কেন্দ্রের মসনদে দ্বিতীয়বারের মতো ‘সম্রাটের’ ভূমিকায় নরেন্দ্র মোদি। তার শাসনামলে দেশের মুদ্রাস্ফীতি তলানিতে, বৃদ্ধি পেয়েছে বিদ্বেষের মাত্রা। যদিও নির্বাচনে ডাক দিয়েছিলেন ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ’। বাস্তবে তার যথার্থ প্রতিফলন না ঘটলেও প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসে নিজের ইমেজ তৈরি করতে সিদ্ধহস্ত হয়ে উঠেছেন। তা নিয়ে আলোকপাত করেছেন ড. দিলীপ মজুমদার।
কাকে বলে ফকির? যার ঘরবাড়ি নেই, সংসার নেই, বউ-বাচ্চা নেই, ধন-সম্পদ নেই, পথে পথে যে ঘুরে বেড়ায়, ঈশ্বরের বা আল্লার নামগান করে ঘুরে বেড়ায় যে তাকেই ফকির বলে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও নিজেকে ফকির বলে থাকেন। লণ্ডনে গিয়ে বলে এসেছেন। নিজের দেশে তো আকছার বলেন। তিনি বলেন, জাগতিক কোন বিযয়ে আকর্ষণ নেই তাঁর। যে কোন সময়ে কাঁধে ঝোলা নিয়ে তিনি বেরিয়ে পড়তে পারেন পথে –‘ঝোলা লেকে চল পড়েঙ্গে’। একবার ফিরে দেখা যাক তাঁর অতীত জীবনের দিকে।১৯৫০ সালে জন্মেছিলেন তিনি গুজরাটের মহেসান জেলার বড়নগর গ্রামে। দামোদরদাস মূলচাঁদ মোদির ঔরসে, হীরাবেন মোদির গর্ভে। মূলচাঁদ ও হীরাবেনের ছয় সন্তান : সোম, অমৃত, নরেন্দ্র, প্র্হলাদ, পঙ্কজ, বাসন্তী।গরিব পরিবার। মোদি নিজেকে চাওয়ালা বলে গর্ব বোধ করেন। বড়নগর রেলস্টেশনে তিনি না কি তাঁর বাবাকে চা বিক্রিতে সাহায্য করতেন। তারপরে বাসস্ট্যাণ্ডের কাছে ভাইএর সঙ্গে চা বিক্রি করতেন। আট বছর বয়েসে যোগ দিলেন রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘে।পরিবারের প্রথা অনুযায়ী খুব কম বয়েসে মাতৃহারা যশোদাবেনের সঙ্গে বিয়ে হল নরেন্দ্র মোদির। ১৯৬৮ সালে। নরেন্দ্রের বয়েস তখন মাত্র ১৮ বছর। কিন্তু বিয়ের মাত্র তিন বছর পরে সংসার ত্যাগ করে পরিব্রাজকের জীবন বেছে নিলেন নরেন্দ্র। সাল ১৯৭১। দু বছর পরে ফিরে এলেন নরেন্দ্র। তার আগেই যশোদাবেন চলে গেছেন তাঁর বাপের বাড়ি। নরেন্দ্র বাড়িতে ফিরে এলে তাঁর মা আবার ছেলেকে বাঁধতে চাইলেন সংসারে। ডেকে পাঠালেন যশোদাবেনকে। কিন্তু নরেন্দ্র তাঁকে সাফ জানিয়ে দিলেন তাঁর জন্য সংসার-টংসার নয় ; আবার তিনি বেরিয়ে পড়বেন পথে। স্ত্রী যেতে চাইলেন স্বামীর সঙ্গে। রাজি হলেন না স্বামী। তাহলে নরেন্দ্র মোদি সত্যিই তো ফকির ! সংসারসুখ যিনি ত্যাগ করতে পারেন, স্ত্রীকে তিনি ত্যাগ করতে পারেন, কামিনী-কাঞ্চনের প্রতি যাঁর কোন মোহ নেই, তিনি তো ফকির।
কিন্তু ফকিরেরা কি রাজনীতিতে আসেন? রাজনীতির ঘোলাজলে লীলাখেলা করেন? ফকির কি মন্ত্রী হন? মুখ্যমন্ত্রী হন কি ফকির? প্রধানমন্ত্রী হবার জন্য তৈরি করেন ব্র্যাণ্ড? ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য প্রয়োগ করেন ছল-বল-কৌশলের চাণক্যনীতি? রচনা করে যান নিত্য-নতুন জুমলা? এই জায়গাটায় বড্ড অমিল। সত্যিকারের ফকিরের সঙ্গে ‘নিজেকে ফকির বলা’ নরেন্দ্র মোদির দুস্তর অমিল। তখন মনে হয় নিজেকে ফকির বলাটাই বোধ হয় এক জুমলা। নিজেকে দেশের চৌকিদার বলার মতোই। ফকিরের কোন স্থায়ী বা অস্বায়ী সম্পদ থাকে না। ফকির মোদির আছে। গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময়ে বা তার আগে তাঁর কি সম্পদ ছিল, তার কোন হদিশ আমরা জানি না। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হবার পরে আর টি আইএর মাধ্যমে নরেন্দ্র মোদির সম্পদের একটা হিসেব পাওয়া গিয়েছে। গুজরাটে তাঁর একটি বাড়ি আছে। তার বাজার মূল্য প্রায় ১ কোটি টাকা। ৪টি ৪৫ গ্রামের সোনার আংটি আছে। গুজরাটের গান্ধিনগরের ব্যাঙ্কে গচ্ছিত আছে বেশ কিছু টাকা। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর মাস মাইনে ২ লক্ষ টাকা। হিসেবে দেখা যাচ্ছে বছরে তাঁর সম্পদ বেড়েছে ৩৬ লক্ষ টাকা। মজার ব্যাপার হল বানিয়া সন্তান হলেও গৃহমন্ত্রী অমিত শাহের সম্পদ কিছুটা কমেছে বছরের হিসেবে ; ২০১৯ সালের হিসেবে ৩২.৬ কোটি থেকে তা কমে দাঁড়িয়েছে ২৮.৬৩ কোটিতে।ফকির ইমেজকে আরও পাকাপোক্ত করার জন্য মোদি শুরু করলেন দাড়ি রাখতে। দেখে মনে হবে যেন দাড়িওয়ালা সাধুবাবা। এই ইমেজটা লোকে খাবে খুব। অবশ্য দাড়ি তিনি রেখেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনের আগে। দাড়িওয়ালা রবি ঠাকুর বাংলার আইকন। মোদি ভেবেছিলেন তিনি দাড়ি রাখলে তাঁকেও রবি ঠাকুরের মতো লাগবে। নিশ্চিত ছিলেন তিনি বঙ্গের গদি ওল্টানোর ব্যাপারে। অমিত শাহ তো বার বার বলছিলেন ; ইসকে বার দোশ পার। তাঁরা বিজয় উৎসবের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু ফল বেরোতে দেখা গেল তাঁরা সাতের ঘর পেরোতে পারেন নি। তারপর অবশ্য নরেন্দ্র মোদির দাড়ি ছোট হতে শুরু করে। আসল ফকির ও সাধুরা ত্যাগের মাধ্যমে ভোগ করেন। কিন্তু আমাদের নরেন্দ্র মোদি ভোগের মাধ্যমে ত্যাগ করেন। যুগের প্রয়োজনে তিনি শাস্ত্রবচনকে একটু বদলে নিয়েছেন। ভক্তরা তাঁকে ঠিক চিনেছেন। ভক্তদের কাছে তিনি অবতারবিশেষ। কিন্তু পুঁথিপড়া এলিট আর বিরোধীরা তাঁকে চিনতে পারেন নি। এঁরা কেবল ছিদ্রান্বেষণে ব্যস্ত। তাই তো ফকির নরেন্দ্র আক্ষেপ করে বলেন লুটিয়েন দিল্লি আর খান মার্কেট গ্যাংএর সদস্যরা তাঁর বিরুদ্ধে বড় অকথা -কুকথা বলেন। লুটিয়েন আর খান মার্কেট ---শব্দ দুটি উচ্চারণ করে ফকিরবাবাজি বুঝিয়ে দিলেন তাঁর ইতিহাসজ্ঞানের বিযয়টি। এই সব সমালোচকেরা কি জানেন ফকির সিংহাসন লাভ করার পরে দিনে মাত্র ৩ ঘণ্টা বিশ্রাম নেন, বাকি একুশ ঘণ্টা কাজ আর কাজ। ডিগ্রি ডিপ্লোমা তাঁর না থাকতে পারে, কিন্তু তাঁর আছে সহজাত প্রজ্ঞা। নিত্য তিনি জপ-তপ করেন। তার ফলেই অর্জিত হয়েছে পরম জ্ঞান। তাই তিনি অবলীলাক্রমে বলতে পারেন, ‘ হার্ডওয়ার্ক ইজ মোর ডিজায়ারেবল দ্যান হারভার্ড।‘ এবার বলি এই ফকিরের আহার -বিহার, চাল-চলনের কথা। এ সব নিয়ে নিন্দুকদের অভিযোগের অন্ত্য নেই। ১২ একর জায়গায় তাঁর পেল্লাই বাসভবন নিয়ে, ঘড়ি ঘড়ি পোশাক বদল নিয়ে, দশ লক্ষ টাকা দামের নিজের নামলেখা স্যুট নিয়ে, তাঁর স্টাইলবাজি নিয়ে বিরোধীদের কণ্ঠভরা বিষ। আরে, ওরা যে টুকরা টুকরা গ্যাংএর সদস্য। গত চার বছরে ফকিরের বিজ্ঞাপন ব্যয় মাত্র ৪৪০০ কোটি টাকা। রেঞ্জ রোভার, বুলেটপ্রুফ বি এম ডব্লু সেডান, বোয়িং ৭৪৭-এ তাঁকে দেশে-বিদেশ ঘুরে বেড়াতে হয়। তিনি তো আর বেড়াতে যান না, যান ভারতের ডঙ্কা বাজাতে। তাঁর জন্যই ভারত আজ বিশ্বগুরু। ভারতের সঙ্গে সঙ্গে তিনিও বিশ্বগুরু। তাই তো আকাশচুন্বি তাঁর বিদেশযাত্রার ব্যয়। আরে বাবা, আয় করতে হলে ব্যয় করতে হবেই। আয়? কেন নয়? ফকির নরেন্দ্র মোদি ভারতের আধ্যাত্মিক মহিমা ছড়িয়ে দিয়েছেন বিশ্বময়। এবার আপনি বলবেন সাধু বা ফকির যদি হন নরেন্দ্র মোদি, তাহলে কোথায় তাঁর সহিষ্ণুতা। বুঝতে পারছি আপনি গীতা পড়েন নি, পড়লেও বুঝতে পারেন নি ঠিক ঠিক করে। গীতায় ভগবান বলেছেন সম্ভবামি যুগে যুগের তত্ত্বকথা। পাপীর বিনাশের জন্য যুগে যুগে জন্মগ্রহণ করেন ভগবান। এ যুগে সেই ভগবান ফকির নরেন্দ্র মোদি। আরবান নকশাল, মুসলমান-খ্রিস্টান, দেশদ্রোহীদের বিনাশ চান তিনি। এরা সব বির্ধমী। এরা তাঁর মতো ভগবানের বিরুদ্ধে আঙুল তুলেছে। চিৎকার করে বলছে : মোদির আমলে অর্থনীতি গেল, দেশের সংখ্যালঘুরা গেল, বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য গেল, গণতন্ত্র গেল, মানবাধিকার গেল ………………….
ভগবানের অবতার, ফকির নরেন্দ্র মোদি এবার তাই বিধর্মীদের দমন শুরু করেছেন। তাঁর হাতে দুটি পাশুপত অস্ত্র আছে ---ইডি আর সিবিআই ;। এই দুই অস্ত্র দিয়ে তিনি দেশের শত্রুদের জেলে ঢুকিয়েছেন, মুখ বন্ধ করার আয়োজন করেছেন ।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct