষা ও সংগ্রামকে তাঁর সুরেলা কন্ঠে ধারণ করেন। সেই কারণেই তাঁর গান জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। গানের কথা এবং সুর ও স্বর শ্রোতার মনকে স্পর্শ না করলে সেই গান কখনই জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারে না। তাঁর সঙ্গে ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম এবং আরো অনেকেই।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct