ইসরায়েল রাজনৈতিকভাবে ফিলিস্তিনকে বিশ্বের মানচিত্র থেকে মুছে দিতে চায়। যুক্তরাষ্ট্র তাদের নানাভাবে পৃষ্ঠপোষকতা ও সহায়তা করছে। কিন্তু ফিলিস্তিনি জনগণ তাঁদের ভূখণ্ড রক্ষায় কখনো পিছু হটবেন না। একদিন এই ঔপনিবেশিক শক্তিকে তাঁরা পরাভূত করবেন। লিখেছেন এম মুহান্নাদ আয়াশ।
যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা আর পৃষ্ঠপোষকতায় কয়েক দশক ধরে ইসরায়েল রাজনৈতিকভাবে ফিলিস্তিনকে বিশ্বের মানচিত্র থেকে মুছে দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে। কয়েক দিন ধরে ফিলিস্তিনিরা আরেকবার প্রমাণ করেছেন, এত সহজে তাঁরা নিজেদের ভূখণ্ড এবং সার্বভৌমত্বের দাবি থেকে সরে আসবেন না। এ ভূখণ্ড তাঁদের থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। আমি অবশ্য এখানে ‘সার্বভৌমত্ব’ বলতে ইউরোপ–আমেরিকার অর্থে ‘একটি ভূখণ্ড শাসনের কর্তৃপক্ষ’ বোঝাচ্ছি না। আমি এখানে এমন এক কর্তৃপক্ষের কথা বলছি, যার শিকড় অনেক গভীরে। জনগণ ও তাদের পিতৃপুরুষের ভূমির সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক অহিতকর। এ সম্পর্ক সব ধরনের রাজনৈতিক মানদণ্ডে অর্থহীন।
ফিলিস্তিনি জনগণ ও ফিলিস্তিনের মধ্যকার এই গভীর সম্পর্ককে ইসরায়েল নামের রাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে মুছে দিতে চাচ্ছে।
সম্প্রতি ইসরায়েলের সঙ্গে আরব রাষ্ট্রগুলো বিশেষ করে সৌদি আরবের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এর মাধ্যমে মূলত ফিলিস্তিনকে মুছে দেওয়ার প্রক্রিয়াকে জোরালো করার চেষ্টা করা হচ্ছিল। এই সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রতিটি পদক্ষেপের মাধ্যমে শীর্ষ কূটনীতিক ও রাজনীতিবিদসহ সারা বিশ্বের মানুষকে এই ধারণা দেওয়া হচ্ছিল যে মধ্যপ্রাচ্যে ফিলিস্তিন কোনো বিষয় নয়। এই অঞ্চলের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় ফিলিস্তিনি জনগণের আকাঙ্ক্ষা, তাঁদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের কোনো স্থান নেই।
বিশ্বনেতাদের দুয়ারে ফিলিস্তিনিরা
কয়েক দশক ধরে ফিলিস্তিনের জনগণ বিশ্ববাসীকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন, ইসরায়েল তাঁদের ওপর প্রতিদিন নির্যাতনের মতো অসহনীয় যন্ত্রণা জগদ্দল পাথরের মতো চাপিয়ে দিয়েছে। ফিলিস্তিনিরা সব হত্যাকাণ্ড, নির্যাতন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের রেকর্ড রেখেছেন। তাঁরা তাঁদের ছিনিয়ে নেওয়া বাড়ি, ভূমি ও গুরুত্বপূর্ণ সম্পদের তালিকা করে রেখেছে। ইসরায়েল রাষ্ট্রের সহিংসতা কীভাবে তাঁদের স্বাধীনতা ও মর্যাদার সঙ্গে বাঁচার অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে, আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে কীভাবে তাঁদের নিয়মিত হয়রানি ও নির্যাতন করা হচ্ছে—সেসব তাঁরা যত্নের সঙ্গে নথিবদ্ধ করে রেখেছেন।আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রভাবশালী সদস্যরা ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলের নিরন্তর নৃশংসতার প্রমাণ নিয়ে কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে? তারা এমনভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে যে তার চেয়ে বোধকরি চুপ থাকা অনেক উত্তম।এই প্রভাবশালীরা বারবার উচ্চকিত কণ্ঠে ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন জানিয়ে আসছে। তারা ইসরায়েলের ঔপনিবেশিক দমন–পীড়নে সহায়তা ও পৃষ্ঠপোষকতা করেছে। সত্যি বলতে কি—তারা ফিলিস্তিনিদের তাঁদের অবশিষ্ট ভূখণ্ড থেকে বের করে দিতে ইসরায়েলকে উৎসাহিত করছে। একই সঙ্গে তারা ইতিহাস ও বৈশ্বিক রাজনীতি থেকে ফিলিস্তিনিদের মুছে দিতে উৎসাহ দিচ্ছে। ফিলিস্তিনিরা বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে কূটনীতি, রাজনৈতিক ওকালতি এবং সব ধরনের সশস্ত্র–নিরস্ত্র প্রতিরোধ ও প্রতিবাদের চেষ্টা করেছেন। তাঁরা দিনের পর দিন তাঁদের সমস্যা নিয়ে অসংখ্য বিশ্বনেতার কাছে গেছেন, কথা বলেছেন। কিন্তু হায়! তাঁদের অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি; বরং তাঁদের অবস্থার আরও অবনতি হয়েছে। ইসরায়েল যখনই ফিলিস্তিন ও ফিলিস্তিনি জনগণকে আরব ও বৈশ্বিক দৃশ্যপট থেকে মুছে দিতে উদ্যোগ নিয়েছে, তখনই ফিলিস্তিনিরা এক ক্রান্তিকালে গিয়ে ঠেকেছেন। তবু ফিলিস্তিনিরা উন্মুক্ত কারাগারে বন্দী থেকেও ইসরায়েলের আইনকানুন মেনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে তাঁদের বিষয় নিয়ে আবেদন–নিবেদন করে গেছেন। তাঁরা আশা করছিলেন, কেউ না কেউ মানবিক মন নিয়ে তাঁদের ওপর চলা নৃশংসতা ও অমানবিক বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে এগিয়ে আসবে।
ফিলিস্তিন উপেক্ষিত ইস্যু নয়
একটি বিষয় পরিষ্কার—ইসরায়েল ও তার রক্ষক আন্তর্জাতিক পরিসরে নেতৃত্বের আসনে বসে থাকা যুক্তরাষ্ট্র সংগঠিত রাষ্ট্রীয় সহিংসতার মাধ্যমে প্রভাব, ক্ষমতা ও নিরাপত্তা অর্জন করেছে। বতর্মান ব্যবস্থায় কোনো রাষ্ট্র কেবল উচ্চ আদর্শের কথা বলে নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মতো যথেষ্ট কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা অর্জন করতে পারবে না। বিশ্ব সম্প্রদায়কে নিজের মতো করে খবরদারি করতে পারবে না।ইসরায়েল সংগঠিত সহিংসতা চালিয়ে ফিলিস্তিনি জনগণের ওপর যেভাবে নির্যাতন চালাচ্ছে, সেটা ফিলিস্তিনিদের সংগ্রামকে যৌক্তিক করে তুলেছে। গাজা থেকে সম্প্রতি ইসরায়েলের ওপর হামলার অর্থ এই নয় যে অবিলম্বে ফিলিস্তিন স্বাধীন রাষ্ট্র হয়ে যাবে। এমনকি প্রতিরোধযোদ্ধারা যদি কথাটা বলেও থাকেন, সেটিকে আমলে নেওয়ার কোনো কারণ নেই; বরং বলা যায়, তাঁদের এই অভিযান এই সংগ্রামকে পরিবর্তন ও গতিশীল করার বার্তা দিয়েছে। যারা ফিলিস্তিনকে ‘হারিয়ে যাওয়া বিষয়’ বলে ভেবেছিল, সেই আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীকে তাঁরা কাঁপিয়ে দিতে চেয়েছেন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে তাঁরা বুঝিয়ে দিতে চেয়েছেন, ফিলিস্তিন ইস্যু কোনো উপেক্ষিত বা ভুলে যাওয়ার মতো বিষয় নয়। হামাসের এই অভিযান মনে করিয়ে দিয়েছে, ফিলিস্তিনি জনগণ টিকে আছেন। তাঁরা কখনোই স্বাধীন ও সার্বভৌম ভূখণ্ডে বসবাসের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম থেকে সরে যাবেন না। হামাসের এই অভিযান ফিলিস্তিনি জনগণের বর্তমান পরিস্থিতিকে বদলে দেবে না; বরং অনেক ক্ষেত্রে তাঁদের জন্য পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। এই অভিযানের কারণে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের আন্দোলন বা ফিলিস্তিনিদের অবস্থা খারাপ হচ্ছে না; বরং ইসরায়েল রাষ্ট্রের দিনকে দিন চলে আসা বর্বর পদক্ষেপ তাঁদের অবস্থাকে দিন দিন খারাপ করছে। কারণ, ইসরায়েলিরা আগে থেকেই বদ্ধপরিকর, যতই প্রতিরোধ আসুক ফিলিস্তিনকে মুছে দিয়ে তারা আনুষ্ঠানিকভাবে পুরো ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে ইসরায়েলি–ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করবে। অনানুষ্ঠানিকভাবে দীর্ঘদিন ধরে পুরো ফিলিস্তিন অঞ্চল তারা নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে। সুতরাং হ্যাঁ, ঔপনিবেশিক শক্তির কবলে পড়া ভূখণ্ডের মানুষ পরিষ্কারভাবে বুঝে গেছেন, তাঁরা সংগঠিত সহিংসতা করতে পারলেই কেবল তাঁদের অস্তিত্বের স্বীকৃতি মিলবে। অন্যথায় তাঁদের হত্যা করা হবে এবং যেকোনোভাবে হোক তাঁদের মুছে ফেলা হবে। বিশ্বের প্রভাবশালী বিভিন্ন দেশের সাংবাদিক, শিক্ষাবিদ ও রাজনীতিক যখন সহিংসতা বন্ধ ও শান্ত হওয়ার কথা বলেন, তখন আসলে তাঁরা ধীরে ধীরে, নৃশংসভাবে ফিলিস্তিনকে মুছে দেওয়ার কথা বলেন। এই বাস্তবতায়, শান্ত হওয়া বা সহিংসতা বন্ধের কোনো অবস্থা নেই। ঔপনিবেশিক শক্তি ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীদের দাসত্ব থেকে মুক্তির জন্য ফিলিস্তিনিদের সংগ্রামে বিরতি নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আমার অনুমান, ইসরায়েলি সরকার ও রাজনীতিবিদ এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ প্রভাবশালী দেশের বিশেষজ্ঞরা এখন পুরো ঘটনাকে নিরেট নিরাপত্তার দিক থেকে বিবেচনা করবেন। তাঁরা হামাসের হামলার জন্য গোয়েন্দা ব্যর্থতা ও অন্যান্য প্রযুক্তিগত নিরাপত্তা ব্যর্থতার ওপর জোর দেবেন। তাঁরা গাজা উপত্যকায় নৃশংস বোমাবর্ষণের পক্ষে যুক্তি দেখাবেন। তাঁরা ফিলিস্তিনিদের তাড়ানোর ওপর অব্যাহতভাবে জোর দিয়ে যাবেন। ফিলিস্তিনিদের আরও ভূমি ইসরায়েলের সঙ্গে যুক্ত করার এমনকি ফিলিস্তিনকে মুছে দেওয়ার কথা বলবেন। তবে এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূণ বিষয়টি হচ্ছে, ফিলিস্তিনিরা কখনোই মুছে যাবেন না। এই অঞ্চলের অধিকাংশ ও সারা বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ এই বিষয় উপলব্ধি করেছেন এবং তাঁরা ফিলিস্তিনিদের সংগ্রামের প্রতি সমর্থন জানাচ্ছেন। বিশ্বের এসব প্রভাবশালী দেশ যা–ই ভাবুক না কেন, ফিলিস্তিনি জনগণ তাঁদের মুছে দেওয়ার ষড়যন্ত্র প্রতিরোধ করে যাবেন। বিশ্বব্যাপী মানুষ ফিলিস্তিনের সংগ্রামের মধ্যে নিজেদের সংগ্রামকে দেখবেন। বিশ্ববাসী ফিলিস্তিনকে দেখবেন একটি রাজনৈতিক গল্প, রাজনৈতিক দর্শন, চলমান রাজনৈতিক অবস্থার বহিঃপ্রকাশ এবং ক্ষমতার ব্যবস্থা হিসেবে—যা কখনো বিশ্ববাসীর হৃদয় ও মন থেকে মুছে দেওয়া যাবে না। এটিই হবে সময়ের পরীক্ষা। ফিলিস্তিনের বৈপ্লবিক চেতনা ঔপনিবেশিক বিশ্বব্যবস্থার কাঠামোগত সহিংসতা ও অবিচারকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। স্বাধীনতা ও বিকল্প ব্যবস্থা সৃষ্টির জন্য যারা অনড় থাকছেন, তাঁরা একদিন প্রভাবশালী যেসব দেশ বর্তমানে বিশ্বকে শাসন করছে ও ফিলিস্তিনকে বিশ্বের মানচিত্র থেকে মুছে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করছে—তাদের পরাভূত করবেন।
আল–জাজিরায় প্রকাশিত, ইংরেজি থেকে অনুবাদ।
অধ্যাপক এম মুহান্নাদ আয়াশ কানাডার ক্যালগারির মাউন্ট রয়েল ইউনিভার্সিটির সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct