নতুন সংসদ ভবনে সাংসদকে আক্রমণ নরেন্দ্র মোদি সরকারের ধর্মান্ধ মনোভাবের উন্মোচন হল যা ভারতীয় ইতিহাসে বিরল ও চরমতম লজ্জার। সংখ্যালঘু নিধন ও বঞ্চনা সর্বত্র এবং স্বাধীনতার পরবর্তী সময় থেকে চলছেই। দাঙ্গাহাঙ্গামা ও সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচারের খতিয়ান লক্ষ্য করলে দেখা যায় শিক্ষা, সংস্কৃতি ও উন্নয়নের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। প্রতি বছর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, বিদ্বেষমূলক বক্তব্য এবং নির্যাতনের ঘটনা দেশের বিভিন্ন জায়গায় নিত্যদিনের সঙ্গী। যদিও সংখ্যালঘু সমাজ একটা নির্দিষ্ট মাত্রা পর্যন্ত কোন ভাবে আমল দিতে নারাজ। কারণ নানা ভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজের উপর নির্ভরশীল তারা। লিখেছেন ড. মুহাম্মদ ইসমাইল।
নতুন সংসদ ভবনে সাংসদকে আক্রমণ নরেন্দ্র মোদি সরকারের ধর্মান্ধ মনোভাবের উন্মোচন হল যা ভারতীয় ইতিহাসে বিরল ও চরমতম লজ্জার। সংখ্যালঘু নিধন ও বঞ্চনা সর্বত্র এবং স্বাধীনতার পরবর্তী সময় থেকে চলছেই। দাঙ্গাহাঙ্গামা ও সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচারের খতিয়ান লক্ষ্য করলে দেখা যায় শিক্ষা, সংস্কৃতি ও উন্নয়নের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। প্রতি বছর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, বিদ্বেষমূলক বক্তব্য এবং নির্যাতনের ঘটনা দেশের বিভিন্ন জায়গায় নিত্যদিনের সঙ্গী। যদিও সংখ্যালঘু সমাজ একটা নির্দিষ্ট মাত্রা পর্যন্ত কোন ভাবে আমল দিতে নারাজ। কারণ নানা ভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজের উপর নির্ভরশীল তারা। নিত্যদিনের কাজকর্ম থেকে শুরু করে কর্মসংস্কৃতি সকল বিষয়ে পরস্পরের সাথে জড়িত। আর মুসলমানদের নানা জায়গায় নানা মাসকারা শুনতে হয় প্রতিদিন সহকর্মীদের থেকে। তুমি মুসলমান হলেও তোমার ব্যবহার অনেক ভালো। তুমি গোড়া মুসলমান নয়। তোমাকে দেখে মনে হয় না তুমি মুসলমান। তোমাকে দেখে মনে হয় না মুসলমানেরা এত নোংরা। তোমার পরিবার পরিষ্কার-পরিছিন্ন অন্য শিক্ষিত মুসলমানদের মধ্যেও পাওয়া যায় না। তুমি মুসলমান হলেও তোমার বাড়িতে খাওয়া দাওয়া করা যায়। মুসলমানেরা শিক্ষিত হলেও অশিক্ষিতদের মত আচারব্যবহার করেন কিন্তু তুমি আলাদা। তোমার কথা বলছি না, তোমাদের পাড়াগুলোতে কত বাচ্চা থাকে। একজনের অনেকটা করে বউ আছে তোমাদের মধ্যে । এত বড় গরুটা আপনারা কী করে খেয়ে ফেলেন। মেয়েদের স্বাধীনতা নেই, বোরখা কেন পরে। সবটাই কিন্তু অফিস ও কর্মস্থলের মতো নানা জায়গায় জিজ্ঞাসা সহকর্মীদের।
অফিসে ও নানা কার্যক্রমে বঞ্চনা ও পক্ষপাত মূলক আচরণ প্রতিদিনের ঘটনা। যোগ্যতম হওয়া সত্ত্বেও কর্মস্থলে যোগ্য পদ ও সম্মান না পাওয়া তাদের বর্তমান। সাচ্ছার কমিটির রিপোর্ট অনুসারে তারা কর্মস্থলে সবচেয়ে নীচু স্তরে কাজকর্মে নিযুক্ত একই পদে নিযুক্ত হওয়া সত্ত্বেও। ১৪শতাংশ জনসংখ্যা বধ করার জন্য, নানা সংগঠন ও সরকার পরোক্ষ ভাবে যে পরিকল্পনা ও কার্যাবলী নিয়েছে তা ছেড়ে উন্নয়ন নিয়ে ভাবনা চিন্তা করলে ভারত বিশ্ব দরবারে ভালো জায়গায় স্থান পেত। ক্ষুধা তালিকায় ভারতের স্থান তলানিতে এবং শান্তির তালিকায় নিম্নে বিরাজমান। জাতিসংহের রিপোর্ট অনুসারে ভারতের ৪০শতাংশ বয়স্কদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা শোচনীয় তারা পরিবারের সদস্যদের ওপর নির্ভরশীল। সংবিধান ও বিচার ব্যবস্থা ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ ও জাতপাতের ঊর্ধ্বে কিন্তু সমস্ত জায়গায় অলিখিতভাবে সংখ্যালঘু বঞ্চনা চলছে সমানভাবে। অথচ মুসলমান শাসকেরা ভারতে কয়েকশো বছর সকল জাতি, ধর্ম, বর্ণ নিয়ে বসবাস করেছে। গত ৭৬ বছরে আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি কঙ্কালে পরিণত হয়েছে এবং সাচ্চার কমিটির মতে দেশে মুসলমানদের অবস্থা তপশিলি জাতি ও উপজাতিদের থেকেও খারাপ। সরকারি ও বেসরকারি চাকুরিতে উপস্থিতি সবচেয়ে কম। তবে দেশের এলিট ক্লাস, নেতা-নেত্রীরা সব কিছুর ঊর্ধ্বে ছিল। তাদের যোগাযোগ ছিল বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ও উচ্চবর্ণের মানুষদের সঙ্গে। তার ফলে সাধারণ মুসলমানদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা, বঞ্চনা, বিড়ম্বনা, চলার পথে অবমাননা প্রভৃতি জানতো না তারা। কিন্তু গত দশক থেকে তারাও হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে এবং তাদের নিয়েও টানা হেঁচড়া শুরু হয়েছে বিভিন্ন মহলে। রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে বলিউডের নামি দামি তারকারাও সাম্প্রদায়িকতা থেকে মুক্ত নন। জোর করে তাদের গায়ে বিভিন্ন তকমা সেটে দেওয়া হচ্ছে। বলিউড তারকা থেকে শুরু করে শিল্পপতিদের নিশানা করছে এবং তাদের আর্থ-সামাজিকভাবে পঙ্গু করার চেষ্টা হচ্ছে বয়কট করে। প্রতিদিন সামাজিক মাধ্যম, মিডিয়া ও whatsapp বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঘৃণার প্রশিক্ষণ নেওয়া হচ্ছে। শুধু তাই নয়, সভা, সমিতি থেকে শুরু করে লেখনী এবং বিভিন্ন বেসরকারি স্কুলের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে ঘৃণার কবিতা ও গল্প। একটা সম্প্রদায়কে বদনাম করা হচ্ছে ও তাদের সমাজের মূল স্রোতে ফিরতে না দেওয়ার প্রচেষ্টা হচ্ছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পানীয় জল, যোগাযোগ ব্যবস্থা থেকে শুরু করে সমস্ত রকমের আর্থিক বিষয় থেকে আড়াল করা হচ্ছে। এক দশকে উগ্র হিন্দুত্ববাদী নানা শাখা সংগঠনও ব্যক্তিবর্গ জাগ্রত হয়েছে। প্রকাশ্যে ঘৃণার বক্তব্য, বঞ্চনা, ঘর ভাড়ার মত সমস্যা দানা বেধেছে ও বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তারা ছেলেমেয়েদের ভর্তি করতে ভয় পাচ্ছে। দেশ জুড়ে সর্বত্র নির্যাতন শুরু হয়েছে, রেহাই পাননি ট্রেনে, বাসে ও কর্মস্থলে। আফরাজুলের মতো সাধারণ শ্রমিককে পুড়িয়ে মারা হলো ও ভয়ংকর ঘটনার সাক্ষী সারা পৃথিবী। মুসলমানেরা আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে এবং বঞ্চিত হচ্ছে নানা কর্মস্থলে ও থাকা খাওয়ার জন্য জায়গা পাচ্ছেনা শহরে। কেউ কেউ আশ্রয় দিলেও স্থানীয় ক্লাব ও রাজনৈতিক নেতাদের চাপে বাধ্য হচ্ছেন ভাড়া প্রত্যাহার করতে। তবে শুধু বিজেপি ও আরএসএস নয়, সমস্ত রাজনৈতিক দলের নেতা, তাদের আশ্রিত ক্লাব ও সংগঠন ঘর ভাড়া, ব্যবসা-বাণিজ্য করার জন্য দোকানপাট ভাড়া দেওয়া, জায়গা জমিন বিক্রি করা থেকে সমস্ত বিষয়ে প্রতিবন্ধকতা প্রদান করেছে। তাদের নিয়ে কু-কথা, বিদ্বেষমূলক বক্তব্য থেকে শুরু করে জঙ্গি, উগ্রপন্থি কত তকমা সহজেই সেটে দেওয়া হচ্ছে ব্যক্তি স্বার্থে। আর ট্রেনে, বাসে, নানা যানবাহনে, নিরাপত্তা রত পুলিশ কর্মী থেকে শুরু করে টিকিট পরীক্ষক সকলের কাছে কত না কিছু শুনতে হয় নিত্য যাত্রীদের। দেশের নামিদামি উকিলদের ও শুনেছি মক্কেলদের নিয়ে কথা বলতে। আরপিএফের ট্রেনে মুসলমান যাত্রীদের খুঁজে খুঁজে খুনের ঘটনার সাক্ষী আমরা। তার মধ্যে সংসদ ভবনে লোকসভার শত শত সদস্যের সামনে জঙ্গি, উগ্রপন্থি, মোল্লা, ভাড়ওয়া, কাটুয়া মতো কত কথা শুনতে হল শাসক দলের সাংসদ রমেশ বিধুরি থেকে।
শুধু তাই নয়, বাইরে দেখে নেওয়ার হুমকি প্রদান করা হয় মাননীয় স্পিকারের সামনে। তা থেকে মোদির আমলে সংখ্যালঘু নিরাপত্তার খতিয়ান উলঙ্গ হল আরেক বার।
বুঝিয়ে দেওয়া হল মুসলমান নেতা-নেত্রী বলে কিছু হয় না, হিন্দু ও হিন্দুত্ব শেষ কথা। অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা, বিজেপির কয়েকজন সদস্য হাসলো ও টেবিল চাপড়ালো বক্তব্যের সমর্থনে। এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি যদি সংসদ ভবনে হয়, তবে সহজে অনুমেয় দেশের সংখ্যালঘু জনগণ কেমন আছেন। তবে এটা পরিকল্পিত ঘটনা । তা না হলে, কেন দিল্লির সাংসদ উত্তর প্রদেশের সাংসদকে নিয়ে কুমন্তব্য করবে।
আসলে কয়েক বছরে বিজেপির পায়ের তলায় মাটি সরেছে এবং একের পর এক রাজ্যে পরাজিত হয়েছে। হিন্দু জনগণও বুঝতে পেরেছে আর্থ-সামাজিক দিক থেকে ভারত পিছিয়ে পড়েছে। তার প্রভাব শুধু মুসলমানদের উপর নয় হিন্দুরাও মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হয়েছে। ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অসমতা, কর্মসংস্থান, হিংসা, দাঙ্গা, সহিংসতা ও সম্পদের লুণ্ঠন বেড়েছে হাজারো গুণ। শুধু তাই নয়, আন্তর্জাতিক মহলে মাথা হ্যাট হচ্ছে ও মুখ পুড়েছে সরকারের। তারপরে লোকসভা নির্বাচনের পুরান অ্যাজেন্ডা বাবরি মসজিদ শেষ হয়েছে। তেমন ভাবে নতুন দীর্ঘ মিয়াদি ধর্মীয় উসকানি দাঁড়াতে পারছেনা। কারণ হিন্দু ধর্মাবলম্বী সাধারণ থেকে সাধারণতর মানুষেরা বুঝতে সক্ষম হয়েছে এই দেশে কয়েকশো মন্দির নির্মাণ করলে ও দেশের সমস্ত মসজিদ মন্দিরে রূপান্তরিত করলেও মানুষের আর্থ-সামাজিক সচ্ছলতা আসবে না।
পাশাপাশি কর্মসংস্থান হবে না ও বেকারত্বের মত সমস্যার সমাধান হবে না। তাই বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিজেপি ও আরএসএস পরিকল্পিত ভাবে নানা সাম্প্রদায়িক ঘটনা ঘটানোর চেষ্টা করছে।
যার মাধ্যমে বৃহত্তর জনমত গঠন করা যায়। তাই রমেশের মতো সাংসদদের মাঠে নামানো হয়েছে বিদ্বেষ ছড়ানোর জন্য।
এত দিন সাধারণ মানুষকে আক্রমণ করে তেমন ফলাফল না পেয়ে হতাশাগ্রস্ত বিজেপি সংসদে সাংসদ সদস্যকে আক্রমণের পথ বেছে নিয়েছে।
ড. মুহাম্মদ ইসমাইল
অধ্যাপক দেওয়ান আব্দুল গণি কলেজ, দক্ষিণ দিনাজপুর।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct