এম ওয়াহেদুর রহমান: নারী-পুরুষ উভয়কে নিয়েই মানব সমাজ গঠিত। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় বিশ্বমাঝে আদৌও কোন সমাজে নারী - পুরুষের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় নি। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ জীবনে নারী - পুরুষের সাম্য - সমন্ধ এখনও অধরাই থেকে গেছে। সমাজ, সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও রাজনীতি সর্বত্রই নারী বৈষম্য তথা বঞ্চনার শিকার হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনের সূরা নাহল - এ বলা হয়েছে, “ তাদের কাউকে যখন কন্যা সন্তানের সুসংবাদ দেওয়া হয় তখন তার মুখমন্ডল কালো হয়ে যায় এবং সে অসহনীয় মনস্তাপে ক্লিষ্ট হয়। যে এই দুঃখজনক সংবাদ শুনে সে নিজ সম্প্রদায় থেকে আত্মগোপন করে। সে চিন্তা করে যে লাঞ্ছনা সহ্য করে কন্যা কে রেখে দেবে,না মাটিতে পুঁতে দেবে।লক্ষ্য কর,কত হীন সিদ্ধান্ত তারা করে থাকে। ‘ এমনকি সক্রেটিস ও বলেছেন, ‘ যে নারী জাতি প্রাগৈতিহাসিক যুগে ছিল সমাজে সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট, নির্যাতিত ও নিপীড়িত। পুরুষ শাসিত সমাজে মুখ থুবড়ে পড়েছিল আর অপমানবোধের নীরব জবানবন্দি। কি ছিল তার পরিচিতি ? নারীর চেয়ে দুনিয়ায় আর নিকৃষ্ট বস্তু নেই।’ অথচ নারী খোদায়ী সৃষ্টির এক অনির্বচনীয় অহংকার। নারীর পরিচিতি - সে সুন্দর, সৌন্দর্যের প্রতীক, শান্তি ও সুখের অমিয়ধারা। নারী মাতৃত্বের গৌরবে গৌরবান্বিতা, পুরুষের অর্ধাঙ্গিনী, সংসারের চাবিকাঠি। অর্থাৎ নারী কেবলমাত্র কারো কারো মা, বোন, স্ত্রী নয় বরং ধৈর্য্য,সাহস সর্বোপরি সংগ্ৰাম ইত্যাদি বিশ্লেষণের অন্যরুপ। তাদের হাত ধরে গড়ে উঠেছে আমাদের সভ্যতা। কন্যা শিশু বা শিশু কন্যা হলো নারী জীবনের প্রথম স্তর। আজকের তথা কথিত নারী - স্বাধীনতার চরম উৎকর্ষের দিনে সত্যি শিশু কন্যা কিংবা নারী হয়ে জন্মানো কি অভিশাপ! পড়াশুনা, বিয়ে - পণ হাজারো ঝামেলা ! আজকের নারী প্রগতিবাদীরা জাহেলিয়াত যুগের বর্বরোচিত আচরণের করুন কাহিনী কেও অতিক্রম করে যাচ্ছে। তাই কি শিশু কন্যা কিংবা নারীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গোটা বিশ্বজুড়ে প্রতিবছরই ১১ অক্টোবর পালন করা হয় আন্তর্জাতিক কন্যা শিশু দিবস। এই দিনটি ‘ মেয়েদের দিন ‘ হিসেবে ও পরিচিত। লিঙ্গবৈষম্য দূরীকরণই হলো আন্তর্জাতিক কন্যা শিশু দিবসের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য।
লিঙ্গবৈষম্য দূরীকরণ করে মেয়েদের ক্ষমতায়ন সৃষ্টির উদ্দেশ্য নিয়ে; নারীর প্রথম রুপ কন্যা শিশুর অধিকার আদায়ে বিশ্বজুড়ে পালিত হয় আন্তর্জাতিক কন্যা দিবস। সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের উদ্যোগে প্রথম ২০১২ সালের ১১ অক্টোবর বিশ্বব্যাপী পালিত হয় আন্তর্জাতিক কন্যা শিশু দিবস। শিক্ষার অধিকার, পরিপুষ্ট স্বাস্থ্য, আইনি সহায়তা ও নায্য অধিকার, চিকিৎসার সুবিধা ও বৈষম্য থেকে সুরক্ষা, নারীর বিরুদ্ধে হিংসা এবং বলপূর্বক বাল্যবিবাহ রোধকল্পই হলো এই দিবস উদযাপনের আশু লক্ষ্য। ‘প্লান ইন্টারন্যাশনাল ‘ নামের বেসরকারি অনুষ্ঠানের পৃষ্ট - পোষকতায় একটি প্রকল্পরুপে আন্তর্জাতিক কন্যা শিশু দিবসের জন্ম হয়েছিল। প্লান ইন্টারন্যাশনাল “ কারণ আমি একজন মেয়ে ( Because I am girl ) নামক আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে এই দিবসের ধারণা জাগ্ৰত হয়েছিল। এই সংস্থার কানাডার কর্মচারীরা সকলে এই আন্দোলনকে বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠা করতে কানাডা সরকারের সহায়তা নেয়। সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সাধারণ সভায় কানাডা আন্তর্জাতিক কন্যা শিশু দিবসের প্রস্তাব উত্থাপন করে। ফলস্বরুপ ২০১১ সালের ১৯ ডিসেম্বর সাধারণ সভায় এই প্রস্তাব গৃহীত হয়। বাল্যবিবাহ রোধ, মেয়েদের শিক্ষা ক্ষেত্রে অভিনব করে তোলা, তাদের ক্ষমতায়নে জরুরী সহায়তা ও প্রতিরোধ পরিকল্পনা ইত্যাদি কারণে এই দিবস টি পালন করা হয় সমাজ জীবনে যেন নারীরা ভেদাভেদ কিংবা বৈষম্যের শিকার না হয় সে দিকে লক্ষ্য রেখে জনসচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে এই দিবস পালন করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক কন্যা শিশু দিবস পালনের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন দিনে ও পৃথক কর্মসূচির মধ্য দিয়ে এই কন্যা শিশু দিবস টি পালন করে চলেছে। ভারত সরকার ও বিভিন্ন কর্মসূচি যেমন ‘ বেটি বাঁচা ও বেটি পড়া ও ‘ ইত্যাদির মাধ্যমে কন্যা শিশু দিবস কে জনসমক্ষে উপস্থাপন করছে তেমনি পশ্চিমবঙ্গ সরকার ও ‘ কন্যাশ্রী ‘ এবং আরো অন্যান্য কর্মসূচির মাধ্যমে কন্যা শিশু দিবস কে জনগণের মাঝে তুলে ধরেছে। কন্যাভ্রুণ হত্যা নিয়ন্ত্রন আনতে ভ্রুনের লিঙ্গ নির্ধারণের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। তবু ও হয়তো আজও সমাজে কন্যাভ্রুণ হত্যা ও শিশু কন্যা হত্যার ঘটনা ঘটছে। লিঙ্গবৈষম্য দূরীকরণের জন্য একাধিক কর্মসূচি গৃহীত হলে ও এখন ও সমাজে নারী- পুরুষের বৈষম্য বিরাজমান। নারীদের ও পুরুষদের মতো বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে। কিন্তু আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় মনে করা হয় নারীদের কাজই হচ্ছে রান্নাবান্না করা আর সংসার সামলানো। তারা আজ ও শিকার হচ্ছে যৌতুক, এসিড নিক্ষেপ, ধর্ষণ ইত্যাদি ঘৃন্য অপরাধের। দুঃখজনক হলেও একথা সত্যি নির্যাতন পরবর্তী সময়ে যারা একসময় এগিয়ে আসতেন ভরসার হাত নিয়ে এখন তাদের উপর ও ভরসা করা সম্ভব হচ্ছে না। পাড়ার বখাটে ছেলেদের স্থান এখন হয়তো কেড়ে নিয়েছে অনেকেই। অথচ ধর্ম, সামাজিকতা কিংবা নৈতিকতার মানদণ্ডে নারীকে দেওয়া হয়েছে সর্বোচ্চ সম্মান। নেই শুধু সম্মানের বাস্তব রুপ। এছাড়াও কন্যা শিশু দিবসের সঙ্গে যেন বিশ্বের দিকে দিকে জরিয়ে যায় জামলো মাখদাম - এর মতো অসহায় কন্যা শিশুদের কথা। যে ১২ বছরের মেয়ে টি কোভিড লকডাউনের সময় লঙ্কার কাজ করতে গিয়ে বাড়ি ফেরার পথে পথিমধ্যেই মারা যায়। এই রকম হয়তো বিশ্বের বিভিন্ন আনাচে কানাচে অসংখ্য জামলো দের অস্ফুট গোঙানী আকাশ বাতাস কে মথিত করছে।
আমাদের ছোট মেয়ে টি আমাদের সমাজ, দেশ ও জাতি গঠনের মূল ভিত্তি। সেই আমাদের সৌন্দর্য, আমাদের আশা, স্বপ্ন ঘিরে থাকা ভবিষ্যৎ। কিন্তু কি ভয়ঙ্কর সত্যি কথা যে কাব্যে- সাহিত্যে, সোশ্যাল মিডিয়ায়, খাতায়, কলমে যতই শিশু কন্যা কিংবা নারীদের জয়গান করা হোক না কেন এখন ও হয়তো লিঙ্গবৈষম্য সমানভাবে চলছে। এখনও হয়তো কন্যা ভ্রুণ হত্যা হয়, ট্রামে, বাসে,ট্রেনে নারীদের নিরাপত্তার অভাব রয়েছে। এখনও কন্যা শিশু জন্মালে অনেক কন্যা শিশুর বাবা কিছু টা শঙ্কিত হয়। শঙ্কিত এই ভেবে নয়,যে তারা কন্যা শিশু ভালোবাসে না, শঙ্কিত এই ভেবে যে কন্যা শিশু টি তার বেঁচে থাকার নিরাপদ পরিবেশ পাবে কিনা। এখনও দেখা যায় একাধিক কন্যা জন্ম দেওয়ার জন্য অনেক নারীকে স্বামীর বাড়ি ত্যাগ করতে,কিংবা অনেক নারীর অকাল প্রয়াণ। পুরুষতান্ত্রিকতার বীজ হয়তো সমূলে উৎপাটিত না হওয়ার দরুন আজও কন্যা শিশু সহ নারীরা লিঙ্গবৈষম্যের শিকার হতে হচ্ছে। অথচ ‘ তারা(নারীরা) হচ্ছে তোমাদের ( পুরুষদের) জন্য পোশাক।’ নজরুল ও বলেছেন, ‘ বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর। অর্ধৈক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর ।’
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct