দশকের পর দশক ধরে ফিলিস্তিনির জনগণ যে আন্দোলন-সংগ্রাম করে আসছে, যে ধরনের ভীতির মধ্যে বসবাস করছে, তা যে কোনো মহাকাব্যকেও হার মানায়। ১৯৪৮ সালের বিপর্যয়কর ঘটনার পর, যখন নিজের বসতবাড়ি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছিল লাখ লাখ ফিলিস্তিনি, তখন বিশ্ববাসী ঠিকই বুঝতে পেরেছিল, ‘নাকবা’ কথার তাত্পর্য কতটা ভয়াবহ হতে পারে! ফিলিস্তিনি জনগণের ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া, স্বদেশ থেকে বিতাড়িত করা—এ সবই ‘নাকবা’ শব্দের বাস্তবতা; অর্থাত্, ফিলিস্তিনবাসীর জন্য ‘নাকবা’র অর্থ হচ্ছে ভূতুড়ে অবস্থার অবতারণা, গাঢ় অন্ধকারে নিজেকে হারিয়ে ফেলা। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় বটে। লিখেছেন ফাওয়াজ তুর্কি।
মাসের হামলার পর ইসরাইলি বাহিনীর পালটা আক্রমণের মুখে মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়ে ওঠা গাজা উপত্যকার চিত্র দেখে আঁতকে উঠবে যে কেউই। সাইকোথেরাপিস্ট কিংবা চিকিত্সকেরা বলে থাকেন, চরম দুর্ভোগ-দুর্দশা নিয়ে চিন্তাভাবনা করার সময় আমাদের মস্তিষ্ক অসাড় হয়ে পড়ে, মাথা কাজ করে না ঠিকঠাকভাবে। গাজা জুড়ে যে অবর্ণনীয় অরাজকতা-অস্থিরতা-বিশৃঙ্খলা চলছে, তা নিয়ে ভাবতে গেলে মাথার অবস্থা কী হবে, ভাবুন একবার! বিশেষজ্ঞরা এ-ও বলে থাকেন, ঘুটঘুটে অন্ধকার পরিস্থিতি মনের গহিনে প্রবেশ করে মস্তিষ্ককে একেবারে অকেজো করে ফেলে; অর্থাত্, গাজার ভয়াবহ পরিস্থিতি সম্পর্কে যারা নিয়মিত খোঁজখবর রাখছেন, তাদের মনের অবস্থা কী, তা না বললেও বুঝতে পারার কথা।গাজা উপত্যকার হাজার হাজার মহিলা ও শিশুর বেদনাবিধুর—আঁতকে ওঠা মুখের চিত্র নিয়ে ভাবতেও কষ্ট হয়। পুরো ফিলিস্তিনির অবস্থা তাহলে কী, বুঝতে পারছেন? যেন ইসরাইলি বিমান হামলায় মারা যাওয়ার অপেক্ষা মাত্র! খাদ্য ও পানির তীব্র সংকটের মুখে অনাহারে ধীরে ধীরে মারা যাওয়ার প্রহর গোনা। কী বীভত্স অবস্থা! চরম সত্য কথা হলো, গাজা তথা ফিলিস্তিনির ভুক্তভোগী জনগণের কষ্ট যত বাড়ে, আমাদের (যেসব ফিলিস্তিনি প্রবাসে আছি) অনুভব-অনুভূতির পারদ ওপরে ওঠে সমান তালে। প্রকৃতপক্ষেই, কষ্ট-আবেগ-অনুভূতি ভুক্তভোগীদের সঙ্গে ভাগ করে নিই আমরা। এরকমটা চলে আসছে বহুকাল ধরে।মাস পেরোতে চলেছে, কিন্তু বন্ধ হয়নি গাজার সংঘাত। যুদ্ধের ময়দান হয়ে উঠেছে রক্তলাল। মৃতের সারি দীর্ঘ হচ্ছে প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্ত। ইতিমধ্যে ৮ হাজার ছাড়িয়েছে নিহতের সংখ্যা। দুঃখজনক সংবাদ হলো, ৩ হাজারের বেশি শিশু নির্বিচারে নিহতের শিকার হয়েছে এই হানাহানিতে। আহত ২০ হাজারের বেশি; অর্থাত্, গাজার পরিস্থিতি কতটা মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছেছে, তা সহজে অনুমেয়। ইসরাইলি বাহিনীর বিমান হামলা না থামলে বেঘোরে মারা পড়বে আরো অনেকে। এই আশঙ্কা আমার মতো অনেকের ঘুম হারাম করে দিচ্ছে।আসলেই, আমাদের অন্তর অন্ধকারে ছেয়ে যাচ্ছে গাজার অবস্থা লক্ষ করে। অনেকেই জানেন, গাজাকে একসময় বলা হতো ‘কারাঞ্চল’—এই অঞ্চলের বাসিন্দাদের কারাবন্দি হিসেবেই দেখা হয় আজও। আজকের গাজা পরিণত হয়েছে মৃত্যুপুরীতে। ইসরাইলি সেনারা যে নারকীয় তাণ্ডব চালিয়েছে ও চালাচ্ছে এই উপত্যকা জুড়ে, তা কেবল চরম ঘৃণ্য কাজই নয়, এ যেন হিংস্রতার চূড়ান্ত পর্যায়।বাস্তবতা হলো, গত চার সপ্তাহ ধরে এই ছোট্ট ভূখণ্ডে ইসরাইলি সেনারা যেভাবে বোমাবর্ষণ করেছে, তাতে করে বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ একে ‘আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে বিতর্কিত সামরিক অভিযান’ হিসেবেই গণ্য করছে। ১৯৪৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে জার্মানির ড্রেসডেন শহরকে যেভাবে বোমা হামলার মাধ্যমে ঝাঁজরা করে দেওয়া হয়েছিল, তার সঙ্গে গাজার ঘটনার পুরো মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। নিঃসন্দেহে এ এক বর্বর কর্মকাণ্ড!দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একদম শেষের দিকে ড্রেসডেনের প্রায় ২৫ হাজার বাসিন্দাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়—হত্যাকাণ্ড সব সময়ই নিন্দনীয়। ঐ ঘটনা ‘যুদ্ধাপরাধ’ হিসেবে লিপিবদ্ধ রয়েছে ইতিহাসের পাতায়। এই বিচারে, গাজার ঘটনাও যুদ্ধাপরাধের শামিল। গাজার নৃশংসতা নিয়ে ইতিমধ্যে বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদের ঢেউ উঠেছে। খোদ ওয়াশিংটন পোস্টের এক পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, ‘বিশ্ব জুড়ে গাজা নিয়ে প্রতিবাদ চলছে। বহু বিক্ষোভকারী রাস্তায় নেমেছে। এই সংখ্যা যে কত, তার সঠিক সংখ্যা জানা না গেলে দেশে দেশে যে লাখ লাখ লোক রাজপথ গরম করছে, তা নিশ্চিত।’
ভালো করে লক্ষ করুন, বিক্ষোভকারীরা যখন গাজার অসহায় মানুষের পক্ষে স্লোগান দিচ্ছে, গাজাবাসীর রক্ত ঝরানোর প্রতিবাদ করছে, অমানবিকতা ও ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে আওয়াজ দিচ্ছে, তখন অবশ্যই তা অন্য মানুষকে গাজা তথা ফিলিস্তিনির পাশে দাঁড়ানোর জন্য অনুপ্রাণিত করছে। এই প্রতিবাদী আন্দোলন ক্রমশ ছড়িয়ে পড়বে আরো বিস্তৃত পরিসরে, সন্দেহ নেই।যদি জানতে চাওয়া হয়, গাজার চলমান পরিস্থিতিতে ফিলিস্তিনির অন্য অঞ্চলের বাসিন্দারা কেমন অনুভব করছে? একজন ফিলিস্তিনি হিসেবে ভালো করেই জানি, ঠিক কেমন লাগছে ফিলিস্তিনিদের! কী আগুন জ্বলছে মানুষের মনে! এক্ষেত্রে একটামাত্র শব্দই উচ্চারণ করতে হয়, ‘নাকবা—চরম বিপর্যয়’।দশকের পর দশক ধরে ফিলিস্তিনির জনগণ যে আন্দোলন-সংগ্রাম করে আসছে, যে ধরনের ভীতির মধ্যে বসবাস করছে, তা যে কোনো মহাকাব্যকেও হার মানায়। ১৯৪৮ সালের বিপর্যয়কর ঘটনার পর, যখন নিজের বসতবাড়ি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছিল লাখ লাখ ফিলিস্তিনি, তখন বিশ্ববাসী ঠিকই বুঝতে পেরেছিল, ‘নাকবা’ কথার তাত্পর্য কতটা ভয়াবহ হতে পারে! ফিলিস্তিনি জনগণের ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া, স্বদেশ থেকে বিতাড়িত করা—এ সবই ‘নাকবা’ শব্দের বাস্তবতা; অর্থাত্, ফিলিস্তিনবাসীর জন্য ‘নাকবা’র অর্থ হচ্ছে ভূতুড়ে অবস্থার অবতারণা, গাঢ় অন্ধকারে নিজেকে হারিয়ে ফেলা। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় বটে।হ্যাঁ, আমরা ফিলিস্তিনিরা এই যুদ্ধকে সত্যিকারের রক্তক্ষয়ী হিসেবেই দেখছি। গাজায় কী চলছে? বোমার শব্দে ভারী হয়ে থাকছে প্রতিটা মুহূর্ত। ভবনগুলো ধসে পড়ছে বোমার আঘাতে। বয়ে যাচ্ছে রক্তের স্রোত। এখানে বাবা হওয়া মানে নিজের সন্তানদের মৃত্যু স্বচক্ষে দেখা! গাজার সন্তান হওয়া মানেই পিতামাতার লাশ কাঁধে নিয়ে চলা। কী দুঃখজনক অবস্থা! এ যেন চিরস্থায়ী ট্র্যাজেডি।ভাবুন তো, গাজা নিয়ে যদি আজ কোনো চিত্রকর্ম আঁকতে বলা হয়, শিল্পীরা কী আঁকবেন? অবশ্যই পিকাসোর গুয়ের্নিকার চিত্র দেখতে পাব আমরা। সন্দেহ নেই, গুয়ের্নিকাই ইতিহাসের সবচেয়ে শক্তিশালী চিত্রকর্ম, যা ভয়াবহতা, দুর্ভোগ ও বিশৃঙ্খলার জীবন্ত সাক্ষ্য বহন করে চলেছে যুগ যুগ ধরে। এটাই ইতিহাসের সবচেয়ে শক্তিশালী চিত্রকর্ম, যা নৃশংসতার জীবন্ত সাক্ষী। গাজার জনগণের সঙ্গে যা ঘটছে, যে ভয়াবহ যুদ্ধ গাজাবাসীর চোখের ঘুম হারাম করে দিয়েছে, তা যদি শিল্পীর তুলির আঁচড়ে ফুটিয়ে তোলা হয়, তা হার মানাবে গুয়ের্নিকার বীভত্স ভয়াবহতাকেও।আমরা যারা প্রবাসী ফিলিস্তিনি আছি, গাজার চিত্র দেখে নিজেদের জিজ্ঞাসা করা উচিত, আমরা তো আরামে, নিরাপদে আছি, কিন্তু গাজার জন্য কতটুকু, কী করছি? মাতৃভূমিতে বাস করার, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কাটানোর বাসনা সবার মতো আমাদেরও আছে। সুতরাং, আমাদের কি বসে থাকা উচিত? ঠান্ডা মাথায় ভাবুন। গাজার মারাত্মক পরিস্থিতি লক্ষ করুন। দেখুন, কী ভয়াবহতা ঘিরে ফেলছে গাজাকে! কী দুর্ভোগ-দুর্দশা গ্রাস করছে! কী বিশৃঙ্খল ভূমিতে পরিণত হয়েছে আমাদের মাতৃভূমি! টিভির পর্দায় আমরা যখন এসব দৃশ্য দেখছি, তখন কি আসলেই বুঝতে পারছি, কী নারকীয় কর্মকাণ্ড চালানো হচ্ছে মৃত্যুপুরী গাজায়? সুতরাং, আমরা প্রবাসী ফিলিস্তিনিরা কেন ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে দুঃখকষ্ট ভাগাভাগি করে নেওয়ার জন্য সেখানে ছুটে যাচ্ছি না, যেতে পারছি না?মনে রাখতে হবে, আমরা এই ভূমির আদি বাসিন্দা। এই ভূমি আমাদের। আমরাই এর প্রকৃত মালিক। সুতরাং, এই পুণ্যভূমিতে যত রক্তই ঝরুক, যত বুলেট-বোমাই পড়ুক, আমরা এই মাটি ছেড়ে যাব না। পুণ্যভূমি কামড়ে পড়ে থাকব শেষ দিন পর্যন্ত। শুরু থেকেই ফিলিস্তিনে বসবাস করে আসছি আমরা এবং যতদিন সূর্যের আলো পড়বে এখানে, ততদিন পর্যন্ত এই মাটি মুখরিত হতে থাকবে আমাদের পদচারণাতেই।
লেখক: বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক। ‘দ্য ডিসইনহেরিটেড :জার্নাল অব আ ফিলিস্তিনি এক্সাইল’ বইয়ের লেখক।
গালফ নিউজ থেকে অনুবাদ
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct