সানাম বাখিল : সরায়েলে হামাসের হামলা এবং এর জবাবে ইসরায়েলের সামরিক হামলার প্রভাব ছড়িয়েছে গোটা বিশ্বে। পশ্চিম তীর, জর্ডান ও মিসরের (গাজার সীমান্তবর্তী) ফিলিস্তিন, লেবাননের হিজবুল্লাহ, তাদের অভিভাবক ইরানসহ গোটা মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে কি না, তা নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ সহিংসতা উপসাগরীয় আরব দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাব্যবস্থায়ও চিড় ধরাতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা প্রশমন ও আপস মীমাংসায় যে অঞ্চলভিত্তিক উদ্যোগ, তার মধ্যেই আসলে যুদ্ধের সূত্রপাত হলো। ২০১৯ সাল থেকে ইসরায়েলও মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশগুলোর সঙ্গে ‘নতুন মধ্যপ্রাচ্য’ গঠনে একটা বাস্তবভিত্তিক মীমাংসা নিয়ে আলোচনায় যুক্ত হয়েছিল। এ আলোচনার অগ্রগতি যে ব্যাপক বা অগ্রগতি নিখুঁতভাবে এগোচ্ছিল, সে কথা হয়তো বলা যায় না। কিন্তু এবার ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধের প্রেক্ষাপট আলাদা। এমনকি ১০ বছর আগেও পরিস্থিতিএমন ছিল না। আঞ্চলিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে এ যুদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশকে কঠিন এক চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। কিন্তু এই প্রতিবন্ধকতাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া তাদের জন্য ঠিক হবে না। বরং যুদ্ধ নিরসনে নতুন কোনো উপায় খুঁজে বের করার উদ্যোগে সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ কাজে লাগাতে পারে তারা।
‘নতুন’ অঞ্চলে পুরোনো সমস্যা : ২০১৯ সাল থেকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো সমস্যা সমাধানে কূটনৈতিক আলোচনায় যুক্ত ছিল। এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমাবনতিশীল সম্পৃক্ততা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পটভূমিতে ভূরাজনৈতিক পরিবর্তন ও অর্থনৈতিক ইস্যুতে অগ্রাধিকারের বদলে দেশগুলোর মধ্যে আলোচনার প্রেক্ষাপট তৈরি করে। আব্রাহাম শান্তি চুক্তির আওতায় ইসরায়েল, বাহরাইন ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মধ্যে সম্পর্ক ক্রমেই স্বাভাবিক হতে থাকে। এ ছাড়া ২০২১ সালে কাতারের অবরোধ প্রত্যাহার, ২০২৩ সালে উপসাগরীয় অঞ্চলের সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্ক পুনর্বিন্যাস এবং চীনের মধ্যস্থতায় সৌদি আরব ও ইরানের সম্পর্ক পুনঃস্থাপন এই কূটনীতির অংশ। ইয়েমেনের সঙ্গে আপস আলোচনা চলছিল। দশকের পর দশক ধরে গৃহযুদ্ধ ও বহির্বিশ্বের উসকানিতে চলা যুদ্ধে বিপর্যস্ত সিরিয়ার বাশার-আল-আসাদও আবার পুনর্বাসিত হয়েছেন।কাতার ও ওমান পরোক্ষভাবে ওয়াশিংটন ও ইরানের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনে কাজ করেছে। ফলে যেসব মার্কিন নাগরিক ইরানে জিম্মি হয়ে ছিলেন, তাঁরা মুক্তি পান। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ইসরায়েল, সৌদি আরবের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ব্যাপারে কথাবার্তা চলছিল। নতুন করে যুদ্ধ শুরু হওয়ায় এ আলোচনা ভেস্তে গেছে।যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের ইউরোপীয় অংশীদারদের অনেকেই ধারণা করছিলেন যে এ অঞ্চলে উত্তেজনা কমে এসেছে। সপ্তাহ দুয়েক আগে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান বলেন, ‘এ অঞ্চলে এখনো উত্তেজনা আছে। তবে ৯/১১-এর পর এ অঞ্চল নিয়ে আমার পূর্বসূরিদের যে শ্রম ও সময় ব্যয় করতে হয়েছে, তা এখন অনেকটাই কমে এসেছে।’কয়েক দিন আগেও এখানে ছিল অনেক বহুতল ভবন। ইসরায়েলি বাহিনীর বোমা হামলায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে সেগুলো। গত মঙ্গলবার গাজা শহরেছবি: রয়টার্স
ভঙ্গুর পুনর্বিন্যাস : হামাসের এ যুদ্ধের পর বোঝা গেল, মধ্যপ্রাচ্যের পুনর্বিন্যাসপ্রক্রিয়া এগোচ্ছিল, কিন্তু এ উদ্যোগ টেকসই ছিল না। সমুদ্রসীমা নিয়ে ইরাক ও কুয়েতের মধ্যে নতুন করে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। সম্পর্ক স্বাভাবিক হলেও ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে বিশ্বাসের ঘাটতি আছে। যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা এ অঞ্চলে শূন্যের কোঠায়। বহিঃশক্তি কী করছে, তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে স্বাভাবিক সম্পর্ক স্থাপনে উদ্যোগ ও অর্থনীতিতে নতুন সুযোগের অনুসন্ধান—এ নিয়ে আলোচনা চললেও ইসরায়েল-ফিলিস্তিন এবং হামাস ও হিজবুল্লাহকে ইরানের সমর্থন ইস্যুতে কখনোই কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়নি।
মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিক্রিয়া : বিরোধের পরপরই এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে বিভক্তির বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে উঠেছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন হামাসের সমালোচনা করেছে। তারা দুই পক্ষের প্রাণহানিতে শোক প্রকাশ করেছে এবং সংলাপে উৎসাহ ও সমর্থন দিতে আগ্রহ দেখিয়েছে।গাজার সঙ্গে সীমান্ত থাকায় মিসরের পরিস্থিতি এখনই অস্থিতিশীল। তারা শান্তি এবং ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনে সমর্থন দেওয়ার কথা বলছে। সৌদি আরব ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি দখলদারির বিষয়টিকে সামনে এনেছে, পাশাপাশি উত্তেজনা পরিহারের আহ্বান জানিয়েছে। তারা জোর দিয়েছে বেসামরিক জনগণের জীবন রক্ষায়। কাতার, কুয়েত ও ওমান আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ এবং ফিলিস্তিনিদের অধিকার বঞ্চিত করায় সমালোচনা করেছে ইসরায়েলের। কিছু ইতিবাচক সম্ভাবনাও দেখা যায়। কাতার জিম্মি মুক্তির বিষয়ে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। মিসর পরিস্থিতির আরও অবনতি যেন না হয়, সে নিয়ে কাজ করছে। তুরস্ক সমঝোতায় বসানোর উদ্যোগ নিতে চায়। সাম্প্রতিক সময়ে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে তারা ঐক্যবদ্ধ ও বিশ্বাসযোগ্যভাবে এ অঞ্চলের উত্তেজনা নিরসনে যে অগ্রগতি করেছিল, তার ভিত্তিতে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর ভূমিকা রাখার এটাই সময়।
চ্যাটাম হাউসের ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct