এম ওয়াহেদুর রহমান: মানবসমাজের উন্নতি তথা সংশোধনের জন্য ওয়াজ - মাহফিল কিংবা জালসা একটি অতুলনীয় পন্থা। সুন্দর, শান্তিপূর্ণ সরর্বোপরি দ্বীনি সমাজ গঠনে দাওয়াতের কোন বিকল্প নেই। আর ওয়াজ - মাহফিল হলো দাওয়াতের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম । ধর্মীয় উপদেশের জন্য আহুত সমাবেশে কে ওয়াজ মাহফিল বলা হয় । এর উদ্দেশ্যে হলো মানুষ কে পবিত্র কোরআন সুন্নাহর আলোকে বয়ান শুনিয়ে সত্য পথে আনয়ন করা। মহান আল্লাহর প্রেরিত সর্বশেষ “ পূর্নাঙ্গ জীবন বিধান” কিংবা “ সংবিধান “ হলো পবিত্র কোরআন। আর এই কোরআনের ব্যাখ্যা হচ্ছে হাদিস। কোরআন ও হাদিসের বাণী জনগণের নিকট পৌঁছে দেওয়ার একটি অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে ওয়াজ মাহফিল বা জালসা । এই জালসা বিশ্ব মুসলিম মিল্লাতের মাঝে আবহমানকাল ধরে শীত মৌসুমে উৎসবের আবহে পাড়ায় মহল্লায় এমনকি শহরাঞ্চলে ও আয়োজিত হচ্ছে । বিজ্ঞানের উত্তোরত্তর ক্রমোন্নতির ফলে তা আজ আরও ব্যাপকতা লাভ করেছে। এই ওয়াজ মাহফিলের মাধ্যমে জনগণকে একত্রিত করে ইসলামী নৈতিকতার শিক্ষা কে জনমানসে উপস্থাপন করা হয়। তাই মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করেছেন , ‘ ও ব্যাক্তির চাই তে কথায় উত্তম আর কে আছে, যে ( মানুষকে ) আল্লাহর দিকে ডাকে ও নিজে সৎকর্ম করে বলে যে নিশ্চয়ই আমি আত্মসমর্পণকারীদের অন্তর্ভুক্ত। ‘ আল্লাহ আরো বলেছেন , ‘ বলুন! এটাই আমার পথ । আমি ও আমার অনুসারীগণ আল্লাহর দিকে জাগ্ৰত জ্ঞান সহকারে । আল্লাহ পবিত্র। আর আমি অংশীবাদীদের অন্তর্ভুক্ত নয়।’ মানবতার শ্রেষ্ঠ মহামানব হযরত মুহাম্মদ সা. ও বলেছেন , ‘ আমার পক্ষ থেকে একটি আয়াত হলেও তা পৌঁছে দাও ।’
‘ ওয়াজ ‘ আরবী শব্দ । এর অর্থ উপদেশ, নসীহত ও বক্তব্য। ‘ মাহফিল ‘ শব্দটি বহুবচন , যার অর্থ হলো সভা ও সমাবেশের স্থান। আর ‘ জালসা’ কিংবা ‘ জলসা ‘ বুৎপত্তিগত ভাবে আরবী শব্দ। এটি একটি বিশেষ্য পদ, অর্থ হলো আনন্দ - সম্মিলন, নৃত্য - গীতাদির বৈঠক। অর্থাৎ নাচ , গান প্রভৃতির মজলিস,আসর, বৈঠক। এই ওয়াজ মাহফিলে দূর দূরান্তের নামী দামী আলেম ওলামা গণ বিভিন্ন বিষয়ে আলোকপাত করে থাকেন । ফলে জনগণের মাঝে দ্বীনি জাযবা ক্রমশঃ বৃদ্ধি পায়। মুসলিম উম্মাহ শরীয়ত সম্মত চলার তাওফিক অর্জন করে থাকে। নবী ও রাসূলগণের মিশন ছিল আল্লাহর দিকে মানুষ কে আহ্বান করা ও তাগূত থেকে বিরত রাখা। তাই মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করেছেন, ‘প্রত্যেক সম্প্রদায়ের নিকট আমি রাসূল প্রেরণ করেছি । এই মর্মে যে তোমারা আল্লাহর এবাদত কর এবং তাগূত থেকে দূরে থাক ।’ কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় আজ কিছু অসাধু আয়োজক বা আলোচক কিংবা আলেম ওলামাদের জন্য ওয়াজ মাহফিল অথবা জালসা আদর্শভ্রষ্ট তথা লক্ষ্যচূত হয়ে পড়েছে। ওয়াজ মাহফিলের মঞ্চ আজ অনেকটাই হয়তো বিনোদন মঞ্চ বা রাজনৈতিক মঞ্চ হিসেবে ব্যাবহৃত হচ্ছে। অনেক আলোচক মিথ্যা - বানাওয়াট কেচ্ছা কাহিনীর মাধ্যমে কেউ তো আবার যিকরের নামে গর্হিত লাফালাফি ও অঙ্গভঙ্গি করে মঞ্চের আদর্শকে মুচ্ছে দিচ্ছে । আবার অনেক আলোচক খুবই আপত্তিজনক অর্থহীন ও অশালীন ভাষায় বক্তব্য পরিবেশন করে থাকেন । অর্থহীন সঙ্গীত ও পরিবেশন করে থাকেন। পরচর্চা বা পরনিন্দা অর্থাৎ গীবত একটি জঘন্য কর্ম হিসেবে বিবেচিত হলেও বাস্তবে কিছু কিছু আলেম ওলামা জালসার মঞ্চকে এই ন্যক্কারজনক কাজে ব্যবহার করেন। হাজার হাজার শ্রোতাদের সামনে একজন আলেম অপর আরেক জন আলেমের গীবত করে থাকেন নির্দ্বিধায় । অথচ মহান আল্লাহ বলেছেন, তোমরা আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধর , পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে যেয়ো না ।’ ওয়াজ মাহফিলের পোষ্টারে আজ দলীয় নেতা কর্মীদের নামের দরুন মূল আলোচকদের নামই খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়েছে। কোথাও তো শাসক দলের নেতা কর্মীদের নাম তো আবার কোথাও বিভিন্ন দলের নেতা কর্মীদের নাম দেওয়া হয়। নেতা কর্মীদের নাম দেওয়া নিয়ে অনেক তরজা , অনুরাগ ও অভিমান । বক্তৃতা চলাকালীন মঞ্চে কোন নেতার আগমন ঘটলে বক্তব্য থামিয়ে দিয়ে ঐ নেতা কে বক্তব্য দিতে দেওয়া হয়, যা ইসলামী নৈতিকতা বিবর্জিত কাজ । তাছাড়া এর ফলে আলোচকের আলোচনায় ছন্দপতন ঘটে ও শ্রোতাদের ও মনোযোগ বিনষ্ট হয় । নবী, রাসুল ও সাহাবীদের মতো আজকের দিনে আলোচকগণ অর্থাৎ আলেম ওলামারা নি:স্বার্থভাবে দ্বীনের দাওয়াতী কাজ করেছেন না । তারা মাছের বাজারের মতো দর দামের মধ্যে দিয়ে বিক্রি হচ্ছেন দাওয়াতের কাজে।আজ যেন তারা নি : স্বার্থের পরিবর্তে আর্থিক মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যেই দাওয়াতের কাজ করে চলেছেন নির্দ্বিধায়। তবে প্রসঙ্গত উল্লেখ্য জালসা কমেটি স্বেচ্ছায় প্রদত্ত হাদিয়া অথবা পাথেয় গ্ৰহন করা জায়েজ । তা যদি বক্তার ডিমান্ড বা চাওয়া হয় বা দরকষাকষি করে নির্ধারণ করা হয় তবে তা আদৌ সিদ্ধ নয়, তখন এটি আর হাদিয়া থাকে না ; বিনিময় হয়ে যায় । নবী, রাসুল এমনকি সাহাবীগণেরাও কেউ দ্বীনি দাওয়াতের জন্য বিনিময় গ্ৰহন করেন নি । তাই মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করেছেন , ‘ তোমরা অনুসরণ কর তাদের, যারা তোমাদের কাছে কোন প্রতিদান চায় না এবং তারা সুপথ প্রাপ্ত ।’ তাই নূহ আলাইহিস সালাম বলেছেন , ‘ আমি তোমাদের নিকটে এজন্য ( দ্বীন প্রচারের জন্য ) কোন প্রতিদান চাই না। আমার প্রতিদান কেবল বিশ্বপালকের নিকটেই রয়েছে ।’ এমনকি হুদ আলাইহিস সালাম ও স্বীয় কওমের লোকদের উদ্দেশ্যে বলেছেন , ‘ হে আমার সম্প্রদায়! আমি তোমাদের কাছে এর কোন বিনিময় চাই না ।এর বিনিময় তো কেবল তার কাছেই রয়েছে যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন । তবু ও কি তোমরা বুঝ না ।’ সুতরাং দ্বীন প্রচারের কোন দুনিয়াবি পারিশ্রমিক বা বিনিময় হয় না। এর বিনিময় একমাত্র মহান আল্লাহই দিবেন ।
মূলত শ্রোতাদের দ্বীনের পথে নিয়ে আসাই হচ্ছে ওয়াজ মাহফিলের মূল উদ্দেশ্য। তা কখনোই সুন্দর প্যান্ডেল, আকর্ষণীয় মঞ্চ , জাঁকজমকপূর্ণ লাইটিং, উন্নত সাউন্ড সিস্টেম, নামী দামী আলেম ওলামাদের বক্তব্য ও উপচেপড়া ভীড় - ওয়াজ মাহফিলের আশু লক্ষ্য নয়। তাই মহান আল্লাহ বলেছেন , ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা তা কেন বল, যা তোমরা কর না , তা বলা আল্লাহর নিকট বড় ঘৃণিত কাজ ।’ আলেম ওলামাদের কখনোই ভুলে যাওয়া উচিত নয় ওয়াজের নামে পরচর্চা, গালিগালাজ, পরনিন্দা প্রভৃতির মাধ্যমে সাময়িক তৃপ্তি অর্জন করা সম্ভব হলে ও বাস্তবে তা অত্যন্ত ঘৃণিত অপরাধ । আলেম ওলামাগণ আবেদন মূলক , দলিল ভিত্তিক কথার মধ্য দিয়েই জীবন ঘনিষ্ঠ যুগোপযোগী বক্তব্য পরিবেশন করলেই স্বার্থক হয়ে উঠবে ওয়াজ মাহফিলের আদর্শ । ওয়াজ মাহফিল অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মসজিদ কিংবা মাদ্রাসার উন্নতিকল্পে হয়ে থাকে । আর এই ক্ষেত্রে নামাজী বেনামাজী , সুদখোরেরাই ওয়াজ মাহফিলের জন্য চাঁদা আদায়ের কাজ করে থাকে , যা মোটেও কাম্য নয় । তাছাড়া আদায়কৃত চাঁদার অর্থ সৎ পথে উপার্জিত না অসৎ পথে উপার্জিত তা কখনো বিবেচনা করা হয় না । ওয়াজ মাহফিলে বক্তব্য বাদ দিয়ে আলোচগণ মাঝে মধ্যে হঠাৎ হঠাৎ করে অর্থ আদায় করে থাকেন তা নৈতিকতা বিবর্জিত বিষয় । ওয়াজ মাহফিল কেমন যেন আজকের দিনে ক্রমশঃ মেলা - খেলায় পরিণত হয়েছে । যে রমনীদের পর্দার বিষয়ে মহান আল্লাহ এমনকি মানবতার অগ্ৰদূত হযরত মুহাম্মদ সা. ও বারংবার কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করেছেন তা সত্ত্বেও আজ তারা অবলীলাক্রমে নির্দ্বিধায় বিচরণ করছে জালসার মেলায় । ভাবতে অবাক লাগে আমরা আজ কোথায় চলেছি , কি পথ দেখাবো আগামী দিনের ভবিষ্যৎ সাফল্যের কারিগরদের !
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct