পশ্চিমবঙ্গের এক সময়ের বিরোধী নেত্রী, বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর নেতৃত্বে ব্যাপক কৃষক বিক্ষোভের ফলে হুগলী জেলার সিঙ্গুরে একটি প্রায়-নির্মিত গাড়ি কারখানা ছেড়ে টাটা গোষ্ঠী চলে যেতে বাধ্য হয়েছিল ২০০৮ সালে। ভারতের বৃহৎ শিল্প গোষ্ঠী টাটা মোটর্সকে এক হাজার কোটি টাকারও বেশি ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে যে নির্দেশ দিয়েছে একটি ট্রাইবুনাল, তা নিয়ে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের কৃষকদের একাংশের মধ্যে। বিবিসির বিশ্লেষণ।
ভারতের বৃহৎ শিল্প গোষ্ঠী টাটা মোটর্সকে এক হাজার কোটি টাকারও বেশি ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে যে নির্দেশ দিয়েছে একটি ট্রাইবুনাল, তা নিয়ে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের কৃষকদের একাংশের মধ্যে।
পশ্চিমবঙ্গের এক সময়ের বিরোধী নেত্রী, বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর নেতৃত্বে ব্যাপক কৃষক বিক্ষোভের ফলে হুগলী জেলার সিঙ্গুরে একটি প্রায়-নির্মিত গাড়ি কারখানা ছেড়ে টাটা গোষ্ঠী চলে যেতে বাধ্য হয়েছিল ২০০৮ সালে।
এত বছর পরে ওই গাড়ি কারখানা গড়তে না পারার জন্য রাজ্য সরকারকে প্রায় ৭৬৬ কোটি টাকা, ট্রাইবুনালে মামলা চালানোর খরচ হিসাবে এক কোটি টাকা ও ২০১৬ সালের পয়লা সেপ্টেম্বর থেকে ১১ শতাংশ হারে সুদ, সব মিলিয়ে প্রায় ১৩৫০ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ দিতে হবে রাজ্য সরকারকে।
কত বড় ধাক্কা মমতা ব্যানার্জীর সরকারের জন্য?
পশ্চিমবঙ্গ অর্থ কমিশনের সদ্য প্রাক্তন চেয়ারম্যান ও অর্থনীতিবিদ অভিরূপ সরকার বলছেন, “টাটারা যে চলে গিয়েছিল, তার কারণ যে আন্দোলন ছিল, সেখানে কিন্তু সাধারণ মানুষের সমর্থন ছিল। তা যদি না থাকত মমতা ব্যানার্জী তার কয়েক বছর পরে বিপুল ভোটে জিতে ক্ষমতায় আসতে পারতেন না।
“এর ফলে যে টাটারা যে শুধু চলে গিয়েছিল, তা তো নয়। এর একটা দীর্ঘমেয়াদী কুফল পড়েছে এখানকার শিল্পায়নের ওপরেই। এখানে নিশ্চিতভাবেই রাজনীতির জয় হয়েছে, মমতা ব্যানার্জীর রাজনীতি জয়ী হয়েছে।’’
‘’উল্টোদিকে সিপিএমও তো রাজনীতি করত। তাদের হাতে তো প্রশাসন ছিল। তারা কেন পরিস্থিতিটা সামলাতে পারল না? তাদের রাজনীতি তো পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। তখনকার সরকার যারা চালাতো দায় তো তাদেরই,” বলছিলেন অভিরূপ সরকার। রাজ্য সরকার বলছে তারা ট্রাইবুনালের রায় খতিয়ে দেখে আদালতে যাবে। তবে ক্ষমতাসীন দল তৃণমূল কংগ্রেস এই বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু না বলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক তৃণমূল কংগ্রেস মুখপাত্র বলছিলেন, “একটা কথা স্পষ্ট, সিঙ্গুরের জমিটা যে অবৈধভাবে নেওয়া হয়েছিল, তা তো সুপ্রিম কোর্ট বলেই দিয়েছে। কোনও নিয়মকানুনের তোয়াক্কা করে নি বামফ্রন্ট সরকার।’’
‘’এখন সর্বশেষ এই ট্রাইবুনালের রায় নিয়ে কী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে, আদালতে যাবে কী না, সেই ব্যাপারে সরকারই যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার তা নেবে, দল কিছু বলবে না এর মধ্যে।“
সিপিআইএম দলের সংসদ সদস্য ও প্রবীণ আইনজীবী বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্যের কথায়, “টাটাদের সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল সরকারি শিল্পোন্নয়ন নিগমের সঙ্গে। বামফ্রন্ট সরকার পরিবর্তনের পরেও তো রাজ্য সরকারের উচিত ছিল সেই চুক্তি মেনে চলা।’’
‘’ কিন্তু এরা তো উল্টো পথে হাঁটলেন, প্রকাশ্যে গাড়ি কারখানা ভেঙ্গে দেওয়া হল। তাই স্বাভাবিক পরিণতি ছিলই যে টাটা গোষ্ঠী আর্বিট্রেশন ট্রাইবুনালে যাবে। তারা আইনি পথে গেছে, আর ট্রাইবুনালের রায় যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত ছিল।
“সরকার এখন বলছে তারা আপিল করবে, ক্ষতিপূরণের পরিমাণ তো আরও বাড়বে,” বলছিলেন. মি. ভট্টাচার্য।
মমতার জয় নাকি শিল্পায়নের হার? শিল্প-বাণিজ্য বিশ্লেষকরা বলছেন টাটা গোষ্ঠীর সঙ্গে রাজ্য সরকারের শিল্পোন্নয়ন নিগমের যে চুক্তি হয়েছিল, সেখানেই ‘আর্বিট্রেশন’ পদ্ধতি নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছিল যে কোনও এক পক্ষ চুক্তি থেকে বিচ্যুত হলে তা কোন পদ্ধতিতে মেটানো হবে।
সু্প্রিম কোর্ট যখন রায় দিয়েছিল যে সিঙ্গুরের জমি অধিগ্রহণের পদ্ধতিটাই অবৈধ, তারপরেই আর্বিট্রেশন ট্রাইবুনালে যায় টাটা গোষ্ঠী।
ওই ট্রাইবুনালের চেয়ারম্যান ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি ভি এস সারপুরকার। তিন সদস্যের ট্রাইবুনাল ঐকমত্যের ভিত্তিতে সোমবার রায় দেয় যে পশ্চিমবঙ্গ শিল্পোন্নয়ন নিগমকে প্রায় ৭৬৬ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ, এক কোটি টাকা মামলার খরচ আর ২০১৬ সালের পয়লা সেপ্টেম্বর থেকে ১১ শতাংশ হারে সুদ দিতে হবে টাটা গোষ্ঠীকে।
বিশ্লেষকরা ট্রাইবুনালের এই রায় নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত। কেউ বলছেন টাটা গোষ্ঠী সিঙ্গুর ছেড়ে চলে যাওয়ায় মমতা ব্যানার্জীর রাজনীতির জয় হয়েছে, কিন্তু শিল্প সম্ভাবনা পরাজিত হয়েছে।
বিশ্লেষকদের কথায়, টাটাদের মতো গোষ্ঠী পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে চলে যাওয়ার পর থেকে আর কোনও বড় বিনিয়োগ রাজ্যে আসে নি।
কারখানার জমি ফেরত দেওয়া হয়েছে কৃষকদের, তবে এখনও অনেক জমিই চাষের যোগ্য নয়
জমি অধিগ্রহণ ‘অবৈধ’
এর আগে ভারতের সর্বোচ্চ আদালত রায় দিয়েছিল যে ২০০৭ সালে তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার যে পদ্ধতিতে টাটা কারখানার জন্য জমি অধিগ্রহণ করেছিল, সেই পদ্ধতিটাই অবৈধ ছিল।
সেই রায়ে এটাও বলা হয়েছিল যে কৃষকদের জমি চাষযোগ্য করে তা ফেরত দিতে হবে।
সরকারিভাবে অধিগৃহীত জমি ফেরত পেলেও তার একটা বড় অংশ এখনও চাষযোগ্য হয়ে ওঠে নি, সেখানে আগাছা আর ঝোপঝাড় গজিয়ে রয়েছে।
বিশ্লেষকদের একাংশ বলছেন যে বিরোধী নেত্রী মমতা ব্যানার্জীর আন্দোলনের ফলে টাটা গোষ্ঠী পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে গুজরাট চলে গিয়েছিল, এখন সেই মিজ ব্যানার্জীর নেতৃত্বাধীন সরকারকেই তার জন্য ক্ষতিপূরণ দিতে হবে সরকারি কোষাগার থেকে।
রাজ্য সরকার অবশ্য ট্রাইবুনালের আদেশের বিরুদ্ধে আদালতে যাবে বলেই সরকারি সূত্রগুলি জানাচ্ছে।
টাটা গোষ্ঠী সিঙ্গুর ছেড়ে চলে যাওয়ার পরে বড় কোনও বিনিয়োগ আসে নি পশ্চিমবঙ্গে
যা বলছেন কৃষকরা
কলকাতা থেকে ঘণ্টাখানেকের দূরত্বে হুগলী জেলার সিঙ্গুরের প্রায় এক হাজার একর বহু ফসলি কৃষি জমি অধিগ্রহণ করে তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার।
সেই সময়ে মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য চেষ্টা করছিলেন পশ্চিমবঙ্গে শিল্প-বান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে।
টাটা গোষ্ঠীর প্রধান রতন টাটাকে অনেকটা ব্যক্তিগত উদ্যোগেই তিনি রাজী করিয়েছিলেন গাড়ি কারখানা তৈরি করতে।
ওই কারখানার জন্য প্রায় ছয়শো একর জমি আর আনুষঙ্গিক শিল্পের জন্য আরও প্রায় চারশো একর – মোট হাজার একর জমি নেওয়া হয়েছিল কলকাতা-দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ের ধারে।
সেখানকার কৃষকদের একটা বড় অংশ প্রথম থেকেই উর্বর জমি অধিগ্রহণের বিরোধিতা করছিলেন।
যে গোপালনগর এলাকার নারী-পুরুষ ২০০৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের ঠিক পরেই এলাকা পরিদর্শনে যাওয়া টাটা গোষ্ঠীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের ঝাঁটা দেখিয়ে বিক্ষোভ দেখিয়েছিলেন, তাদেরই অন্যতম ছিলেন অমিয় ধাড়া।
প্রায় ২৩ বছর পুরনো সেই দিনের কথা মনে করে মঙ্গলবার মি. ধাড়া বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, “আমরা তো জমি দিতে মোটেই রাজি ছিলাম না, জবরদখল করে, মারধর করে জমি নেওয়া হয়েছিল। জমিটা অবশ্য আমার নিজের নামে নয়, বাপ-কাকাদের নামের জমি ছিল। জমি আন্দোলনের প্রথম থেকেই আমরা ছিলাম। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে সেই কাঠা দশেক জমি ফেরত পেয়েছি, চাষও করছি সেখানে। এখন ট্রাইবুনাল এই রায় দেওয়ায় সেটা আমরা মোটেই মেনে নিতে পারছি না।“
সরকারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার রায় বের হওয়ার পরে মঙ্গলবার মি. ধাড়া আর তার পাড়ার কিছু নারী-পুরুষ বিক্ষোভও দেখিয়েছেন।
উল্টোদিকে শিল্পের জন্য জমি দিতে এগিয়ে এসেছিলেন কৃষকদেরই একটা বড় অংশ। এদেরই একজন উদয়ন দাস।
তার কথায়, “আমরা যে জমি দিয়েছিলাম সেটা তো ভবিষ্যতের কথা ভেবেই, যে এখানে শিল্প হলে আমার ঘরের ছেলে সেখানে একটা কাজ পাবে, বুড়ো বাবা একটা দোকান করতে পারবে। কিন্তু সেই সোনা এখন ছাই, ছাই নিয়ে আমরা কী করব? প্রায় তৈরি হয়ে যাওয়া কারখানা ডিনামাইট দিয়ে ফাটিয়ে ফেলা হল। এই ট্রাইবুনাল যে রায় দিয়েছে, তাতে তো এটা প্রমাণিত হয়ে গেল যে টাটারা এখানে সত্যিই এই পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করেছিল।
সৌ: বিবিসি বাংলা
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct