কেন্দ্রের মসনদে দ্বিতীয়বারের মতো ‘সম্রাটের’ ভূমিকায় নরেন্দ্র মোদি। তার শাসনামলে দেশের মুদ্রাস্ফীতি তলানিতে, বৃদ্ধি পেয়েছে বিদ্বেষের মাত্রা। যদিও নির্বাচনে ডাক দিয়েছিলেন ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ’। বাস্তবে তার যথার্থ প্রতিফলন না ঘটলেও প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসে নিজের ইমেজ তৈরি করতে সিদ্ধহস্ত হয়ে উঠেছেন। তা নিয়ে আলোকপাত করেছেন ড. দিলীপ মজুমদার।
আমেরিকার মার্কেট অ্যাসোসিয়েশনের মতে ব্র্যাণ্ড বলতে এমন কোন নাম বা শব্দ বা প্রতীক বা ডিজাইন অথবা অন্য কোন ফিচার বোঝায় যা তার বিক্রেতার অভিনব ব্স্তু; অন্য কোন বিক্রেতার কাছে তা পাওয়া যাবে না। পণ্যের বাজারে ব্র্যাণ্ড প্রতিষ্ঠানকে স্বাতন্ত্র্য দেয়। বোঝা যায় সেই বস্তুটি অন্য কোন প্রতিষ্ঠানে পাওয়া যাবে না।ব্র্যাণ্ডিং পণ্য বা তার উৎপাদনকারীকে মানুষের মধ্যে এক পৃথক পরিচিতি দেয়, ক্রেতার সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের সম্পর্ক তৈরি করে দেয়, প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে পৃথক স্থান দেয়।আমেরিকার মার্কেটিং গুরু ও নানাবিধ গ্রন্থপ্রণেতা ডেভিড আকার ২০১২ সালে তাঁর একটি লেখায় বলেছেন, “ every person has a brand that affects how the person is perceived and whether he or she is liked or respected . This brand, he says, can be actively managed with discipline and consistency over times, or it can be allowed to drift . Modi and his marketing team showed oodles of both once he was anointed the BJP’s prime ministerial candidate .”
নরেন্দ্র মোদি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন তাঁকে ব্র্যাণ্ড তৈরির পরিকল্পনা শুরু হয়। তখন তিনি নিছক এক আঞ্চলিক নেতা। এক আঞ্চলিক নেতাকে জাতীয় নেতা রূপে প্রতিষ্ঠার পথে বাধা ছিল তিনটি :
ক] জাতীয় স্তরে মোদির তেমন পরিচিতি ছিলনা।
খ] প্রথমবার ভোট দিচ্ছে এমন ১৫০ মিলিয়ন ভোটারের সঙ্গে ৬৩ বৎসর বয়স্ক এক প্রৌঢ়ের সংযোগ ঘটানো এবং তাদের পছন্দসই করা।
গ] ২০০২ সালে গুজরাটের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার যে কলঙ্ক মোদির মাথায় লেগে আছে, তাকে মুছে ফেলার আয়োজন করা।
তবে এ সব বাধা সত্বেও মোদির একটা সুবিধা ছিল। গুজরাট মডেলের প্রচার আগে থেকেই করা হচ্ছিল। ঢক্কানিনাদ ছিল গুজরাটের অর্থনৈতিক প্রগতির। তার সঙ্গে যুক্ত হল টাটা মোটর। পশ্চিম বঙ্গে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মুখ্যমন্ত্রীত্বকালে সিঙ্গুরে টাটা মোটর ন্যনো গাড়ি তৈরির কারখানা গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। মমতা ব্যানার্জীর নেতৃত্বে কৃষক আন্দোলন হয় তার বিরুদ্ধে। নরেন্দ্র মোদি টাটাকে গুজরাটে সাদর আহ্বান জানান। এতে শিল্পবন্ধু হিসেবে তাঁর ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়।তাছাড়া আরও একটা ব্যাপার আছে। জাতীয় নেতা হবার ইচ্ছা জয়ললিতা বা নিতীশকুমারেরও ছিল কিন্তু নিজ রাজ্যের বাইরে তাঁরা তাঁদের পরিচিতি তেমন গড়ে তুলতে পারেন নি। কিন্তু মোদি ভিন্ন ভিন্ন রাজ্যে প্রায় ৫০০০ নির্বাচনী প্রচারে ও ৪৭০টি মিছিলে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তরুণ ছাত্র -যুবদের মধ্যেও প্রভাব বিস্তার করেছিলেন তিনি। দিল্লির শ্রীরাম কলেজ অব কমার্সে তাঁর বক্তৃতা প্রসঙ্গত স্মরণীয়।সেই সঙ্গে ছিল নিরবচ্ছিন্ন প্রচারের আয়োজন। মিডিয়ায় প্রচারের কৌশলের ব্যাপারটি তত্ত্বাবধান করছিলেন পীযূষ গোয়েল ও অজয় সিংহ। বিজ্ঞাপনের ব্যাপারে সাহায্য করছিলেন অগিলভি অ্যান্ড ম্যাদারসের পীযূষ পাণ্ডে, ম্যাডিসন ওয়ার্ল্ডের শ্যাম বালসারা, ম্যাককান ওয়ার্ল্ড গ্রুপের প্রসুন যোশি প্রভৃতিরা। সোহো স্কোয়ার নামক বিজ্ঞাপন সংস্থা ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার দিকে লক্ষ্য রাখছিলেন এবং আওয়াজ তুলেছিলেন : ‘অব কি বার / মোদি সরকার।‘ মোদির শৈশবের কাহিনি (বাল নরেন্দ্র ) তুলে ধরে বলা হচ্ছিল তাঁর অসীম সাহসের কথা। সংসারে তাঁর অনাসক্তি, তাঁর ত্যাগ ইত্যাদিরও সাড়ম্বর প্রচার ছিল।২০০২ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কলঙ্কের ব্যাপারে প্রথম দিকে তাঁর সমর্থকরা প্রতিবাদে সো্চ্চার হয়ে উঠেছিলেন। তারপর তাঁরা নতুন পথ নিলেন। সে পথ বিতণ্ডার ব্যাপারে মৌনতার পথ। ২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচন ঘোষিত হবার সঙ্গে সঙ্গে মোদির নির্বাচনী টিম ঝাঁপিয়ে পড়ল প্রচারে ; প্রিন্ট মিডিয়ায়, টেলিভিশনে, রেডিয়োয় তরঙ্গ বয়ে গেল বিজ্ঞাপনের ; টুইটারে, ইউটিউবে চলল লাগাতার প্রচার। বিভিন্ন বয়েসের মানুষের কাছে পৌঁছে গেল মোদির বার্তা। কংগ্রেসি শাসনের নিষ্ক্রিয়তার ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে মানুষের মনে এক বলিষ্ঠ, সাহসী, সৎ নেতার ইমেজ তৈরি করে দিতে পারল মোদির নির্বাচনী টিম। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক পরাঞ্জয় গুহ ঠাকুরতা বলেছেন, “The Congress is not lacking in spending power or ability to get marketing brains to campaign for it . But the biggest push for Modi has come from the overt push and advocacy of corporate leaders . It is truism that marketing cannot sell a bad product . Irrespective of the money you spend on marketing, if what you are selling fails to strike a chord in the minds of a large section of the electorate, all efforts to market Modi would be in vain . “২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক বিশ্লেষক সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘ব্র্যাণ্ড মোদি কি পরীক্ষায় উতরাবে’ নিবন্ধে বলেছেন যে ২০১৯ সাল থেকেই মোদি ব্র্যান্ড হয়ে উঠেছেন। ২০১৯ সালের আগে মোদির মুখে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ, ভারতীয় জনতা পার্টি, অটলবিহারী বাজপেয়ী, লালকৃষ্ণ আদবানির নাম শোনা যেত। ব্র্যাণ্ড হয়ে যাবার পরে মোদির মুখে শুধু শোনা যায় ‘ম্যায়’, মানে ‘আমি’, মানে ‘আমি নরেন্দ্র মোদি’। সৌম্য বলেছেন, উত্তরপ্রদেশ চষে ফেললেও বড় বড় হোর্ডিংএ মোদি ছাড়া অন্য কোন বিজেপি নেতার ছবি চোখে পড়ে নি তাঁর। গুজরাটের গান্ধীনগরের প্রার্থী ছিলেন ভূমিপুত্র অমিত শাহ। তাঁর কিছু ছবি চোখে পড়ে্ছে। কিন্তু তন্ন তন্ন করে খুঁজে অটলবিহারী বাজপেয়ী কিংবা লালকৃষ্ণ আদবানির ছবি দেখা যায় নি। চোখে পড়ে নি দীনদয়াল উপাধ্যায়ের ছবি। ছবি তো দূরের কথা, নির্বাচনী জনসভায় নরেন্দ্র মোদি যে সব ভাষণ দিয়েছেন, সেই সব ভাষণে তাঁর দলের অতীতের দিকপালদের নামও কখনও উচ্চারিত হয় নি। যেন মোদির কাছে তাঁরা ব্রাত্য।এমন ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা বিজেপি দলের কাছে নতুন। দলকে অতিক্রম করে সে দলে এর আগে ব্যক্তি বড় হয়ে ওঠে নি, সে চেষ্টা দেখা যায় নি অতীতে। অটলবিহারী বা আদবানিদের ব্র্যাণ্ড করারও চেষ্টা হয় নি। এতদিন ভারতীয় গণতন্ত্র ব্রিটেনের ‘ওয়েস্টমিনিস্টার মডেল’ অনুসরণ করে চলছিল। নরেন্দ্র মোদি তাকে নতুন রূপ দিলেন। ২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচনকে তিনি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের রূপ দিলেন। স্বাধীনতার পরে এই প্রথম ভারতের নির্বাচন একজন ব্যক্তির পক্ষে বা বিপক্ষে নির্বাচনের রূপ নিল।
এ যেন ‘হাম’ থেকে ‘ম্যায়’-এ রূপান্তর।
‘ইণ্ডিয়া টুডে’ সংবাদ মাধ্যমের ‘ডেটা ইনটেলিজেন্স ইউনিট’ পাঁচ বছর আগের মোদির কথাবার্তা ও ভাষণ পাঁচ বছরের পরের মোদির কথাবার্তা ও ভাষণ পর্যালোচনা করেছে। এর জন্য তারা ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে পাটনা, বারাণসী, দিল্লি, মিরাট, চেন্নাইএর মোদির ৫ টি ভাষণ এবং ২০১৯ সালর নির্বাচনের আগে ভাগলপুর, কেন্দ্রপাড়া, মোরাদাবাদ, পানজি ও বুনিয়াদপুরের মোদির ৫ টি ভাষণের তুলনামূলক পর্যালোচনা করেছে।২০১৪ সালের ৫টি জনসভায় মোদি তাঁর ভাষণে যে শব্দটি সবচেয়ে বেশি উচ্চারণ করেছিলেন তা হল –‘গরিব’। মোট ৫৫ বার এই ‘গরিব’ শব্দ উচ্চারিত হয়েছে। এরপরে ছিল ‘কংগ্রেস’ শব্দ, সেটি ৪৩ বার উচ্চারিত হয়েছে। ;কৃষক’ শব্দটি তিনি ২৮ বার উচ্চারণ করেছেন, উন্নয়ন শব্দটি ২৫ বার, ‘বিদ্যুৎ’ শব্দটি ২১ বার, ‘দারিদ্য; শব্দটি ১৯ বার ; মোদি মোট ২৮ বার গুজরাট মডেলের কথা বলেছেন, দূষণের কারণে গঙ্গানদীর নাম নিয়েছেন ২৩ বার, আর বিজেপি দলের নাম করেছেন ৩১ বার। মনে রাখতে হবে তখনও মোদি তখনও দলকে ছাপিয়ে ব্যক্তি হিসেবে বড় হয়ে ওঠেন নি। এবার ২০১৯ সালের ভাষণের কথা। ২০১৯ সালের ভাষণে মোদি নিজেকে দেশের চৌকিদার হিসেবে তুলে ধরতে চেয়েছেন। তাঁর ৫টি ভাষণে ‘চৌকিদার’শব্দ মোট ১০৬ বার উচ্চারিত হয়েছে। ;গরিব’ শব্দ ৫৫ থেকে কমে হয়েছে ৪১ বার, ‘বিদ্যুৎ’ ২১ থেকে কমে হয়েছে ১২ বার, ‘বিজেপি’ শব্দ ৩১ বার থেকে কমে হয়েছে ২১ বার। পাঁচ বছর আগে যা একবারও শোনা যায় নি, এবার সেই ‘সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসবাদী’ দের কথা শোনা গেল ৩০ বার। ‘মোদি’ শব্দটি তিনি ব্যবহার করলেন ৪২ বার।এই পর্যালোচনা থেকে ব্র্যাণ্ড মোদির অগ্রগমনের চিত্রটা পরিষ্কার হয়ে ওঠে।ব্র্যাণ্ড মোদি ব্র্যাণ্ড মোদি ভক্তেরা ফুকারে।বাজারে বিকাবে ভালো নগদে বা ধারে।।মোদি আদি, মোদি অন্ত্য, মোদি একেশ্বর।তাহার উপরে আছে দেবতার বর।।দেবতার বর নয়, তিনি ভগবান।দেশে দেশে জ্যোতি তার দেখ অনির্বাণ।।চৌকিদার হল শেষে দিব্য বিশ্বগুরু।শুনিয়া কেন যে তোর বুক দুরু দুরু।।গোদি মিডিয়ার কত কারসাজি দেখেছ।দুয়ে দুয়ে চার তুমি নিশ্চয়ই বুঝেছ।।ছাগল কুকুর হয়, প্রচার কৌশল।তার সঙ্গে যুক্ত হয় ছল আর বল।।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct