বাস্তবতা হল, ১৯১৪ সালের বিশ্ব আর আজকের বিশ্বের মধ্যে বিস্তর তফাত। পশ্চিমের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আধিপত্য বর্তমানে এক প্রকার ম্লান হয়ে গেছে, বলা যায়। দ্রুত গতির বৈশ্বিক উন্নয়নের ফলে শক্তি ভাগ হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বময়। আজকের যুগে চ্যালেঞ্জ মানেই তার উত্তাপ বয়ে যায় বিশ্বব্যাপী। এই অর্থে, সুযোগগুলোও বৈশ্বিক। এর ফলে প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ছোঁয়ায় আমূল বদলে যাওয়া পৃথিবী ব্যাপক সমৃদ্ধি অর্জন করেছে এবং যার ফলে লাখ লাখ মানুষের দুর্দশা লাঘব হয়েছে—এই কথার সঙ্গে দ্বিমত পোষণের কোনো সুযোগ নেই। লিখেছেন কার্লো রোভেলি।
১৯১৪ সালের কথা। ইউরোপের দেশগুলো মেতে ওঠে অস্ত্রের প্রতিযোগিতায়। আর্ম রেসের পাশাপাশি অর্থনীতিকে দ্বিগুণ করে গড়ে তোলার উদ্দাম প্রতিযোগিতা চলে সমান তালে। চারদিকে দেখা দেয় অস্থিরতা, অস্থিতিশীলতা। ঠিক এমন এক কঠিন পরিস্থিতিতে তরুণ আলবার্ট আইনস্টাইন, জ্যোতির্বিজ্ঞানী উইলহেলম ফোর্স্টার, ফিজিওলজিস্ট জর্জ ফ্রেডরিখ নিকোলাই ও দার্শনিক অটো বুয়েক এক জায়গায় জড়ো হন কিছু একটা করার চিন্তা থেকে। আমন্ত্রিত পণ্ডিত, শিল্পী তথা বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ইউরোপের মঙ্গলের জন্য প্রণয়ন করেন বিশেষ ইশতেহার। স্বাক্ষরিত ইশতেহারে অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে তুলে ধরা হয়, দেশগুলোর কাছ থেকে ইউরোপ তথা বিশ্ব ঠিক কী আশা করে। এতে জোর দিয়ে বলা হয়, ‘ক্রমবর্ধমান অস্থিরতা রুখতে সংস্কৃতির পটভূমিকায় দাঁড়িয়ে চিন্তা করুন, জাতীয়তাবাদী আবেগকে সামলান, এবং হানাহানির রাস্তা থেকে সরে এসে ইউরোপকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করুন।’ সর্বোপরি, অঙ্কিত হয় এক নতুন রূপরেখা—ইউরোপীয় ইউনিয়ন।
পরিতাপের বিষয়, বিজ্ঞজনদের কথায় কর্ণপাত করা হয়নি মোটেই। তাদের কথা শুনেছে, এমন দেশ ছিল হাতে গোনা। এরপর কী ঘটে? পরপর দুই দুইটি বিশ্বযুদ্ধের শিকারে পরিণত হয়ে মারাত্মক বিপর্যয়ের মধ্যে হাবুডুবু খায় ইউরোপ, যার সাক্ষী গোটা বিশ্ব। ইউরোপ হারায় তার স্বকীয় মর্যাদা। অবসান ঘটে ইউরোপের দৌরাত্ম্যের। সত্যি বলতে, আবারও সেই কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি আজকের ইউরোপ। কোনো সন্দেহ নেই, ইউরোপ তো বটেই, পুরো বিশ্বই কঠিন ঝুঁকির সম্মুখীন। একদিকে অস্ত্রের প্রতিযোগিতা, অন্যদিকে সমৃদ্ধি অর্জনের জোর প্রতিযোগিতা। অর্থাত্, অবস্থা ঠিক আগের মতোই—বিপর্যয়ের পদধ্বনি!
বাস্তবতা হলো, ১৯১৪ সালের বিশ্ব আর আজকের বিশ্বের মধ্যে বিস্তর তফাত। পশ্চিমের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আধিপত্য বর্তমানে এক প্রকার ম্লান হয়ে গেছে, বলা যায়। দ্রুত গতির বৈশ্বিক উন্নয়নের ফলে শক্তি ভাগ হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বময়। আজকের যুগে চ্যালেঞ্জ মানেই তার উত্তাপ বয়ে যায় বিশ্বব্যাপী। এই অর্থে, সুযোগগুলোও বৈশ্বিক। এর ফলে প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ছোঁয়ায় আমূল বদলে যাওয়া পৃথিবী ব্যাপক সমৃদ্ধি অর্জন করেছে এবং যার ফলে লাখ লাখ মানুষের দুর্দশা লাঘব হয়েছে—এই কথার সঙ্গে দ্বিমত পোষণের কোনো সুযোগ নেই। যদিও এসবের মধ্যেও ‘কিন্তু’ রয়েছে! উন্নয়নের প্রশ্নে একদিকে আমরা ব্যাপকভাবে এগিয়ে গিয়েছি, অন্যদিকে অস্ত্রশস্ত্র তৈরি কিংবা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকে সীমিত করার ক্ষেত্রেও ডুবে আছি উন্মত্ত প্রতিযোগিতায়। এর সঙ্গে রয়েছে সংঘাত-সংঘর্ষ তথা সংকট-সংকটাবস্থা। এসবের মধ্যে আবার আছে প্রক্সি যুদ্ধের মতো বিষয়।
ওপরের প্রবণতাগুলোর ফলে বর্তমান বিশ্বে কী ঘটছে? অবশ্যই ভালো কিছু নয়। পক্ষগুলো একে অপরকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার ভয়ংকর, লোমহর্ষক, অসভ্য খেলায় মেতে উঠেছে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে যুদ্ধ, সংঘাত। অর্থনীতি এক পা এগোচ্ছে তো দুই পা পেছোচ্ছে। অর্থাত্, পরিস্থিতি ঠিক সেই আগেকার যুগের মতো—ফ্রান্স ও জার্মানির হাত ধরে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় যে ধরনের পরিস্থিতির সম্মুখীন হয় বিশ্ব। সবকিছুকে ছাপিয়ে চিন্তার বড় কারণ হলো, বৈশ্বিক সংঘাত এমন পর্যায়ে উপনীত, পারমাণবিক ঝুঁকি গরম নিঃশ্বাস ফেলছে ঘাড়ের ওপর।
পরিতাপের বিষয়, সমাজ ও রাষ্ট্র আরো একটা বিশেষ প্রবণতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বুদ্ধিজীবী-শ্রেণির কথা শুনছেন না কেউই—ঠিক যেভাবে শোনা হয়নি আইনস্টাইনদের কথা। অথচ বিশ্বব্যাপী দ্বন্দ্বের অবসানে জ্ঞানের সীমানাপ্রাচীর তুলে নেওয়া একান্ত জরুরি। বিশেষজ্ঞ মহলের চিন্তাভাবনা, পরামর্শকে গুরুত্ব দিয়ে দেখলে শান্তির পথ খোঁজা সহজতর হবে নিঃসন্দেহে।
উদ্বেগ রয়েছে আরেক জায়গায়। বুদ্ধিজীবীদের মতোই গুরুত্ব পাচ্ছে না তরুণপ্রজন্ম। এই অবস্থায়, চলতি শতাব্দীর তরুণপ্রজন্ম যেন কেবল সাধারণ বিশ্বের পরিপ্রেক্ষিতে চিন্তা না করে, বরং কীভাবে গোটা গ্রহের ভবিষ্যত্ নিয়ে চিন্তা করার প্রয়াস পায়, সে বিষয়ে কাজ করা দরকার। যদিও এসব নিয়ে আমরা ততটা চিন্তিত কি না, তা নিয়ে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে।
উল্লেখ না করে উপায় নেই, গ্লোবালাইজেশন তথা বিশ্বায়নের সুবিধাদি নিয়ে যারা এক সময় সমালোচনা করত, লম্বা লম্বা কথা বলত, তারাও আজ বৈশ্বিক ভাঙন দেখে ভীত-সন্ত্রস্ত। বিশ্ব যেভাবে অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র ও যুদ্ধসরঞ্জামাদির আঁতুড়ঘরে পরিণত হয়ে উঠেছে, তাতে করে গ্লোবালাইজেশনের নেতিবাচক দিক নিয়ে আরো কথা উঠবে আগামী দিনগুলোতে।
আজকের বিশ্বে আমরা কী লক্ষ করছি? কিছু ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ঐকমত্য পরিলক্ষিত হয় বটে, কিন্তু রাজনৈতিক অস্বাভাবিকতার ছড়াছড়িও নেহাত কম নয়। বিভিন্ন জরিপের দিকে তাকালে দেখা যায়, জনমতের ঘাটতি দেশে দেশে। এর সঙ্গে মাথা চাড়া দিচ্ছে ক্রমবর্ধমান বৈষম্য। সত্যি বলতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চিত্রও এর ব্যতিক্রম নয়। যদি বলা হয়, এই দাবির ভিত্তি কী, এটা কীভাবে সম্ভব? তাদের উদ্দেশে বলব, মূলধারার সংবাদমাধ্যমগুলোয় চোখ বুলিয়ে নিন কিংবা ইউরোপীয় বা মার্কিন রাজনীতিবিদদের বক্তৃতা শুনুন—সব বুঝে যাবেন নিজে থেকেই।
সবচেয়ে বড় কথা, বিশ্বব্যাপী সামরিক গুরুত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। এক জরিপে দেখা গেছে, এক ক্যাল্লোর বর্ষে বৈশ্বিক সামরিক ব্যয় বেড়েছে ৩.৭ শতাংশ, অর্থের হিসাবে যা ২,২৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সমমূল্যের। এটা তো রেকর্ড! সামরিক ব্যয় বেড়েছে ইউরোপেও—সামরিক ব্যয়ের প্রশ্নে ৩০ বছরের রেকর্ড ভেঙেছে এই অঞ্চল।
অনেকের চোখে চীনকে দেখা হয় ‘বড় ধরনের হুমকি’ হিসেবে। ধারণা করা হয়, শি জিনপিং চীনকে এমন এক অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেষ্টা চালাচ্ছেন, যা ওয়াশিংটনের আধিপত্যকে রুখে দেবে অনায়াসে। শুধু তাই নয়, বেইজিং বিভিন্ন অঞ্চলে চলমান যুদ্ধের বিষয়েও নাক গলাচ্ছে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আইনি আদেশকে (ইন্টারন্যাশনাল লিগ্যাল অর্ডার) নৈতিক ভিত্তি হিসেবে ধরে পশ্চিমের দৃষ্টিভঙ্গি বিভিন্ন পক্ষকে অনুপ্রাণিত করলেও দিন শেষে এটা মাথায় রাখতে হবে, বিভিন্ন অঞ্চলে যে রক্তক্ষয়ী ও বিধ্বংসী যুদ্ধ চলছে, তা ভূ-রাজনৈতিক খেলা (জিওপলিটিক্যাল গেম) বই আর কিছুই নয়। মধ্যপ্রাচ্যের কথাই যদি ধরা হয়, একে ‘খেলা’ না বলে উপায় কী?
পশ্চিমা বিশ্বের জন্য মনে রাখা জরুরি, এই অঞ্চল বর্তমানে এমন এক অবস্থার সম্মুখীন, যেখানে দাঁড়িয়ে ভাবতে হবে, ঠিক কোন পথ ধরে এগোতে হবে। অনেক রাস্তার মধ্য থেকে একটামাত্র রাস্তাকে বেছে নিতে হবে। এই অঞ্চলের সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক সাফল্য বিশ্বের বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে সমৃদ্ধ করেছে, এই কথা যেমন সত্য, তেমনি এটাও কঠিন বাস্তবতা, এখানকার পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যা নিয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনার কোনো বিকল্প নেই। আসলেই, পশ্চিমারা এখনো শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখার বিচারে অনেক এগিয়ে, এবং এ-ও সত্য, অপ্রতিরোধ্য সামরিক ক্ষমতা অর্জনে অযৌক্তিক ব্যয়ের ক্ষেত্রেও তারা তালিকার ওপরের দিকেই অবস্থান করছে। এই হিসাবনিকাশ পশ্চিমা বিশ্বকে যে অস্তিত্বের মুখে দাঁড় করাবে না, তার গ্যারান্টি কী?
আজকের বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকাতে উচ্চকণ্ঠ। রাস্তায় বিক্ষোভ করছে লাখ লাখ তরুণ-তরুণী। পূর্বে ঝাও টিংইয়াং, পশ্চিমে লরেঞ্জো মার্সিলির মতো রাজনৈতিক দার্শনিকেরা কাজ করে যাচ্ছেন নিবিষ্ট মনে। জাতিসংঘের অসামান্য ভূমিকা তো বটেই, দালাই লামা থেকে পোপ পর্যন্ত—সবাই কাজ করে যাচ্ছেন নিজ নিজ জায়গা থেকে, এবং এর সঙ্গে রয়েছে সারা বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ। সবার যেন একই কথা—‘বিশ্বই আমাদের মাতৃভূমি’। এই কণ্ঠস্বর কি আরো জোরে শোনা যেতে পারে না?
তরুণ আলবার্ট আইনস্টাইন, জ্যোতির্বিজ্ঞানী উইলহেলম ফোর্স্টার, ফিজিওলজিস্ট জর্জ ফ্রেডরিখ নিকোলাই ও দার্শনিক অটো বুয়েকের মতো আজকের প্রজন্ম যদি এক জায়গায় জড়ো হয়ে করণীয় নির্ধারণ করে দেয়, বিশ্ব কি শুনবে তাদের কথা? মিডিয়া কি দয়া করে শুনবে সেই আওয়াজ? রাজনীতিবিদদের কর্ণকুহর পর্যন্ত কি পৌঁছাবে সেই ধ্বনি? নাকি ১৯১৪ সালে আইনস্টাইনের ইশতেহারের মতোই সব আয়োজন ব্যর্থ হয়ে যাবে? আমরা যেন এই কথা কোনোভাবেই ভুলে না যাই—কয়েক কোটি মানুষ অস্তিত্বের ঝুঁকিতে রয়েছে, আর সেই ঝুঁকি সঙ্গে করে বয়ে এনেছে ‘পারমাণবিক শঙ্কা’।
দ্য গার্ডিয়ান থেকে অনুবাদ:
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct