বাবার জুতো
তাপস কুমার বর
সেদিন পূর্ণিমা জ্যোৎস্না রাতে,বিবেক আকাশের দিকে তাকিয়ে আনমনে কি যেন ভাবছিল? তার বাবা আজ দীর্ঘ ত্রিশ বছর এই সংসার জীবনে ছেলের কাছ থেকে কি পেয়েছে? এই যন্ত্রণা বিবেক কে তার মন বার বার প্রশ্ন করে,....“বাবা,তোমার পরিশ্রমের ঘামগুলো,কবে আমি রুমাল দিয়ে মোছাবো?”- বিবেকের পরিবারে,বাবা সুকুমার চ্যাটার্জী, মা প্রমিলা দেবী ও ছোটো বোন মণিমালা এই চারজন নিয়ে তাদের ছোট্ট সংসার। বিবেকের বাবা একজন সরকারী কর্মচারী। দীর্ঘ ত্রিশ বছর এই কর্ম জীবনে ছেলে মেয়েদের শিক্ষায় সু-শিক্ষিত করে তুলেছেন। বিবেক বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র। সে বরাবর স্কুলে প্রথম বা দ্বিতীয় এই স্থান দখল করে এসেছে। কিন্তু আজ সেই সব পরিশ্রমের কথা মনে পড়লে বাবার সামনে গিয়ে মুখ তুলে দাঁড়াতে পারেনা। এম.এ পাশ করে বাড়িতে বেকার হয়ে বসে আছে সে। ছোটো বোন মণিমালা এই বছর মাধ্যমিক পরিক্ষা দেবে। সে ও দাদার মতো প্রতিভা সম্পন্ন। পরিবারের এতোগুলো পেট চালানো,সংসার খরচ, পড়াশোনার খরচ চালাতে গিয়ে সুকুমার চ্যাটার্জী ব্যাঙ্ক থেকে লোন ধার নিয়ে লোন পরিশোধ করতে পারছে না। এই চিন্তা নিয়ে সুকুমার চ্যাটার্জী মন থেকে অনেটা ভেঙে পড়েছে। কি করে লোন পরিশোধ করবে? এ দিকে বিবেক সারা জায়গায় ঘুরে ঘুরে কোথাও থেকে একটা চাকরি জোগাড় করে উঠতে পারছে না। সে বাবার পাশে দাঁড়াতে চায় কিন্তু তার কপাল সঙ্গ দিচ্ছে না। বিবেক কে একদিন তার বাবা ডেকে বললো, খোকা তোর কি পয়সা লাগবে? বিবেক নীরব হয়ে বাবার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। মুখ থেকে তার শব্দ বের হচ্ছিল না। বিবেক কে ডেকে বললো,.....
“দেখেছো, প্রমিলা।আমার ছেলেটা কত কষ্ট পায়,তার বাবার জন্য। শুধু বাবাকে মুখ ফুটে বলতে পারেনা।”- সেদিন বাবা ও ছেলের চোখের দৃষ্টিতে একটা যন্ত্রণা লুকিয়ে ছিল।কেউ কাউকে প্রকাশ করতে পারছে না। “দুজনের চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় বিন্দু বিন্দু অশ্রু ঝরে পড়ছে”।একদিন সুকুমার চ্যাটার্জী অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরছিল। হঠাৎ একটু অন্যমনস্কতার কারনে ইটের টুকরোতে হোঁচট খেয়ে, “পায়ের জুতো গেলো ছিঁড়ে”! অগত্যা পলিথিনে জুতো জোড়া জড়িয়ে হাতে নিয়ে খালি পায়ে বাড়ি ফিরছিল। কিছুটা দূরে হঠাৎ ছেলের সঙ্গে দেখা। বিবেক বললো বাবা, “তোমার জুতো কোথায়?” ছেলের উত্তরে বাবা সবকথা বললো। বিবেক বললো চলো বাবা একটা জুতো জোড়া কিনে দেই তোমাকে। সুকুমার চ্যাটার্জী একটু মুচকি হেসে ছেলেকে বললো,....“আমার ছেলেটা এখন থেকে বাবার দায়িত্ব নিতে শিখে গেছে। আমার আর তো সুখের অভাব নেই রে”।- শেষ পর্যন্ত বিবেককে তার বাবা বুঝিয়ে বললো, ওই টাকাটা তোর কাছে রাখ, একদিন এই হয়তো তোর জীবনের পরিবর্তন ঘটাবে। এই কথা বলে সুকুমার বাবু চলে গেলো। সুকুমার বাবু, স্ত্রী প্রমিলা দেবীর কাছে জুতো জোড়া দিয়ে বললো, সেলাই করে দিতে। প্রমিলা দেবী বললো, এই জুতো কি করে তুমি পরবে? এই জুতো পরার মতো অবস্থায় নেই। সুকুমার বাবু প্রমিলা দেবীর কানের কাছে গিয়ে বললো, আস্তে,......“এটা ছেলে জানতে পারলে ও ভীষণ কষ্ট পাবে। আমি জুতো সেলাই করে পরি। বিশেষ করে ব্যাঙ্কে লোনের বোঝা, কবে পরিশোধ হবে”?- প্রমিলা দেবী আর কিছু বললো না। এইভাবে বেশ কিছু দিন কেটে গেলো। রবিবার অফিস ছুটির দিনে সুকুমার বাবু একটু তাড়াতাড়ি খাওয়া সেরে তিনি বিশ্রাম নেন। সেদিন সুকুমার বাবু ঘুমাচ্ছিলেন। বিবেকের কি মনে হলো? বাবার রুমে ডুকেই প্রথমে বাবার জুতোর দিকে চোখ পড়লো। সেদিন বিবেক নিজেকে শান্ত রাখতে পারেনি। তাদের জীবনে আজও একটা অভাবের ছাপ গায়ে লাগতে দেয়নি যে বাবা। আজ সেই বাবার চলার পায়ের জুতো সেলাইতে ভর্তি। যা পরার উপযুক্ত নয়। বিবেক সেদিন নীরব হয়ে নিজের রুমে চলে আসে। সে সারাদিন ভাবলো, বাবার জন্য কি করলে, তার বাবার ঋণের বোঝা কিছুটা কমবে? পরদিন সুকুমার বাবু বললো, খুকি মা তোর দাদা কোথায়? মণিমালা বললো, দাদা তো অনেক আগে কোথায় একটা বেরিয়ে গেলো। সুকুমার বাবু নীরব থাকলো কিছুক্ষণ। প্রমিলা দেবী খাবারের কথা বললে, সুকুমার বাবু বলে,.....“আমার ছেলেটা কষ্ট পেয়েছে জানো। ও কিছু করতে পারছে না। তাই বাবার সম্মুখে আসতে ওর লজ্জা লাগে। অনেক বড়ো হয়ে গেছে। ও তো আমার কাছে এখনো ছোটো খোকা”।- কাঁদতে কাঁদতে অফিসে চলে গেলো সুকুমার বাবু। একদিন হঠাৎ বাড়ি থেকে সুকুমার বাবু তার সেই ছেঁড়া জুতো খুঁজে পাচ্ছে না। পায়ের সামনে একটা নতুন জুতো জোড়া ও খাটের উপর কুড়ি হাজার টাকা। চিঠিতে লেখা, বাবা আমার জীবনের প্রথম উপার্জিত অর্থ তোমাকে দিলাম।সুকুমার বাবু এ বাড়ি থেকে ও বাড়ি ছেলেকে খুঁজতে শুরু করলো। কিন্তু ছেলের দর্শন পেলো না। সেদিন তিনি অফিস গেলেন না। ছেলেকে খুঁজতে খুঁজতে একটা ফুটপাতের দিকে চলে যায়। “কিছুটা দূরে একটা অস্পষ্ট চেনা মুখ”। এক পা দু পা এগোতে, চেনা মুখটি স্পষ্ট হয়ে উঠছে। সুকুমার বাবু দূরে নীরব পাথরের মতো দাঁড়িয়ে। একটা বটগাছের নিচে হরেক রকমের জুতো নিয়ে সামান্যতম পয়সা দিয়ে জুতো সকলকে দিচ্ছে। সেখানে তৈরি হয়েছে মানুষের ভিড়। বটগাছের ডালের দিকে চোখ পড়তে, একটা বেনার লক্ষ করলো সুকুমার বাবু। সেই বেনারে বড়ো বড়ো হরফে লেখা “আমার বাবার জুতো”। পাশে লেখা “বাবা আমার বাঁচার শিরদাঁড়া। যারা বাবার জন্য জুতো কিনতে পারছেন না। আসুন এখান থেকে বিনে পয়সায় বাবার জন্য জুতো জোড়া নিয়ে যান। ভিড় ঠেলে সুকুমার বাবু ছেলের সম্মুখে দাঁড়াতে। ছেলে হতবাগ! জমায়েত সকল মানুষ সুকুমার বাবুর দিকে তাকিয়ে। ছেলেকে জড়িয়ে ধরে সুকুমার বাবু চিৎকার করে বলছে,.....“আমার ছেলেটা দায়িত্ব নিতে শিখে গেছে গো।”- দু’জনের চোখের ভাষা আজ,অনেক কিছু বলে গেলো। সুকুমার বাবু কাঁদতে কাঁদতে বললো,....“এই রকম ছেলের জন্য আমি গর্ববোধ করি”।- বিবেক বাবাকে জড়িয়ে ধরলো। জমায়েত মানুষ জন এই দৃশ্য দেখে করতালিতে ভরিয়ে দিল।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct