কেন্দ্রের মসনদে দ্বিতীয়বারের মতো ‘সম্রাটের’ ভূমিকায় নরেন্দ্র মোদি। তার শাসনামলে দেশের মুদ্রাস্ফীতি তলানিতে, বৃদ্ধি পেয়েছে বিদ্বেষের মাত্রা। যদিও নির্বাচনে ডাক দিয়েছিলেন ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ’। বাস্তবে তার যথার্থ প্রতিফলন না ঘটলেও প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসে নিজের ইমেজ তৈরি করতে সিদ্ধহস্ত হয়ে উঠেছেন। তা নিয়ে আলোকপাত করেছেন ড. দিলীপ মজুমদার।
রাজনৈতিক নেতারা তাঁদের ভাবমূর্তি নির্মাণের চেষ্টা করেন। এর জন্য ব্যয় করা হয় প্রচুর অর্থ। নেতার ভাবমূর্তি যখন সর্বব্যাপী হয় তখনই জন্ম হয় কাল্টের ( cult)। কাল্ট সম্বন্ধে উইকিপিডিয়া বলছে : Cult is a term, considerd pejorative by some, for a relatively small group is typically led by charismatic and self-appointed leader, who excessively controls its members, requiring unwavering devotion to set of a set of acts and practices which are considered deviant .” যখন কোন দলে ঐন্দ্রজালিক শক্তিসম্পন্ন কোন নেতার আবির্ভাব ঘটে, সেই দলের সদস্য ও সমর্থকরা অন্ধভাবে তাঁর আরাধনা করেন, তখনই জন্ম হয় কাল্টের।
বিশ শতকের প্রথমার্ধে ইতালির বেনিতো মুসোলিনি, জার্মানির অ্যাডলফ হিটলারকে ঘিরে তৈরি হয়েছিল কাল্টের। তারপর কি আশ্চর্য, যা হবার নয়, তাই হতে লাগল। কমিউনিস্ট দেশগুলিতে কাল্টের নিদর্শন তৈরি হতে লাগল। প্রথম দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন রাশিয়ার জোসেফ স্ট্যালিন। তারপর একে একে অনেক---- চিনের মাও-জে-দঙ, ভিয়েতনামের হো-চ-মিন, কিউবার ফিদেল কাস্ত্রো, অ্যালবানিয়ার এনভার হোক্সা, উত্তর কোরিয়ার কিম সুঙ (২য়)। রাশিয়ার ভ্লাদিমির পুতিন, তুর্কির এরদোগান, হাঙ্গেরির ওর্বান, ব্রাজিলের বলসোনারো, আমেরিকার ডোনাল্ড ট্যাম্প।
আমাদের দেশেও নরেন্দ্র মোদির আগে কংগ্রেস নেত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল কাল্ট। অবশ্য সেটি ছিল স্বল্পস্থায়ী। ইন্দিরাকে দেবী দুর্গার নবতম সংস্করণ মনে করা হত ; মনে করা হত ভারতই ইন্দিরা, ইন্দিরাই ভারত। ১৯৭১ সালের নির্বাচনে বিপুল জয় এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধজয় ইন্দিরা কাল্টকে শক্ত ভিত্তি দিয়েছিল। কিন্তু সে কাল্ট ভেঙে চুরমার হয়ে গেল ১৯৭৫ সালে জরুরি অবস্থা ঘোষণার পরে।
কিন্তু এই বিষয়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে কারোর তুলনা হয় না। স্টাইলে, নিত্য পরিবর্তনশীল পোশাক-আশাকে, নব নব স্লোগানে, চাতুর্যে, বাগ্মীতায় তিনি একমেবাদ্বিতীয়ম। জে পি নড্ডা ‘টাইমস অব ইণ্ডিয়া’য় বলেছেন, “ Modi is the only leader who has an electrifying effect on the masses and in whose call the entire nation gets united . His stupendous success is the result of absolute dedication to people’s well-fare and well-being. His only aim is to make India a Biswaguru .” অর্থাৎ মোদিই একমাত্র নেতা যিনি জনতাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখতে পারেন, এবং যাঁর ডাকে মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়। মানুষের মঙ্গলের জন্য তিনি নিবেদিতপ্রাণ আর তাঁর একমাত্র লক্ষ্য হল ভারতকে বিশ্বগুরু করে তোলা।
শুধু নড্ডা নন, মোদির দলের সব সাংসদ, সব বিধায়ক, সব নেতা, সব কর্মী চোখ বন্দনা করে মোদি ভজনা করে চলেছেন : মোদিং শরণং গচ্ছামি। রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ নয়, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ নয়, ভারতীয় জনতা দল নয়, বীর সাভারকর নয়, দীন দয়াল নয়, অটলবিহারী বা আদবানি নয় ; শুধু নরেন্দ্র মোদি। শুধুই মোদি, মোদি, মোদি। কে একজন ঠাট্টা করে বলেছিলেন বিজেপি দলের অন্যান্য নেতারা ক্রমশ বামন হচ্ছেন, আর মোদি হয়ে উঠছেন বিরাটাকার দৈত্য। সাংবাদিক, আমলা, অধ্যাপক, বিচারক সকলের মুখে মোদির নাম। সকলেই নতজানু। এই তো সেদিন, ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সুপ্রিম কোর্টের এক সাবেক বিচারপতির মুখে শোনা গেল যে মোদি---“versatile genius who thinks globaly, and acts locally.”
এইভাবে দেবতার মতো দেবতার মতো সর্বশক্তিমান হয়ে উঠেছেন মানুষটি। মানুষের মনের অন্দরে গেঁথে দেওয়া হচ্ছে একটি বোধ : মোদি হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়। যেন তিনি হাত দিলে লোহা সোনা হয়ে যাবে। আশ্চর্য তাঁর মন্ত্রবল। তা্ দিয়ে অসাধ্য সাধন সম্ভব। এই বোধটিকে আরও পাকাপোক্ত করার জন্য ছড়িয়ে দেওয়া হল তাঁর ছবি। ভারতময়। আধার কার্ডে, কোভিড টিকার শংসাপত্রে, গ্যাস সিলিণ্ডারে, জ্যাকেটে -কুর্তায়।
তিনি যা বলেন তাই মানুষ বিশ্বাস করে নেয়। এসব আসলে যে জুমলা, তা মানুষ মনেই করে না। তিনি বলেছিলেন কালো টাকা উদ্ধার করলেই তিনি প্রত্যেক ভারতবাসীর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ভরে দেবেন ১৫ লক্ষ টাকা। অনেক দিন পরে মোদির সেনাপতি শাহজি যখন বললেন, এটা জুমলা ছিল তখন অবাক হয়ে গেল মানুষ।
তবে কি স্বপ্নভঙ্গ হল মানুষের ? হিরণ্ময়পাত্রে আবৃত সত্যের মুখ তাঁরা দেখতে পেয়ে ক্রোধে আকুল হবে উঠলেন ?
না।
কারণ তখন শুরু হয়ে গেছে নতুন জুমলা। ঝোলা ভরে নানান স্বপ্ন নিয়ে দিল্লির মসনদে বসে আছেন এক স্বপ্নের ফেরিওয়ালা। ক্লিষ্ট মানুষ আবার সেই জাদুকরকে বিশ্বাস করে বসে।
স্বপ্ন ফেরি করে এক ধূর্ত জাদুকর।
আলোড়িত হয়ে ওঠে নগর-বন্দর।।
ভক্তির আবেগ জাগে নর-নারী মনে।
মোদি সূর্য দীপ্তি পায় ভারত গগনে।।
ভক্তির আবেগ যার নাই, সেই নর।
অবশ্যই দেশদ্রোহী, নাহিক অন্তর।।
দুষ্টের দমন তরে ধরাধামে মোদি।
পাইলেন নিরঙ্কুশ রাজত্বের গদি।।
নরেন্দ্র মোদির কথা অমৃত সমান।
যে শুনিবে সেই হবে মহা পুণ্যবান।।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct