ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু দিন দশক ধরে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে জুজুবুড়ির ভয়ের কথা বলে আসছেন। অসংখ্যবার তিনি ইরানে হামলার হুমকি দিয়েছেন। সর্বশেষ গত সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে তিনি বলেন, তেহরানকে অবশ্যই ‘বিশ্বাসযোগ্য পারমাণবিক হুমকির’ মুখোমুখি হতে হবে। অবশ্য তাঁর কার্যালয় পরে সংশোধন করে বলে, ‘বিশ্বাসযোগ্য সামরিক হুমকি’। ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সম্ভবত তাঁর সেই হুমকির বাস্তবরূপ দেখতে পাচ্ছেন। দক্ষিণ ইসরায়েলে হামলার ভয়াবহ সেই দৃশ্যপট আরও বড় সংঘাতে জড়ানোর জন্য ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীকে প্রয়োজনীয় প্রেক্ষাপট ও আন্তর্জাতিক সমর্থন জোগাচ্ছে। লিখেছেন মারওয়ান বিশারা।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু দিন দশক ধরে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে জুজুবুড়ির ভয়ের কথা বলে আসছেন। অসংখ্যবার তিনি ইরানে হামলার হুমকি দিয়েছেন। সর্বশেষ গত সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে তিনি বলেন, তেহরানকে অবশ্যই ‘বিশ্বাসযোগ্য পারমাণবিক হুমকির’ মুখোমুখি হতে হবে। অবশ্য তাঁর কার্যালয় পরে সংশোধন করে বলে, ‘বিশ্বাসযোগ্য সামরিক হুমকি’।
৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সম্ভবত তাঁর সেই হুমকির বাস্তবরূপ দেখতে পাচ্ছেন। দক্ষিণ ইসরায়েলে হামলার ভয়াবহ সেই দৃশ্যপট আরও বড় সংঘাতে জড়ানোর জন্য ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীকে প্রয়োজনীয় প্রেক্ষাপট ও আন্তর্জাতিক সমর্থন জোগাচ্ছে।
এ সবকিছুর মধ্যে নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত—দুই ধরনের বাজিই রয়েছে। একটা আঞ্চলিক সংঘাতই কেবল হামাসের হামলা ঠেকাতে পুরোপুরি ব্যর্থ হওয়ায় জবাবদিহির মুখে পড়ার হাত থেকে নেতানিয়াহুকে রক্ষা করতে পারে এবং তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির যে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে, তার বিচার অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য বন্ধ করে রাখতে পারবে।
একজন ব্যর্থ ও বিরোধীদের তোপের মুখে থাকা প্রধানমন্ত্রী থেকে রাতারাতি নেতানিয়াহু যুদ্ধকালীন নেতাতে পরিণত হয়েছেন। বিরোধী দলগুলো তাঁকে একটি জাতীয় ঐকমত্যের সরকার গঠনের আওয়াজ তুলছেন।
নেতানিয়াহু যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন এবং হামাসের শক্ত ঘাঁটি গাজায় প্রতিশোধ নেওয়ার আদেশ দিয়েছেন। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী মাত্রাতিরিক্ত জনবহুল গাজা উপত্যকায় ভয়ংকর বিমান হামলা শুরু করেছে। পাঁচ শতাধিক ফিলিস্তিন নিহত হয়েছেন। ইসরায়েলি বাহিনী বড় ধরনের স্থল আগ্রাসনের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
যুদ্ধের পরবর্তী ধাপ কী হবে, সেটা বিস্তারিত করেননি নেতানিয়াহু। কিন্তু ‘ইসরায়েলকে রক্ষায়’ তিনি যা করছেন এবং যা করবেন, তার প্রতি পশ্চিমা সরকারগুলোর শর্তহীন সমর্থন থাকবে। এই সমর্থন দেওয়ার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রশাসন অনেকটাই এগিয়ে রয়েছে। ইসরায়েলকে তারা আরও অস্ত্র ও গোলাবারুদ দিচ্ছে। পূর্ব ভূমধ্যসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে আধুনিক ও সবচেয়ে চৌকস বিমানবাহী রণতরী ফোর্ড এবং আরও কয়েকটি যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করার ঘোষণা দিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন ঘাঁটিগুলোতে শক্তি বৃদ্ধির ঘোষণা দিয়েছে। এ সবকিছুই একটা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু করার জন্য যথেষ্ট।
বাইডেনের এই উত্তেজনাপূর্ণ সমরসজ্জার উদ্দেশ্য কী? বলা হচ্ছে, কৌশলগতভাবে বাধা দেওয়ার অভিপ্রায় থেকে বাইডেন এটা করেছেন। এর অর্থ হচ্ছে, ‘ইসরায়েলের কোনো শত্রু যেন বর্তমান পরিস্থিতিতে কোনো সুযোগ খুঁজতে না পারে।’ কিন্তু ঐতিহাসিক সত্য হচ্ছে, ইসরায়েল কখনো তাদের ভূখণ্ডে কোনো বিদেশি পা ফেলুক, সেটা মেনে নেয় না। হামাসকে ধরার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধজাহাজের প্রয়োজন নেই ইসরায়েলের।
বাইডেনের এই সমরসজ্জার পেছনে রাজনৈতিক কারণও আছে। ইসরায়েলের ঘটনাবলি থেকে ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান পার্টি যেন কোনো ফায়দা তুলতে না পারে, সেটা নিশ্চিত করতে চান বাইডেন। এরই মধ্যে রিপাবলিকানরা বলতে শুরু করেছেন, হামাসের হামলার সঙ্গে সম্প্রতি বাইডেন ৬ বিলিয়ন ডলার ছাড়ের বিনিময়ে ইরানের সঙ্গে যে বন্দী মুক্তি চুক্তি করেছেন, তার ঘটনার সংযোগ আছে।
কিন্তু নেতানিয়াহু এবং তাঁর ধর্মান্ধ মন্ত্রীদের মনে পুরোপুরি ভিন্ন কিছু থাকতে পারে। ইরানকে পেঁচিয়ে আরও বড় পরিসরে যুদ্ধ বাধানোর সুযোগ খুঁজতে চেষ্টা করতে পারেন তাঁরা।
নেতানিয়াহু এরই মধ্যে হামাসের হামলায় সমর্থন জোগানো ও নির্দেশনা দেওয়ার অভিযোগ তুলেছে ইরানের বিরুদ্ধে। ফিলিস্তিনিদের আগের সব হামলার ক্ষেত্রেও ইসরায়েল সেটা করেছে। ইসরায়েলি সমর্থক ও নব্যরক্ষণশীলেরা এবং একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের গণমাধ্যমের বিশ্লেষকেরা এই হামলায় ইরানের সম্পৃক্ততা আছে বলে প্রচার শুরু করেছেন।
একজন বেনামা স্থানীয় সূত্রের সাক্ষাৎকারের বরাতে দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল খবর প্রকাশ করেছে যে ইরানি কর্মকর্তা ও ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ডসের সেনারা কয়েক সপ্তাহ ধরে এই হামলার পরিকল্পনার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, হামাসের হামলায় তেহরানের সম্পৃক্ততার এখন পর্যন্ত কোনো তথ্য-প্রমাণ তাঁরা পাননি।
ইরানের দিক থেকে হামাসের হামলাকে ফিলিস্তিনিদের আত্মরক্ষার স্বতঃস্ফূর্ত পদক্ষেপ হিসেবে বর্ণনা করেছে। কিন্তু ইসরায়েলের দুর্ভাগ্য, এ উচ্ছ্বাস ঢেকে রাখার কোনো চেষ্টা তারা করেনি। ইরান মনে করে, এই হামলা আরবের (সৌদি আরব) সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার উদ্যোগে বাধা তৈরি করবে এবং ঘটনা চক্রে সেটা ভেস্তে যাবে।
এরই মধ্যে ইরানের মিত্র লেবাননের হিজবুল্লাহ হামাসের অভিযানের প্রশংসা করেছে। তারা ইসরায়েলের অধিকৃত শেবা ফার্মস অঞ্চলে ইসরায়েলি বাহিনীর সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত হয়েছে এবং হুমকি দিয়েছে ইসরায়েল যদি গাজাতে প্রবেশ করে, তাহলে তারা বড় ধরনের সংঘাতে জড়িয়ে পড়বে।
ইরান ও তার মিত্রদের হঠকারিতা বিপদ ডেকে আনতে পারে। ইসরায়েলের ঔদ্ধত্য যেমন তাদেরকে হামাস যোদ্ধাদের হাতে চূড়ান্ত পর্যুদস্ত হওয়ার ক্ষেত্র তৈরি করেছে। ইরান কিংবা ইসরায়েল—কেউই ইতিহাস থেকে শেখেনি। তারা তাদের প্রক্সি সংঘাত অব্যাহত রেখেছে। যেটা একটি যুদ্ধের দিকে চলে যাচ্ছে।
অনেক বছর ধরে ইসরায়েলের সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিতে অন্তর্ঘাত চালিয়ে আসছে। তারা বিদেশে ইরানের সম্পদকে লক্ষ্যবস্তু বানায়। অন্যদিকে ইরান মধ্যপ্রাচ্যে তাদের অনুগত বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীকে সমর্থন দেয়। এসব গোষ্ঠী যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের মিত্রদের ওপর হামলা চালায়।
যতই তর্জন-গর্জন করুক এবং বাহাদুরি দেখাক– যুক্তরাষ্ট্রের সবুজ সংকেত ও সমর্থন ছাড়া নেতানিয়াহু ইরানে হামলা করতে পারবেন না এবং করবেন না। কিন্তু বাইডেন প্রশাসনকে ছলে এই যুদ্ধে টেনে আনতে পারলে তা হবে নেতানিয়াহুর জন্য হবে গেম চেঞ্জার। ইরানকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার তাঁর যে আকাঙ্ক্ষা, সেটাকে বাস্তবরূপ দেওয়ার একেবারে মোক্ষম সুযোগ পাবেন তিনি।
২০২১ সালে আফগানিস্তান থেকে পর্যুদস্ত হয়ে সেনা প্রত্যাহারের পর ‘অনন্ত যুদ্ধ’ বন্ধের কথা চিন্তা করেছিলেন বাইডেন। ইরানের সঙ্গে ইসরায়েল যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে সেটা হবে না। ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন শুরুর পর বাইডেন প্রশাসন চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের পরাশক্তির প্রতিযোগিতার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে।
কিন্তু বাস্তবতা হলো, মধ্যপ্রাচ্য থেকে যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয়নি। বাইডেন নিজে চীন, রাশিয়া অথবা ইরানের কাছে মধ্যপ্রাচ্যকে ছেড়ে দিয়ে শূন্য হাতে ফিরে আসতে চান না।
হামাসের হামলায় তেহরানের ভূমিকা আছে, এ কথা বলে হামাসের কাছে বন্দী ইসরায়েলিদের মুক্তির ব্যাপারে চাপ তৈরি করতে চাইবে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল। বন্দীদের মুক্ত করে আনাই এখন নেতানিয়াহুর সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার।
ইরান যদি এ ক্ষেত্রে অস্বীকৃতি জানায় এবং হিজবুল্লাহকে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে শুরু করে, তাহলে বড় সংঘাতের ক্ষেত্র তৈরি হবে। নেতানিয়াহু ইরানের সঙ্গে যুদ্ধ বাধাতে যুক্তরাষ্ট্রকে টেনে আনার ছক কষছেন। দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হচ্ছে, ওয়াশিংটনের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে যতই বিরোধ থাকুক না কেন, ইসরায়েল প্রশ্নে রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট—দুই শিবিরেই শর্তহীন সমর্থন রয়েছে।
এটা স্মরণ করা গুরুত্বপূর্ণ যে ২০০৩ সালে ইরাক আগ্রাসন শুরুর আগের বাস্তবতা থেকে ২০২৩ সালের বাস্তবতা অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং ও জটিল। ২০০৩ সালের আগ্রাসন যুক্তরাষ্ট্র ও ইরাক দুই পক্ষের জন্যই ছিল ভয়াবহ। ইরানের বিরুদ্ধে সে ধরনের কোনো পুনরাবৃত্তি সবদিক বিবেচনায় হবে আরও শোচনীয়।
আল-জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত
মারওয়ান বিশারা আল-জাজিরার বরিষ্ঠ রাজনৈতিক বিশ্লেষক
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct