জোসেফ মাসাদ: ফিলিস্তিনিদের কার্যত ‘নিশ্চিহ্ন’ করে দেওয়ার মিশন নিয়ে ইসরায়েলি সেনারা গাজায় যে অভিযান চালাচ্ছে, তাতে গোটা পশ্চিমা রাজনৈতিক বলয়ের প্রচ্ছন্ন সমর্থন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।হামাস যোদ্ধারা ইসরায়েলি শিশুদের হত্যা করেছে এবং নারীদের ধর্ষণ করেছে বলে ইসরায়েলের পক্ষ থেকে যে প্রোপাগান্ডা চালানো হয়েছে, তাতে পশ্চিমা মিডিয়া সরাসরি সহযোগিতা করছে। সিএনএন এবং লস অ্যাঞ্জেলস টাইমস এই অপপ্রচারের শুরুটা করে দিয়েছে।ফিলিস্তিনিদের প্রতি পশ্চিমাদের ঘৃণা ও ইসরায়েলের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন বেশির ভাগ আরবকে প্রচণ্ড ধাক্কা দিয়েছে।চার দশক ধরে উদারপন্থী ও পশ্চিমাপন্থী আরব বুদ্ধিজীবীরা বলে এসেছেন, পশ্চিমা উদারপন্থীরা, এমনকি অনেক রক্ষণশীল পশ্চিমাও ফিলিস্তিনিদের বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গি বদলেছেন এবং ফিলিস্তিনিদের প্রতি আগের চেয়ে তাঁরা অনেক কম হিংসাত্মক ধারণা পোষণ করছেন। কিন্তু এখন যে পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে, তাতে তাঁদের পক্ষে সেই ধারণায় অটল থাকা খুবই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।ফিলিস্তিনিদের প্রতি শ্বেতাঙ্গ পশ্চিমাদের ঘৃণাসূচক ধারণা যে ঐতিহ্যগত, তা বুঝতে আমাদের উনিশ শতকের দিকে ফিরে যেতে হবে। ওই সময় শ্বেতাঙ্গ আমেরিকান ও ব্রিটিশ এবং অতি উগ্রপন্থী জার্মান প্রোটেস্ট্যান্টরা ফিলিস্তিনে উপনিবেশ গড়তে চেয়েছিল। সে সময় এরা সবাই আদিবাসী ফিলিস্তিনিদের প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়েছিল।ওই সময় ব্রিটিশ সরকার ফিলিস্তিনকে উপনিবেশ বানানোর চেষ্টার অংশ হিসেবে ইউরোপীয় ইহুদিদের প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিষ্টানে ধর্মান্তরিত করার একটি প্রকল্প নিয়েছিল। এটি ব্রিটিশদের জন্য সীমিত সাফল্য আনলেও এটিই মূলত ইহুদিদের জায়নিজমের উত্থানকে ত্বরান্বিত করেছিল।ফিলিস্তিনিরা মনে করে, ইহুদিরা কখনোই ফিলিস্তিনে শরণার্থী হিসেবে আসেনি। তারা মূলত এসেছিল হানাদার হয়ে। জায়নবাদী ঔপনিবেশিক অভিলাষ নিয়ে হিটলারের শাসনের অর্ধশতাব্দী আগেই তারা ফিলিস্তিনে ঘাঁটি গাড়ার চেষ্টা করেছিল। এ কারণে ফিলিস্তিনিদের চোখে ইউরোপ থেকে আসা ইহুদিরা শরণার্থী ছিল না, ছিল গণহত্যাকারী দখলদার শক্তি। তাদের সহযোগী ছিল পশ্চিমা শক্তিগুলো।উনিশ শতকের শেষ দিকে এই ইহুদি জায়নিজম ফিলিস্তিনিদের প্রতি চরম আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। ফিলিস্তিনিদের পরাজয়, তাদের মৃত্যু এবং ভিটেমাটি থেকে তাদের উচ্ছেদ নিশ্চিত করাকে ইহুদিরা আদর্শিক কর্তব্য বলে মনে করতে থাকে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশ বেলফোর ঘোষণা ও লিগ অব ন্যাশনসের ঘোষণায় ফিলিস্তিনিদের পরিত্যাজ্য হিসেবে চিত্রায়িত করা হয়েছিল। এর মধ্য দিয়ে ইউরোপের ইহুদিদের ফিলিস্তিনে বসতি গড়তে দেওয়ার বিষয়টিকে ন্যায্যতা দেওয়া সম্ভব হয়।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে অশ্বেতাঙ্গদের প্রতি ইউরোপিয়ান ও আমেরিকান বর্ণবাদী গোষ্ঠী ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে প্রোপাগান্ডা চালিয়ে যাচ্ছিল।যে ইউরোপিয়ান শ্বেতাঙ্গ খ্রিষ্টানরা ইহুদিদের ওপর গণহত্যা চালিয়েছিল, সেই একই শ্বেতাঙ্গ খ্রিষ্টানরা ইহুদিদের ওপর চালানো নির্যাতনের ক্ষতিপূরণ হিসেবে ইউরোপীয় ইহুদিদের ফিলিস্তিনিদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছিল। এর মধ্য দিয়ে জায়নবাদ ফিলিস্তিনিদের ওপর তীব্র ঘৃণা নিয়ে চেপে বসেছিল।এই জায়নবাদীরা ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনিদের তাদের নিজ ভূমি থেকে বিতাড়িত করার পর জাতিসংঘের প্রস্তাবগুলোতে ফিলিস্তিন সংকটকে বারবার ‘আরব শরণার্থী সমস্যা’ বলে উল্লেখ করা হচ্ছিল। এর মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের কার্যত ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করার চেষ্টা করে আসা হয়েছে।এরপর ইসরায়েলি উপনিবেশ উৎখাত করে ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা পুনঃপ্রতিষ্ঠায় যখন ফিলিস্তিনিরা গেরিলা আন্দোলন শুরু করে, তার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৮২ সালে ইসরায়েল লেবাননে নৃশংস গণহত্যা চালিয়েছিল।১৯৮৭ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত ফিলিস্তিনিদের যে আন্দোলন, যেটি প্রথম ইন্তিফাদা হিসেবে পরিচিত, সেই আন্দোলন ফিলিস্তিনিদের প্রতি পশ্চিমাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে আরও নেতিবাচক করে তোলে। তখন থেকেই পশ্চিমারা ফিলিস্তিনিদের ‘শান্তিপ্রিয়’ ইসরায়েলিদের ওপর বর্বর হামলা চালানো জাতি, এমনকি ‘জানোয়ার’ বলেও আখ্যায়িত করে আসছে। ফিলিস্তিনিরা মনে করে, ইহুদিরা কখনোই ফিলিস্তিনে শরণার্থী হিসেবে আসেনি। তারা মূলত এসেছিল হানাদার হয়ে। জায়নবাদী ঔপনিবেশিক অভিলাষ নিয়ে হিটলারের শাসনের অর্ধশতাব্দী আগেই তারা ফিলিস্তিনে ঘাঁটি গাড়ার চেষ্টা করেছিল। এ কারণে ফিলিস্তিনিদের চোখে ইউরোপ থেকে আসা ইহুদিরা শরণার্থী ছিল না, ছিল গণহত্যাকারী দখলদার শক্তি। তাদের সহযোগী ছিল পশ্চিমা শক্তিগুলো। এ কারণেই ফিলিস্তিনিদের ওপর চালানো গণহত্যা পশ্চিমাদের কখনোই হৃদয় স্পর্শ করেনি; বরং ইসরায়েলি ইহুদিদের হতাহতের ঘটনা তাদের আন্দোলিত করেছে। এ কারণে ইসরায়েলি সেনারা যখন নিরস্ত্র হাজার হাজার ফিলিস্তিনিকে হত্যা করে, তখনো তারা নির্বিকার থাকে।
মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত আকারে অনূদিত
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct