ফিলিস্তিনের মুক্তি সংস্থা হামাস যোদ্ধারা হামলা চালিয়েছে ইসরাইলে। ইসরাইলের দিকে একের পর এক ছোড়া রকেটের গোলায় কমপক্ষে ২২ ইসরাইলি নিহত এবং ২৫০ জনের বেশি আহত হয়েছে। হামাসের দাবি, ইসরাইলি দখলদারির বিরুদ্ধে নতুন অভিযানের অংশ হিসেবে মিনিট বিশেকের ব্যবধানেই ৫ হাজারের বেশি রকেট ছোড়া হয়। হামলার পর ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এক বিবৃতিতে উচ্চারণ করেন, ‘শত্রুদের এই হামলার জন্য এমন চড়া মূল্য দিতে হবে, যা তারা কল্পনাও করতে পারবে না।’ লিখেছেন ডেভিড হোরোভিটজ।
ফিলিস্তিনের ইসলামপন্থি হামাস যোদ্ধারা হামলা চালিয়েছে ইসরাইলে। ইসরাইলের দিকে একের পর এক ছোড়া রকেটের গোলায় কমপক্ষে ২২ ইসরাইলি নিহত এবং ২৫০ জনের বেশি আহত হয়েছে। হামাসের দাবি, ইসরাইলি দখলদারির বিরুদ্ধে নতুন অভিযানের অংশ হিসেবে মিনিট বিশেকের ব্যবধানেই ৫ হাজারের বেশি রকেট ছোড়া হয়। হামলার পর ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এক বিবৃতিতে উচ্চারণ করেন, ‘শত্রুদের এই হামলার জন্য এমন চড়া মূল্য দিতে হবে, যা তারা কল্পনাও করতে পারবে না।’ নেতানিয়াহু শেষ করেছেন এভাবে, ‘আমরা যুদ্ধের মধ্যে রয়েছি। আর এই যুদ্ধে জিতব আমরাই।’ বলা বাহুল্য, হামাসের হামলা ও ইসরাইলের তরফ থেকে এ ধরনের প্রতিক্রিয়ার পর পরিস্থিতি কী হতে পারে, সে সম্পর্কে কমবেশি ধারণা রয়েছে সবার!
একটা বিষয়ে বিশেষভাবে নজর দেওয়া দরকার। হামাসের এই হামলা স্মরণ করিয়ে দিল ৫০ বছরের আগের এক ঘটনাকে। ১৯৭৩ সালের ৬ অক্টোবর মিশর ও সিরিয়ার নেতৃত্বাধীন জোট অভিযান চালায় ইসরাইলে। ঐ সংঘাত ১৯৭৩ আরব-ইসরায়েলি যুদ্ধ, অক্টোবর যুদ্ধ, রমজান যুদ্ধ, ইয়ম কিপ্পুর যুদ্ধ ইত্যাদি নামে অবিহিত। ১৯৭৩ সালের ৬ থেকে ২৫ অক্টোবরের মধ্যে সংঘটিত আরব-ইসরাইল যুদ্ধের ফলে উভয় পক্ষের সম্পর্ক কতটা তিক্ত হয়ে ওঠে, পেছনে ফিরে তাকালেই তার বহু প্রমাণ মিলবে। এই অর্থে বলতে হয়, অর্ধশতাব্দী পর আবারও ইসরাইলের ভূখণ্ডে ‘নতুন অভিযান’ চালানোর মধ্য দিয়ে বিশ্ব নতুন করে কী দেখবে, তা-ই চিন্তার বিষয়!
ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাতের ফলে যে ছোটখাটো কিছু ঘটবে না, তা সহজেই অনুমেয়। উদ্বেগের বড় বিষয় এটাই। এই লেখা পর্যন্ত পালটা হামলা চালিয়েছে ইসরাইল। জানা গেছে, গাজায় হামলা শুরু করেছে ইসরাইলি বাহিনী। ফিলিস্তিন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, ইসরাইলি বাহিনীর হামলায় একজন নিহত এবং আহত হয়েছেন বেশ কয়েক জন। অর্থাত্, ইসরাইল-ফিলিস্তিন নতুন সংঘাতের দামামা বাজতে শুরু করেছে, বলতে হবে!
লক্ষ করার বিষয়, যে গাজা থেকে সেনাবহর এসে হামলা চালিয়েছে ইসরাইলে, ঘণ্টা কয়েকের ব্যবধানেই সেই গাজা পালটা আঘাতের শিকার হয়েছে। অর্থাত্, উভয় পক্ষই কতটা মারমুখী, তা বোঝা যাচ্ছে পরিষ্কারভাবে। ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাতের চিরচেনা রূপ এটাই।
ঠিক কী এমন ঘটল, যার কারণে ইসরাইলে অকস্মাত্ হামলা চালিয়ে বসল হামাস—এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য কিছু জানা যায়নি। যদিও হামাসের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ‘আল-আকসা ফ্লাড’ নামে নতুন লড়াই শুরু করেছে তারা। ফিলিস্তিনের মুক্তি আন্দোলনের সশস্ত্র এই গোষ্ঠীর দাবি, দখলদার ইসরাইলি বাহিনীকে বিতাড়িত করাই তাদের একমাত্র লক্ষ্য। এবং এ উদ্দেশ্য থেকেই অকস্মাত্ আক্রমণের পথ বেছে নিয়েছে তারা।
একটু পেছনে ফিরে দেখা যাক। ইসরাইল ও ফিলিস্তিনি কর্মকর্তাদের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর এখন পর্যন্ত ইসরাইল-ফিলিস্তিনের পালটাপালটি হামলায় কমপক্ষে ২৪৭ ফিলিস্তিনি, ৩২ ইসরাইলি এবং দুই জন বিদেশি নিহত হয়েছেন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন বেসামরিক নাগরিকও। তাছাড়া উভয় পক্ষের সংঘর্ষে আহত হয়েছেন বহু মানুষ। এই চিত্র কি কম উদ্বেগজনক?
এবারের ‘আল-আকসা ফ্লাড’ অপারেশনের পর হামাসের প্রকাশ করা এক ভিডিও দৃষ্টি কেড়েছে অনেকের। ঐ ভিডিওতে হামাস যোদ্ধাদের হাতে তিন ব্যক্তিকে আটক থাকতে দেখা যায়। প্রকাশিত ভিডিওটি শুরু হয়েছে একটি বাক্য দিয়ে, যাতে বলা হয়, ‘আল-আকসা ফ্লাড’ নামে হামাসের লড়াইয়ে আল-কাসেম ব্রিগেডের হাতে শত্রুপক্ষের বেশ কয়েক জন সেনার আটক হওয়ার দৃশ্য এটা। অনেকে প্রথম দিকে মনে করেছিলেন, এটা নিছক সাজানো। কিন্তু ভালোমতো লক্ষ করে দেখা যায়, ভিডিওতে হিব্রু ভাষায় বিভিন্ন লেখায় পরিষ্কার হয়, ভিডিওচিত্র ধারণ করা হয়েছে ‘ইরেজ ক্রসিং’ এলাকায়, যা ইসরাইলি অংশ হিসেবে পরিচিত। এই ক্রসিং দিয়ে হামাসনিয়ন্ত্রিত গাজা উপত্যকা ও ইসরাইলের মধ্যে যাতায়াত করা হয়। যা হোক, হামাসের হাতে ইসরাইলি সেনা কিংবা ট্যাংক আটক হওয়ার ঘটনা ভালো কিছু বয়ে আনবে না, তা যে পক্ষের জন্যই হোক।
আমরা লক্ষ করেছি, হামলার দিন (শনিবার) সকালে মুহুর্মুহু রকেট হামলার শব্দে কেঁপে ওঠে দক্ষিণ ইসরাইলের বেশ কিছু এলাকা। গাজা থেকে ডজনখানেক হামাস সেনা এসে কয়েক মিনিটের মধ্যেই লন্ডভন্ড করে দিয়ে যায় সবকিছু। ইয়োম কিপ্পুর যুদ্ধের ঠিক ৫০ বছর পরে আবারও ইসরাইলের মাটিতে রক্তের দাগ বহু প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে স্বভাবতই। হামলার পর দক্ষিণ ও মধ্য ইসরাইল জুড়ে সাইরেন বেজে উঠলে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন বাসিন্দারা। টেলিভিশন ও সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফরমগুলোতে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও ক্লিপ কতটা ভয়াবহ দৃশ্যের অবতারণা করে, তা দেখেছেন সবাই।
আরেকটি লক্ষণীয় বিষয়, হামাস দাবি করেছে, গাজা থেকে ইসরাইলে ৫ হাজারের মতো রকেট ছুড়েছে তারা। অন্যদিকে ইসরাইলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ২ হাজারের বেশি রকেট হামলার ঘটনা ঘটেছে। অর্থাত্, হামাসের হামলাকে একেবারেই ছোট করে দেখছে না ইসরাইল—যদিও সেটাই স্বাভাবিক।
হামলার পর এক ব্রিফিংয়ে ইসরাইল ডিফেন্স ফোর্সের (আইডিএফ) মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট কর্নেল রিচার্ড হেচটকে বলতে শোনা গেছে, ‘হামাসের যোদ্ধারা প্যারাগ্লাইডার ব্যবহার করে স্থল, সমুদ্র ও আকাশপথে গাজা থেকে ইসরাইলে প্রবেশ করেছে।’ কর্নেল রিচার্ডের কথার প্রসঙ্গ টানার কারণ, হামাস যে এভাবে আঘাত হানতে পারে ইসরাইলে, তা নিয়ে সম্ভবত অন্ধকারে ছিলেন নেতানিয়াহু! তাছাড়া আইডিএফের কাছে হামলার বিষয়ে আগাম সতর্কতা ছিল কি না—এমন প্রশ্নের উত্তরও কৌশলে এড়িয়ে যান কর্নেল রিচার্ড!
যা হোক, গণমাধ্যমগুলোর প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, ইসরাইলের ওপর কয়েক বছরের মধ্যে হামাস যেসব হামলা চালিয়েছে, তার মধ্যে এটা সবচেয়ে বড় আক্রমণের ঘটনা।
অন্যদিকে পালটা হামলা হিসেবে গাজায় যে হামলা শুরু করে ইসরাইল বাহিনী, তা-ও খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে সংঘটিত হতে দেখা গেল। এমনকি স্বয়ং নেতানিয়াহু তত্ক্ষণাত্ ঘোষণা করে বসলেন, ‘এটা যুদ্ধ—আমরা যুদ্ধের মধ্যে আছি।’ এবং নেতানিয়াহুর যুদ্ধ ঘোষণার পরপরই গাজায় হামাসের স্থাপনা লক্ষ্য করে যুদ্ধবিমান দিয়ে হামলা চালানোর ঘটনা ঘটল। এসব বিবেচনায় বলতে হয়, ইসরাইল-ফিলিস্তিন এবারের সংঘর্ষের ফলাফল কী হতে চলেছে, তা দেখার বিষয়!
দক্ষিণ ইসরাইলের কিবুতজ অঞ্চলের এক বাসিন্দা গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘এই এলাকায় হামাসের বন্দুকধারীরা মারাত্মক হামলা চালিয়েছে। অস্ত্রধারীরা ঘরে ঘরে তল্লাশি চালাচ্ছে। বাড়িঘরে গুলি চালাচ্ছে, আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে।’ তবে এসব অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে হামাস বাহিনীর কমান্ডার মুহাম্মদ দেইফ এই হামলাকে ‘মহান বিপ্লব’ হিসেবে অভিহিত করে বলেছেন, ‘এই হামলার মধ্য দিয়ে মহান বিপ্লবের সূচনা করা হলো।’
অনেকে দেখে থাকবেন, হামলার পর ইসরাইলি বাহিনী যখন বন্দুকধারীদের খুঁজে বের করতে মাঠে নামে, ঠিক সেই সময় আইডিএফ আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করে ‘যুদ্ধের অবস্থা শুরু হয়ে গেছে’।
এই ঘোষণার পর অনেকে ধরে নেন, গাজায় চূড়ান্ত যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে দিয়েছে ইসরাইলি বাহিনী। এবং ঠিক এর পরপরই আসে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর ঘোষণা। বাস্তবিক অর্থেই এসব ঘটনা একত্র করলে তা ইঙ্গিত দেয় বহু কিছুর!
সবচেয়ে বেশি যে বিষয় নিয়ে আলোচনা চলছে তা হলো, ইসরাইলের কথিত ‘নিরাপত্তাব্যবস্থার সক্ষমতা’। যেমনটা বলা হয়েছে চ্যানেল ১২ টিভির এক আলোচনায়—সংবাদ উপস্থাপক ড্যানি কুশমারোর দাবি, ‘আমরা গাজার সঙ্গে যে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে যাচ্ছি, তা আগে জানতাম না!’ সত্যি বলতে, কুশমারোর মতো বহু ইসরাইলির জিজ্ঞাসা—‘কোথায় আইডিএফ, কোথায় পুলিশ, কোথায় নিরাপত্তা?’
আসলেই তো!
ইসরাইলের ‘দুর্ভেদ্য নিরাপত্তাব্যবস্থা’ হামলা ঠেকাতে আবারও ব্যর্থ হলো কেন? এর কী ব্যাখ্যা থাকতে পারে? ইসরাইলি নৌবাহিনীর সাবেক প্রধান এলি মারনও বলছেন একই কথা। তার কথায়, ‘এটা একটা বিশাল ব্যর্থতা।’
ইয়োম কিপ্পুর যুদ্ধের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে সাবেক আইডিএফ গোয়েন্দাপ্রধান আমোস ইয়াডলিন এক ধাপ এগিয়ে বলেছেন, ‘এই আক্রমণ নিঃসন্দেহে বড় ধরনের গোয়েন্দা ব্যর্থতা।’
এ অবস্থায় করণীয় সম্পর্কে ইয়াডলিন জোর দিয়ে বলেন, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ইসরাইলকে শান্ত থাকতে হবে।’ তবে প্রশ্ন হলো, ইসরাইল-ফিলিস্তিন সম্পর্ক ক্রমশ যেদিকে যাচ্ছে, তাতে করে পক্ষদ্বয় শান্ত থাকবে বলে কি ধরে নেওয়া যায়?
লেখক: দ্য টাইমস অব ইসরাইলের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct