ইয়াভিয়ার ব্লাস : তিহাস হুবহু ফিরে আসে না। তবে এমন অনেক ঘটনা ঘটতে দেখা যায়, যা সামনে আনে অতীত দৃশ্যপট। বলছি, ১৯৭৩ সালের বৈশ্বিক তেলসংকটের কথা। সেই তিক্ত অভিজ্ঞতার প্রসঙ্গ টানার কারণ, চলমান ইসরাইল-হামাস সংঘাত। বিশ্বের প্রথম তেলসংকটের অর্ধশতাব্দী পর আবারও সেই সংকট সৃষ্টির আশঙ্কা করা হচ্ছে বিভিন্ন মহল থেকে। সেবার ছিল অক্টোবর মাস, এবারও সেই অক্টোবর—ব্যবধান কেবল ১৯৭৩ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যবর্তী ৫০টি বছর। সেবার এক পক্ষে ছিল ইসরাইল; অন্যপক্ষে মিশর ও সিরিয়ার নেতৃত্বাধীন জোট। এবার অবশ্য চিত্র কিছুটা ভিন্ন। এবারের সংঘাত ফিলিস্তিনের মুক্তি আন্দোলনের যোদ্ধাদের সঙ্গে ইসরাইলের—গণমাধ্যমগুলোর খবর মারফত এখন পর্যন্ত জানা যাচ্ছে এমনটাই। যা হোক, ১৯৭৩ সালের ৬ থেকে ২৫ অক্টোবরের মধ্যে সংঘটিত আরব-ইসরাইল যুদ্ধের ফলে বৈশ্বিক তেলসংকট কতটা প্রকট আকার ধারণ করে, তার সাক্ষী গোটা বিশ্ব। গত শনিবার (৭ অক্টোবর) যখন হামাস যোদ্ধারা মাত্র মিনিট বিশেকের ব্যবধানেই ৫ হাজারের বেশি রকেট ছোড়ে ইসরাইল ভূখণ্ডে, তত্ক্ষণাত্ শুরু হয়ে যায় ঘোর শঙ্কা—৫০ বছর আগের সেই তেলসংকট ফিরে আসবে কি না! আসলেই, ইসরাইল-হামাস সংঘাতের সূত্র ধরে বিশ্ববাজারে তেলের মূল্যবৃদ্ধির আশঙ্কা অমূলক চিন্তা নয়। নিশ্চিত করে বলা কঠিন, বিশ্ব অর্থনীতি আবারও তেল নিষেধাজ্ঞার বড় শিকারে পরিণত হবে কি না। তেল অবরোধের কবলে পড়ে অপরিশোধিত তেলের (ক্রুড অয়েল) দাম কয়েক গুণ বেড়ে যাবে কি না—এমন দাবিকেও একেবারে ফেলে দেওয়া যাচ্ছে না। তবে চলমান ইসরাইল-হামাস সংঘাতের কারণে বিশ্বে তেলের দাম দীর্ঘ মেয়াদে বাড়ার আশঙ্কাকে এখন পর্যন্ত হালকা করেই দেখা উচিত। নিম্নলিখিত যুক্তির আলোকে এই দাবির সত্যতা দেখা যায়—প্রথমত, এবারের সংকট ১৯৭৩ সালের অক্টোবরের পুনরাবৃত্তি নয় কোনোভাবেই—যেমনটা বলা হয়েছে আগেই। আরব দেশগুলো ঐক্যবদ্ধভাবে ইসরাইলকে আক্রমণ করেনি। মূল ঝামেলা হামাসের সঙ্গে ইসরাইলের। বলা যায়, মিশর, জর্ডান, সিরিয়া, সৌদি আরবসহ অনান্য আরব দেশ এই সংকট পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে সাইডলাইনের বাইরে থেকে। এমনকি এ নিয়ে এখন অবধি সরাসরি কোনো প্রতিক্রিয়াও আসেনি আরব রাষ্ট্রগুলোর পক্ষ থেকে। অর্থাত্, চলমান সংকটে আরব দেশগুলোর জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা কম বিধায় তেলসংকট সৃষ্টির বিষয়কে বড় করে দেখার কিছু নেই।দ্বিতীয়ত, বর্তমানে তেলের বাজারের অবস্থা এমন নয়, যাতে করে ১৯৭৩ সালের অক্টোবরের আগেকার চিত্রের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। তখনকার সময়ে তেলের চাহিদা বাড়ছিল ক্রমাগতভাবে। তাছাড়া দেশগুলোর অতিরিক্ত তেল উত্পাদনক্ষমতাও প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল। পক্ষান্তরে, বর্তমানে তেল ব্যবহারে সাশ্রয়ী হতে দেখা যাচ্ছে অনেক ক্ষেত্রে। বৈদ্যুতিক যানবাহনের ব্যবহারও বাড়ছে। এসব কারণে তেলের সংকট পরিস্থিতি সৃষ্টি হলেও তা এড়ানো যাবে সহজেই। আরেকটি বিষয়, সাম্প্রতিককালে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের তেল উত্পাদনের বাড়তি সক্ষমতা রয়েছে, যার ফলে তেলের দাম তেমন একটা বাড়ার আশঙ্কা কম।তৃতীয়ত, বর্তমান সময়ে দেখা যাচ্ছে, মাত্রাতিরিক্ত দাম বাড়ানোর পথ পরিহার করে চলেছে ওপেকভুক্ত দেশগুলো। এ অবস্থায় তেলের দাম বড়জোর ১০ থেকে ২০ শতাংশ বাড়িয়েই তৃপ্ত থাকবে তারা। পেছনে ফিরে তাকালে দেখা যাবে, ১৯৭৩ সালের অক্টোবরে তেল নিষেধাজ্ঞার ঠিক আগে ওপেক দেশগুলো পেট্রোলিয়ামের দাম বাড়িয়ে দিয়েছিল অনেকটা একতরফাভাবে। সে সময় প্রায় ৭০ শতাংশ পর্যন্ত দাম বাড়িয়েছিল দেশগুলো।চতুর্থত, খুব ভালোভাবে দৃষ্টি দেওয়া দরকার, মধ্যপ্রাচ্যে যদি কোনোভাবে তেলের সংকট শুরু হয়, তাহলে তা থেকে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে রাশিয়া। কেননা, বিশ্ববাজারে তেল সরবরাহ আটকে গেলে যেকোনোভাবেই হোক রাশিয়ার তেল বিশ্ববাজারে ঢুকবে বেশি পরিমাণে। এর ফলে তেল বিক্রির টাকায় ফুলেফেঁপে উঠবে ইউক্রেনে যুদ্ধরত মস্কো। যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চয় এমনটা চাইবে না! দ্বিতীয় বিষয় হলো, এতে করে লাভবান হবে ভেনেজুয়েলাও। এটাও নিশ্চিয় চাইবে না হোয়াইট হাউস। সুতরাং, তেল সরবরাহ বিঘ্নিত হওয়া তথা তেলসংকটের সূত্রপাতের আশঙ্কার চিন্তা করার কোনো মানে নেই।
পঞ্চমত, তেলের সংকট সৃষ্টির পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে ‘সৌদি-ইসরাইল কূটনৈতিক চুক্তি’ ইস্যু। তাছাড়া হামাস-ইসরাইল সংঘাতের আরেক শিকার হচ্ছে ‘সৌদি-ইরান সমঝোতা’। এসব ইস্যু বিশ্লেষণে তেলের সংকট সৃষ্টির আশঙ্কা নেই বললেই চলে।যাহোক, অনেকে হয়তো প্রশ্ন তুলতে চাইবেন, তেলের দাম যে বাড়বে না, তথা তেলের সংকট সৃষ্টি হবে না—এমনটা কি একেবারে নিশ্চিত করে বলা যায়? অবশ্যই এটা নিশ্চিত করে বলা কঠিন। এর কারণ, আজকের বিশ্বে তেলের বাজারের উত্থান-পতন নিয়মিত দৃশ্য! এই অর্থে সংকটের মুখে আসছে বছর তেলের বাজারে প্রভাব পড়ার আশঙ্কাকে উড়িয়ে দেওয়া ঠিক হবে না। সবচেয়ে বড় কথা, জ্বালানি সরবরাহের ক্ষেত্রে তাত্ক্ষণিক প্রভাব অনুভূত হতে পারে—যদি ইসরাইল এমন সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, হামাস হামলা চালিয়েছে তেহরানের নির্দেশে। সেক্ষেত্রে তেলের দাম বেড়ে যাবে অনেক বেশি।উল্লেখ করতে হয়, ২০২২ সালের শেষের দিক থেকে ওয়াশিংটনের বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে তেল রপ্তানি বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছে ইরান। এর ফলে ইরানের তেলের উত্পাদন বেড়েছে কয়েক গুণ। চলতি বছর দৈনিক প্রায় ৭ লাখ ব্যারেল অতিরিক্ত তেল উত্পাদন করছে তেহরান। এই ক্রমবর্ধমান সরবরাহ ইরানকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তেল উত্পাদন উেস পরিণত করেছে। অর্থাত্, হামাসের হামলার জন্য ইরানকে দায়ী করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলেও তাতে তেহরানের তেল উত্পাদন বন্ধ করানো যাবে কি না, তা ভেবে দেখার বিষয়! বৈশ্বিক বাস্তবতায় এ কথা মানতে হবে, ইসরাইল-হামাস সংঘাতের কারণে তেলসংকট সৃষ্টির কোনো আশঙ্কা নেই—এমন যুক্তিতে শতভাগ আস্থা রাখাটা ঠিক না-ও হতে পারে। কারণ, গণমাধ্যমগুলোতে প্রকাশিত সর্বশেষ খবর বলছে, বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম বাড়তির দিকে। ইসরাইল-হামাস সংঘাতের পর সোমবার (৯ অক্টোবর) সকাল থেকে বিশ্ববাজারে বাড়তে শুরু করে তেলের দাম। জানা যাচ্ছে, অপরিশোধিত তেল ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ব্যারেলপ্রতি ৪ দশমিক ১৮ ডলার বা ৪ দশমিক ৯৪ শতাংশ বেড়েছে। সেই সঙ্গে ইউএস টেক্সাস ইটারমিডিয়েট ক্রুড বা ডব্লিউটিআই ক্রুডের দাম বেড়েছে ব্যারেলপ্রতি ৪ দশমিক ২৩ ডলার বা ৫ দশমিক ১১ শতাংশ।জানিয়ে রাখা দরকার, চলতি বছরের জুন মাসের পর তেলের দাম বাড়তে শুরু করে। একপর্যায়ে তা ব্যারেলপ্রতি ৯৫ ডলারে উঠে যায়। তবে এরপর দাম ধীরে ধীরে কমতে কমতে একপর্যায়ে ব্যারেলপ্রতি ৮৪ ডলারে নেমে যায়। গত সপ্তাহেও তেলের দাম ছিল কমতির দিকেই। সেখান থেকে হামাস-ইসরাইল সংঘাতের কারণে হঠাত্ করেই মূল্যবৃদ্ধি কমার ধারায় ছেদ পড়ল।এই যখন অবস্থা, তখন বিশ্লেষকেরা বলছেন, মধ্যপ্রাচ্যে ভূরাজনৈতিক ঝুঁকি যত বাড়বে, জ্বালানি তেলের দামও বাড়বে তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে। উপরন্তু, সৌদি আরব ও ইসরাইলের মধ্যে সম্পর্ক পুনঃস্থাপনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে দূতিয়ালি করছে, এই সহিংসতার জেরে সেই প্রচেষ্টা ভেস্তে গেলে তার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়বে তেলের বাজারে। সব মিলিয়ে তেলসংকট সৃষ্টির আশঙ্কাও একেবারে কম নয়!জানা যাচ্ছে, ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যে এই হামলার পেছনে ইরানের সম্পৃক্ততার দিকে আঙুল তুলেছে। শেষ পর্যন্ত এটাই যদি চূড়ান্ত হিসাব ধরে নেয় ইসরাইল, তাহলে ইরানের ওপর চাপ বাড়বে স্বভাবতই, যার সরাসরি প্রভাব পড়বে তেহরানের তেল সরবরাহের ওপর। এমন চিন্তা থেকে কোনো কোনো বিশ্লেষক মনে করছেন, দীর্ঘ মেয়াদে তেল উত্পাদন ও সরবরাহ থমকে গেলে তা অবধারিতভাবে অস্থির করে তুলবে তেলের বাজারকে।
ব্লুমবার্গ থেকে অনুবাদ:
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct