চলমান সংঘাতে হাজার হাজার লোক হতাহতের পাশাপাশি ব্যাপক অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকা। স্থল আক্রমণ ও বিমান হামলার মাধ্যমে ইসরাইলের ভূখণ্ডে হামাসের ঝটিকা হামলায় কেবল এই অঞ্চলই তছনছ হয়নি, ইসরাইলি বাহিনীর কৌশলী পালটা হামলায় গাজা ঢেকে গেছে শোকের ছায়ায়। শুরুতেই বলে রাখা দরকার, এই ঘটনা তথা চলমান ইসরাইল-হামাস সংঘাতের গভীর ভূরাজনৈতিক (জিও-পলিটিকস) প্রভাব রয়েছে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলসহ গোটা বিশ্বের জন্য। লিখেছেন জোরান ইভানভ।
গত ৭ অক্টোবর ইসরাইলে হামাসের অপ্রত্যাশিত আক্রমণের পর উভয় পক্ষের হামলা-পালটা হামলায় পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। চলমান সংঘাতে হাজার হাজার লোক হতাহতের পাশাপাশি ব্যাপক অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকা। স্থল আক্রমণ ও বিমান হামলার মাধ্যমে ইসরাইলের ভূখণ্ডে হামাসের ঝটিকা হামলায় কেবল এই অঞ্চলই তছনছ হয়নি, ইসরাইলি বাহিনীর কৌশলী পালটা হামলায় গাজা ঢেকে গেছে শোকের ছায়ায়। শুরুতেই বলে রাখা দরকার, এই ঘটনা তথা চলমান ইসরাইল-হামাস সংঘাতের গভীর ভূরাজনৈতিক (জিও-পলিটিকস) প্রভাব রয়েছে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলসহ গোটা বিশ্বের জন্য। বিশেষ করে, হামাসের অকস্মাত্ হামলা করে বসা; হামলার পেছনের গল্প; কোন উত্স, পক্ষ বা শক্তি প্রেরণা জুগিয়েছে হামাসকে এবং এই হামলার সম্ভাব্য পরিণতিই-বা কী হতে পারে—এমন সব প্রশ্নের ভারসাম্যপূর্ণ এবং যৌক্তিক ও পেশাগত বিশ্লেষণ একান্তভাবে জরুরি। এসব নিয়ে যে যার মতো করে ব্যাখ্যা করছেন বটে, কিন্তু আড়ালের গল্প জানা অতটা সহজ নয়! আমরা মত হলো, হামাস সম্ভবত কোনো ‘সাহসী মিশন’ হাতে নিয়ে থাকতে পারে। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী এই সশস্ত্র গোষ্ঠী হয়তো-বা এমন কোনো পরিকল্পিত মিশনের অংশ হিসেবে ইসরাইলে আক্রমণ চালায়, যা যে কোনো সুসংগঠিত রাষ্ট্রীয় সেনাবাহিনীকে চ্যালেঞ্জ করে বসার শামিল হিসেবে পরিগণিত হবে বিশ্বের সামনে! আমরা দেখেছি, হামাসের আক্রমণের ধরন আমূল পালটে গেছে। স্থলে কৌশলগত আক্রমণ তো বটেই, শত্রুপক্ষের গতিবিধি নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখে হামাস যেভাবে নিখুঁত হামলা চালিয়েছে, তা আসলেই অবাক করেছে সবাইকে। এ থেকে প্রমাণিত হয়, আক্রমণ অভিযান পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রচলিত অপারেশনাল পদ্ধতি থেকে সরে এসেছে হামাস। এবং এর মাধ্যমে হামাস জানান দিয়েছে, বেশ খানিকটা কৌশলী অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে তারা। অস্বীকার করার উপায় নেই, হামাসের সফল হামলার পর ইসরাইলের সামরিক গৌরব ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতির বড়াই ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছে। এ নিয়ে বহু কথা উঠবে আগামী দিনেও। তবে এ কথাও সত্য, হামাসের রণকৌশলে এই যে পরিবর্তন, নতুন ফরমেটে আক্রমণের পথ বেছে নেওয়া—এগুলো ইসরাইলের সঙ্গে যুদ্ধে কৌশলগত বিজয়ে হামাসের কতটা কাজে দেবে, তা ভেবে দেখার বিষয়। এর কারণ, হামাসের হামলার পর পালটা আক্রমণে গাজা পরিণত হয়েছে মৃত্যুপুরীতে।
গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, ঠিক কী উদ্দেশ্যে হামাস এ ধরনের হামলার পথ বেছে নিল? আমি মনে করি, এর পেছনে তিনটি উদ্দেশ্য থাকতে পারে।এক. ইসরাইলের সঙ্গে হামাস তথা ফিলিস্তিনের সংঘাত বিশ্বের সামনে বড় করে হাজির করা তথা দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা। হামাসের শীর্ষ নেতৃত্ব সম্ভবত এমন চিন্তা থেকে আক্রমণের ঘটনা ঘটিয়ে থাকতে পারে যে, সফল হামলার মাধ্যমে ইসরাইলের দুর্বলতা সামনে আসবে, যার ফলে বিভিন্ন পক্ষের সম্পৃক্ততা—ফিলিস্তিনের অন্যান্য দল এবং এমনকি ইরান—দুই পক্ষের থেমে থেমে চলা সংঘাতকে আরো বাড়িয়ে তুলবে। ফলস্বরূপ, উভয় পক্ষের দীর্ঘদিনের শত্রুতার একটা চূড়ান্ত মীমাংসার রাস্তা তৈরি হবে।দুই. ইসরাইলকে মোকাবিলার প্রশ্নে ইরানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাজ করার অভিযোগ রয়েছে হামাসের বিরুদ্ধে। এই অঞ্চলে ইরানের অত্যন্ত সক্রিয় ভূমিকার পরিপ্রেক্ষিতে এই দাবি অযৌক্তিক হবে না যে, বড় পরিসরে ইরানের নজরে আসার অংশ হিসেবে এবারের ব্যতিক্রমধর্মী হামলার পথে নেমে থাকতে পারে হামাস।তিন. অনেকেই বলছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় সৌদি আরব ও ইসরাইলের মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে যে চুক্তির বিষয়ে কথাবার্তা চলছিল, তা ভেস্তে দেওয়ার জন্য এই হামলা চালানো হয়। সত্যি বলতে, এমন দাবি অপ্রাসঙ্গিক নয়। কারণ, পেছনে ফিরে তাকালে দেখা যাবে, ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে ইসরাইল এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইনের মধ্যে স্বাক্ষরিত আব্রাহাম চুক্তির বাস্তবতা মেনে নিতে পারেনি হামাস। একইভাবে, ১৯৭৯ সাল থেকে মিশর ও ইসরাইলের মধ্যে স্বাক্ষরিত ক্যাম্প ডেভিড চুক্তিও প্রত্যাশা মেটাতে পারেনি হামাসের।প্রশ্ন উঠতে পারে, যুক্তরাষ্ট্রের দূতিয়ালিতে ইসরাইলের সঙ্গে সৌদি আরবের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ মেনে নিতে হামাসের আপত্তি কেন? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে আরো কিছুদিন অপেক্ষায় থাকতে হবে। তবে ভূরাজনীতির জটিল হিসাব এটাই বলে, পেছনের গল্প একসময় না একসময় সামনে আসেই!প্রশ্ন আরো আছে, হামলায় হামাস সফল হলো বটে, কিন্তু ইসরাইলকে তারা কতটা আটকাতে পারল? এতে হামাসের কী ধরনের লাভ হলো? সত্যিই তো! কৌশলগত আক্রমণ সত্ত্বেও হামাস বর্তমানে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। ইসরাইলের অপ্রতিরোধ্য সামরিক শক্তি, জনশক্তি ও প্রযুক্তির মুখে ফিলিস্তিন বড্ড অসহায় হয়ে পড়েছে।
বাস্তবতা হলো, হামাসের হামলায় ইসরাইলেরই বরং সব দিক দিয়ে লাভ হয়েছে! হামাসকে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে প্রমাণ করতে এখন থেকে আরো বেশি প্রচার-প্রচারণা চালাতে পারবে তারা। এক্ষেত্রে ইসরাইল ব্যাপক আন্তর্জাতিক সমর্থনও পাবে বলে আশা করা যায়। অন্যদিকে প্রবাসী হামাস, ইরান এবং ইসরাইলের সঙ্গে কোনো ধরনের সম্পর্ক নেই—এমন কিছু ক্ষেত্র বাদে হামাসের উল্লেখযোগ্য সমর্থন অর্জনের সম্ভাবনা কম। এসব বিচারে বলতে হয়, হামাসের উদ্দেশ্য স্পষ্ট করে বুঝতে পারাটা মুশকিল। তবে হামলার বাস্তবতা বিবেচনার ক্ষেত্রে তাদের যে বিশাল ভুল হয়ে গেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই—যেমনটা বলছেন বিশ্লেষকেরা।গভীরভাবে মনে রাখা জরুরি, মধ্যপ্রাচ্যের এই অঞ্চলে ভূরাজনীতির হিসাব সব সময়ই জটিল। এতদঞ্চলে অন্যতম শক্তিশালী আঞ্চলিক সামরিক শক্তি হিসেবে ইসরাইলকে স্বীকার না করে উপায় নেই। এমনকি মিশর, বাহরাইন, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরবের মতো নেতৃস্থানীয় আরব দেশও ইসরাইলের সঙ্গে ‘পারস্পরিক সম্পর্ক স্বাভাবিক’ রেখে চলে। তাছাড়া বৃহত্ শক্তিগুলোরও সর্বদা নজর থাকে এই এলাকার খুঁটিনাটির ওপর! অর্থাত্, যথেষ্ট সক্ষমতা ব্যতীত এমন কঠিন সমীকরণকে সহজ করে দেখতে গেলেই পড়ে যেতে হবে বড় বিপদে!উল্লেখ করতে হয়, এই অঞ্চলে বৃহত্ শক্তি হলো ইরান, যার কাঁধের ওপর সর্বদাই ঝুলে থাকে হামাসকে অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করার অভিযোগ। এই অর্থে, হামাসের হামলাকে ইরানের হিজবুল্লাহর পরিচালিত অপারশেন হিসেবে দেখানোর চেষ্টা চলে বরাবরই—তা সে প্রমাণিত হোক না হোক।লক্ষ করলে দেখা যাবে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইসরাইয়েলের ওপর অধিকতর সামরিক চাপ আরোপের জন্য সক্ষমতা তৈরির চেষ্টা করছে ইরান। মনে করা হয়, ইরান ক্রমাগত শক্তি সঞ্চয় করছে প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষকে শায়েস্তা করতে! এর অংশ হিসেবে হিজবুল্লাহ, সিরিয়ার আসাদ সরকার, ইয়েমেনের হুথি ও মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে বিভিন্ন মিলিশিয়াকে আর্থিক, যুদ্ধ সরঞ্জামাদি ও রাজনৈতিক সমর্থন দিয়ে থাকে ইরান। এসবের সঙ্গে রয়েছে লেবাননের হিজবুল্লাহর মতো বিভিন্ন অফিলিস্তিনি গোষ্ঠী। যাহোক, এসব বিভিন্ন পক্ষ ও অংশীদারকে সমর্থন করার পেছনে ইরানের প্রাথমিক উদ্দেশ্য সম্ভবত ‘ইসরাইলকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলা’। অনেক পর্যবেক্ষকের অভিমত, ইরান আঞ্চলিক আধিপত্য জাহির করতে সক্রিয় ভূমিকার অংশ হিসেবে হামাসকে ব্যবহার করে থাকতে পারে। তবে ঘটনা সত্য বা মিথ্যা হোক, হামাসের হামলা এবং গাজায় ইসরাইলের বৃহত্তর আক্রমণের মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে ভূরাজনীতির নতুন খেলা শুরু হয়ে গেল কি না, তাই দেখার বিষয়।আমরা শুনে আসছি, ঐতিহাসিকভাবে ইসরাইলের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো ‘হুমকিকে কার্যকরভাবে প্রতিরোধ করার সক্ষমতা’। তবে এবার ঘটেছে হিতে বিপরীত। সুতীক্ষ প্রতিরোধব্যবস্থা বাঁচাতে পারেনি ইসরাইলিদের। অথচ এ নিয়ে আত্মতুষ্টির শেষ ছিল না ইসরাইলের! হামাসের আক্রমণ ইসরাইলের দুর্বলতাকেই শুধু সামনে আনেনি, শত্রুপক্ষের মধ্যে আরো হামলার উত্সাহ এনে দিয়েছে! এই কথা বলার কারণ, আমরা অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করেছি, ৪৮ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে ইসরাইলি ভূখণ্ডের ভেতরে হামাস লাগাতার রকেট ছুড়েছে অনেকটা বিনা বাধায়! ইসরাইলি গোয়েন্দা পরিষেবার এই যে ব্যর্থতার নজির, তা যে বিভিন্ন পক্ষের জন্য হিসাব কষতে কতটা সুবিধা এনে দেবে, তা বলাই বাহুল্য। এর সঙ্গে আবার রয়েছে ইসরাইলের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ও সামাজিক বিভাজন ও অস্থিরতা। সুতরাং, ইসরাইল যে আগেকার দিনের মতো খুব একটা সুবিধা করে উঠতে পারবে না—বিরোধী শক্তিগুলোর মধ্যে যে এমন আলোচনা চলছে না, তা কে বলতে পারে!
লেখক: তুরস্কের টিওবিবি ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক ও স্লোভেনিয়ার লুব্লজানার রিংক ইনস্টিটিউটের প্রবীণ উপদেষ্টা।
ডেইলি সাবাহ থেকে অনুবাদ।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct