এম এস ইসলাম: যে সময়ে রবীন্দ্রপ্রতিভায় সব চাপা পড়ে যাচ্ছিল। সেই সময় অবিভক্ত বর্ধমানের কালনার চুপি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ছন্দের যাদুকর কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত। অসাধারণ কাব্য প্রতিভা তাকে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে। ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে ১২ই ফেব্রুয়ারি বর্তমান পূর্ব বর্ধমানের অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র চুপি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা রজনী নাথ বাংলার বিখ্যাত মনীষী অক্ষয় কুমার দত্তের পৌত্র ছিলেন। সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের মামার বাড়ি ছিল ২৪ পরগনার নিমতা গ্রামে। এখানেই তার বাল্যশিক্ষা শুরু হয়। ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার সেন্ট্রাল কলেজিয়েট স্কুল থেকে মেট্রিকুলেশান পাশ করেন । ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে জেনারেল অ্যাসেম্বলিজ ইন্সটিটিউশন থেকে এফ এ পাস করেন। সত্যেন্দ্র নাথ দত্ত কিছুদিন ব্যবসা করার পর আবার ভর্তি হন এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ পাস করেন। স্কুলে পড়ার সময় থেকেই তিনি কবিতা লিখতে শুরু করেন। অসাধারণ কবিতা বাংলা ভাষাভাষী মানুষের কাছে তাকে অত্যন্ত জনপ্রিয় করে তোলে। ‘’ঝরনা ঝরনা সুন্দরী ঝরনা তরলিত চন্দ্রিকা চন্দন বর্ণা অঞ্চল সিঞ্চিত গৌরিক স্বর্ণে গিরি মল্লিকা দলে কুন্তল কর্নে তনু ভরি যৌবন তাপস অর্পনা ঝরনা ‘’আবার অন্যরকম এক কবিতা পালকির গান ‘’পালকি চলে পালকি চলেগগন তলে আগুন জ্বলে’’। ১৯২৫ সালে গান্ধীজী বর্ধমান এসেছিলেন এবং বর্ধমানের ঐতিহাসিক টাউনহলে চরকা কেটেছিলেন। সেই চরকা কাটার ফলে গ্রাম বাংলায় চরকা নিয়ে সারা পড়ে গিয়েছিল। গান্ধীজীর বর্ধমানে আসার তিন বছর আগেই সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত ইহলোক ত্যাগ করে গিয়েছিলেন। কিন্তু তার আগেই চরকা সম্বন্ধে অসাধারণ কবিতা রচনা করে চরকার গানে আবার রক্ত মাংসের মানুষ হয়ে উঠলেন বর্ধমানে গান্ধীজীর আগমনে । তিনি চরকা সম্বন্ধে লিখেছিলেন ‘’চরকায় লজ্জার সজ্জার বস্ত্র চরকাই দৈন্যের সংখ্যার অস্ত্র চরকাই সন্তান চরকায় সম্মান চরকায় দুঃখীর দুঃখের শেষ ত্রান। ‘’বর্ধমানের গান্ধীজীর চরকা কাটার পর ওই সময় বর্ধমানের মেয়েরা গাইত ‘’চরকা আমার সোয়ামির পুত চরকা আমার নাতি চরকার দৌলতে মোর দুয়ারে বান্দা হাতি। ‘’জাতীয় আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বহু কবিতার মধ্যে স্বাধীনতার আন্দোলনকে গতিময় করেছিলেন । তার অসাধারণ কাব্যগ্রন্থ গুলির মধ্যে বেণু ও বীনা, হোম শিখা, তীর্থ সলিল, তীর্থ রেণু, ফুলের ফসল, জনম দুঃখী, কুহু ও কেকা, চীনের ধুপ, রঙ্গ মল্লি,তার একমাত্র উপন্যাস ছিল বারোয়ারি। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে ২৫ শে জুন মাত্র ৪০ বছর বয়সে তিনি পরলোক গমন করেন । তিনি বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে ছিলেন এবং বিধবা বিবাহের পক্ষে কবিতা রচনা করেছেন। তার বিখ্যাত কবিতা ‘’পুরা কেন গা ‘’যখন এক বাল্য বিধবা কে সহমরণে পোড়ানো হচ্ছে। আগুনের শিখায় যখন তার গোটা শরীর জ্বলে যাচ্ছে। সেই সময়ে চিতার কাঠ ছেড়ে নদীর জলে ঝাঁপ দেয় ওই মহিলা। এক মুসলমান মাঝি তাকে প্রাণ রক্ষা করে এবং পরবর্তীকে তো তাকে বিবাহ করে। তার জোয়ান মরদ বিভিন্ন প্রকার কাজ করে আর সে মিসি বিক্রি করে কোন এক প্রশ্নের উত্তরে তার শরীর কেন পুড়ে গেছে তার উত্তরে সেই মহিলা এই কথা বলেছিল । সেই কাহিনী কবিতার মধ্যে অসাধারণ নৈপুণ্যে সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত ফুটিয়ে তুলেছেন। ফারসি ভাষার ভারত সম্রাজ্ঞি তথা বর্ধমান কন্যা নুরজাহানের অসাধারণ কবিতার বাংলা অনুবাদ করে বাংলা ভাষার মানুষের কাছে বর্ধমান কন্যা মেহেরুন্নেসাকে কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত অমর করে রেখে গেছেন। নুরজাহানের সেই ফার্সি কবিতা ‘’বড় মাজারে মা গরীবা ন চিরাগে ন গুলে ন পারে পরোয়ানা সুজ্জদ ন সাদা এ বুলবুলে। ‘’আমার মতো দিন গরীবের কবরে কোন প্রদীপ জ্বলবে না ফুল ও থাকবে না পতঙ্গ পুড়বেনা ও কোন বুলবুলের আওয়াজ শোনা যাবে না। ‘’গরিব গোরে দীপ জ্বেলোনা ফুল দিও না কেউ ভুলে শ্যামা পোকার না পরে পাখ দাগ না পাই বুলবুলে ।’’বর্ধমানের কবি , বাংলার কবি, বাংলা ভাষা ভাষী মানুষের কবি ছন্দের জাদুকর কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত আজও অমর হয়ে রয়েছেন।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct