সন্ধিক্ষণ
গোপা সোম
পাপান এবারে দশম শ্রেণীতে উঠেছে। এখন তাই পাপানের মাথায় পড়াশোনার খুব চাপ। পাপানের বাবা-মা কে কোনোদিনও পাপানের পড়াশোনা নিয়ে মাথা ঘামাতে হয় না। প্রত্যেকদিন ভোর হতে না হতেই ঘড়ির এলার্ম শুনে, বিছানা ছেড়ে হাত মুখ ধুয়ে খাতা-বই নিয়ে পড়তে বসে পাপান। ভোর বেলাটা পাপানের খুব ভালো লাগে। পাপানের অন্যান্য বন্ধুরা পাপানকে বলে, রাতে জাগতে, রাতের বেলায় যখন নিরিবিলি হয়ে যায়, তখন পড়াশোনা ভালো হয়। পাপানের আবার রাত জাগলে শরীর খারাপ হয়। তাই বরাবর পাপান ভোরেই ওঠে। জ্ঞান হওয়া থেকে, পাপান ওদের পাড়ায় কোনোদিনও কোনো প্রভাতী গান গেয়ে বেড়াতে কাউকে দেখেনি। কিন্তু, কয়েক মাস যাবৎ হলো, ভোর হলেই এক বাউল পাপানদের বাড়ীর সামনে দিয়ে গান গেয়ে যায়, পাপানের আজকাল আর ঘড়িতে এলার্ম দিতে হয় না। এমনিতেই বাউলের প্রভাতী গানের ঠিক আগে আগেই পাপানের ঘুম ভেঙে যায়। এখন শরৎকাল বলে, বাউলের কণ্ঠে এখন শুধু আগমনী গান। বাউল একতারা হাতে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে যায়, পরে বেলা হলে সে মাধুকরী করে, যে যেমন দেয়, তাতেই সে সন্তুষ্ট হয়ে ফিরে যায়। এভাবেই বাউলের দিন চলে যায়। বাউলের এত সুন্দর গান শুনে পাপানের বাউলের ব্যাপারে খুব জানতে ইচ্ছে করে, তাই সে বাউলের কাছে জানতে চায় বাউলের ঘরে কে কে আছেন, বাউলের ঘরই বা কোথায় ইত্যাদি ইত্যাদি। বাউল সব কথার উত্তর ঠিক ঠিক মত দিতে চায় না, পাপানের মনে হয়। বাউল মনের কষ্টে দিনাতিপাত করছে, সেটা ভালো করেই সে অনুভব করে। মহাষ্টমীর সকালে আর বাউলের গান শোনা যায় নি, পাপানের মনটা কেমন কেমন করে, বাউলের জন্যে। আজ খুব তাড়াতাড়ি নবমী তিথি পড়ে যাবে, তাই মণ্ডপে মণ্ডপে সন্ধি পুজোর জোরদার আয়োজন চলছে, পাশাপাশি কুমারী পুজো, মহাষ্টমী পুজোরও। পাপান ওদের বাড়ির কাছে এক মণ্ডপে অঞ্জলি দিয়ে এক পা এক পা করে বড় রাস্তার দিকে পা বাড়িয়ে দেয়। দেখে বড় রাস্তার ধারে বিশাল বড় সবুজ ধান ক্ষেত, কচি ধানের চারাদের সরু চিকণ পাতাগুলি হাওয়ায় দোল খাচ্ছে, গুটি কয়েক শালিক ধান ক্ষেতে লুটোপুটি খাচ্ছে, আর গোটা কুড়ি-বাইশ সাদা ধবধবে বক বসে আছে দূরে। আর ঐ যে ক্ষেতের ধারে দীঘিতে টলটলে জল, তাতে বড় বড় গোল গোল পাতার মাঝখান থেকে বড় বড় পদ্মফুল ফুটে আছে। পাপান একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। আরও কিছুটা এগোতেই পাপান দেখে, আরও দূরে একটা কুঁড়ে ঘর, খড়ের ছাউনি, তাতে লোকজনের ভীড়। পাপানের মনটা নাড়া দেয়, ওখানে আবার কী হচ্ছে, গিয়ে পাপানের চক্ষুস্হির হয়ে যায়। পাপান দেখে, সেই বাউল, আর বাউলের পাশে ঝলমলে পোশাক পরিহিত দুইটি ফুটফুটে ছেলে, একজন সুশ্রী মহিলা। বাউলের অতি পরিচিতই মনে হলো পাপানের। একটি ধবধবে সাদা গাড়ী অদূরেই দাঁড়িয়ে।
এছাড়াও আরো কয়েকজন রয়েছেন সেই ঘরটিতে। পাপান বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা একজনের কাছ থেকে যে ঘটনা শুনলো, তা শুনে সে হতবাক। ঐ বাউল অবস্হাপন্ন ঘরের সন্তান, দশ বারো বছর হলো, বিয়ে হয়েছে। একদিন বাউল মাটিতে পড়ে গিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন, নিকটবর্তী ডাক্তার তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করে দেন। নিকট আত্মীয় স্বজন, সবার চোখের জল উপেক্ষা করে বাউলকে শ্মশানের পথে নিয়ে যাওয়া হয়, পথে অন্ধকার নেমে আসায়, শ্মশানবন্ধুরা বাউলকে রাস্তার ধারে নামিয়ে চা পান করতে যায়। সেসময় জোর বৃষ্টি আসে, বাউলের গায়ে বৃষ্টির জল পড়ে, মুখেও জল চলে যায়, বাউল নড়ে চড়ে বসে,বুঝতে না পেরে, সে চোঁ চাঁ দৌড় লাগায়। রাস্তায় এক গাড়ী দেখতে পেয়ে, পিছনদিকে, উঠে বসে থাকে চুপটি করে।ঐ গাড়ী চলতে শুরু করে এবং তখন ঐ গাড়ী যখন গন্তব্যস্হলে পৌঁছায়, নেমে পড়ে। ঐ স্হানেরই এক সহৃদয় ব্যক্তি তাঁকে এক পুরনো কুঁড়েঘরে থাকবার ব্যবস্থা করে দেন। সেই থেকে এখানেই থাকে বাউল এবং ভিক্ষা বৃত্তি করে জীবন ধারণ করে। অপরদিকে, চা পান করে শ্মশানবন্ধুরা এসে দেখে শব নেই, চারদিকে হৈচৈ পড়ে যায়, কিন্তু নাঃ, কোথাও দেহের খোঁজ পাওয়া যায় নি। বাউলের বাড়ীর লোকজন বহু চেষ্টা চালিয়ে এতদিনে সন্ধান পেয়ে, গাড়ী করে বাউলকে বাড়ী ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এসেছেন। পাপানের মন অনাবিল এক আনন্দে ভরে গেল। পাপান বাড়ী ফিরে আসতে আসতে শুনতে পেল, পূজো মণ্ডপে জোরে জোরে সন্ধি পূজোর ঘন্টা বাজছে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct