এ রাজ্যে মুসলমানদের বসবাসের ইতিহাস অনেক পুরোনো—অন্তত ৪০০ বছর তো হবে। একটা কাহিনি আছে এ রকম, পুরোনো দিনের আসামের সিলেট থেকে কয়েক শতাব্দী আগে সেখানে যুদ্ধ করতে গিয়ে অভিবাসী হয় এই জনগোষ্ঠী। তবে ছোট একটা ভিন্নমত হলো, সিলেট থেকে যাওয়ার আগেই মণিপুরে মেইতেইদের একাংশের মধ্যে ইসলামের গোড়াপত্তন ঘটে গিয়েছিল। ১৮১৯ থেকে ১৮২৬ সাল, স্থানীয়ভাবে যাকে বলা হয় ‘দুর্যোগে ভরা সাত বছর’, মিয়ানমারের রাজাদের আগ্রাসনের মুখে মণিপুরিরা আশপাশের অঞ্চলে যে ছিটকে পড়েছিল, তাতে ওই মুসলমানরাও ছিল। এই মানুষদের স্থানীয় আরেক পরিচয় ‘মেইতেই পাঙাল’। লিখেছেন আলতাফ পারভেজ।
সংবাদকর্মী বা সমাজ-গবেষক হিসেবে দক্ষিণ এশিয়ার অনেকে এখন মণিপুর যেতে আগ্রহী। সেখানকার পরিবেশ এ রকম আগ্রহ মেটানোর জন্য যে সহায়ক অবস্থায় নেই, সে-ও অনেকের জানা। তারপরও কেউ না কেউ যাচ্ছেন। এ রকম অনেকে সেখানে গিয়ে প্রথমে খুঁজে নিচ্ছেন মুসলমান কোনো গাইড বা গাড়িচালককে। চাহিদা হিসেবে এটা অভিনব।
দিল্লির এক পরিচিত সাংবাদিক রহস্য করে এ-ও বললেন, মুসলমানদের জন্য তুলনামূলকভাবে নিরাপদ জায়গা এখন মণিপুরের ইম্ফল। কথাটা যে প্রতীকী অর্থে বলা, সেটা বোঝা যায়।
এটা সত্য, মণিপুরে পারস্পরিক সংঘাতে লিপ্ত কুকি ও মেইতেইরা মুসলমানদের ‘খুঁজছে’ না বা ‘সুবিধাজনক’ অবস্থায় পেলেও কিছু বলছে না। কিন্তু কঠিন এক হিসাব-নিকাশের খেলায় পড়েছে ক্ষুদ্র এই গোষ্ঠীও।
হঠাৎ সামাজিক মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায়
অভিজ্ঞরা মণিপুরে মেইতেই ও কুকিদের সহজে চিনতে পারবেন। আবার মেইতেই ও কুকিদের পাশাপাশি একজন মুসলমান নারী বা পুরুষকে শনাক্ত করাও মণিপুরে কঠিন নয়। পরিস্থিতি এখন এ রকম যে, ইম্ফলের ভেতর কুকিদের ঘোরাফেরা কঠিন।
একইভাবে ঝুঁকি আছে ইম্ফলের বাইরে পাহাড়ি এলাকায় মেইতেইদের বিচরণ। কিন্তু দুই জায়গাতেই একজন মুসলমান যেতে পারছেন।
মুসলমানরা আপাতত সেখানে প্রধান দুই জনগোষ্ঠীর কারও ‘প্রতিপক্ষ’ নয়। কিন্তু তারপরও অতি সংখ্যালঘু এই জনগোষ্ঠীও তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগে আছে; যদিও মণিপুরের মুসলমানদের নিয়ে ভাবছে কমজনই।
উত্তর-পূর্ব ভারতীয় রাজ্যগুলোর মধ্যে আসামের পরই মণিপুরে লোকসংখ্যায় মুসলমানদের হিস্যা উল্লেখযোগ্য। ৯ থেকে ১০ ভাগ। সংখ্যার হিসাবে অবশ্য সেটা সামান্যই। রাজ্যের ৩২ লাখ মানুষের মধ্যে ৩ লাখেরও কম তারা।
এ রাজ্যে মুসলমানদের বসবাসের ইতিহাস অনেক পুরোনো—অন্তত ৪০০ বছর তো হবে। একটা কাহিনি আছে এ রকম, পুরোনো দিনের আসামের সিলেট থেকে কয়েক শতাব্দী আগে সেখানে যুদ্ধ করতে গিয়ে অভিবাসী হয় এই জনগোষ্ঠী। তবে ছোট একটা ভিন্নমত হলো, সিলেট থেকে যাওয়ার আগেই মণিপুরে মেইতেইদের একাংশের মধ্যে ইসলামের গোড়াপত্তন ঘটে গিয়েছিল।
১৮১৯ থেকে ১৮২৬ সাল, স্থানীয়ভাবে যাকে বলা হয় ‘দুর্যোগে ভরা সাত বছর’, মিয়ানমারের রাজাদের আগ্রাসনের মুখে মণিপুরিরা আশপাশের অঞ্চলে যে ছিটকে পড়েছিল, তাতে ওই মুসলমানরাও ছিল। এই মানুষদের স্থানীয় আরেক পরিচয় ‘মেইতেই পাঙাল’।
সংখ্যায় কম হলেও যেহেতু রাজ্যে পাঙালরা পুরোনো সম্প্রদায়, এ কারণে কুকি ও মেইতেই উভয়ে এদের ধ্যান-ধরন সম্পর্কে ভালো জানে। আর ওই জানাশোনা এখন তিন পক্ষেরই কাজে লাগছে। তবে কোনো জনপদে সর্বগ্রাসী অশান্তি এলে সবার গায়ে কমবেশি তার আঁচ লাগে।
মণিপুরের চলমান সহিংসতার ভেতর পাঙালদের জন্যও চরম অনিশ্চয়তার উপাদান আছে। তারা কেউ কেউ উদ্বাস্তুও হয়েছে ইতিমধ্যে। হিন্দু মেইতেইপাড়ায় থাকার কারণে তারাও আক্রান্ত হয়েছে।
এসব দেখে তাদের অনেকের মনে পড়ছে, উঁকি দিচ্ছে ১৯৯৩ সালের সহিংসতার স্মৃতি। তবে এবার এখনো মোটাদাগে পাঙালরা আক্রান্ত নয়। বরং ক্ষুদ্র এই জনগোষ্ঠী রাজ্যটির বৃহৎদের মধ্যে যোগাযোগ সেতু হিসেবে আছে।
গাড়িচালকসহ অনেক পেশায় মণিপুরি মুসলমানদের চাহিদা বেড়ে গেছে অভাবনীয়ভাবে। হিন্দু মেইতেই আর খ্রিষ্টান কুকিদের এলাকায় উভয় সম্প্রদায়ের কারও যখন কোনো দরকার পড়ে, তখন পাঠানো হয় মুসলমানদের।
কোনো কোনো সময় এ রকম কাজে নাগাদেরও ডাকা হয়, তবে মুসলমানদের চাহিদা বেশি। কারণ, নাগাদের বিরুদ্ধেও মেইতেই ও কুকিদের কিছু কিছু ক্ষোভের নজির পাওয়া যায়। মণিপুরি মুসলমানদের বেলায় সে রকম দেখা যাচ্ছে না এবার।
তবে ইতিহাসে মণিপুরের মুসলমানরা সব সময় নিরাপদে ছিল না; বরং রাজ্যটির ইতিহাসের জঘন্যতম সহিংসতায় ১৯৯৩ সালে তাদের প্রায় ১০০ জন মারা গিয়েছিল।
যদিও তখনকার প্রচারমাধ্যম একে ‘মণিপুরে হিন্দু বনাম মুসলমান দাঙ্গা’ হিসেবে দেখায়, কিন্তু কার্যত ওই ঘটনায় মেইতেই হিন্দু মারা যায় চারজন, অন্যরা সবাই ছিল পাঙাল মুসলমান। পাঙালরা প্রতিবছর ওই সহিংসতায় নিহত মানুষদের ‘শহীদ দিবস’ পালনের মাধ্যমে স্মরণ করে।
যোগাযোগের সেতু
দক্ষিণ এশিয়ায় বরাবরই দাঙ্গার সংবাদ পরিবেশনের নানান বিতর্কিত ভঙ্গি আছে। কোনটা ‘দাঙ্গা’ আর কোনটা একতরফ ‘সন্ত্রাস’, সেই ফারাক অনেক সময় খুনোখুনির হিসাবের নিচে চাপা দিয়ে রাখা হয়। আবার কারা মারা যাচ্ছে, তাদের অর্থনৈতিক ও জাতিগত মর্যাদার রকমফেরও দাঙ্গার সংবাদ প্রভাবিত করে।
১৯৯৩ সালের ৩ মের দাঙ্গায় প্রায় ১০০ মুসলমান মারা যাওয়ার পরও সেটা দেশ-বিদেশে তেমন নজর কাড়েনি, এবার যেমনটি ঘটছে। এর কারণ বোধ হয় এ–ই যে, মেইতেই পাঙালরা মণিপুরি সমাজের দরিদ্র কৃষিজীবী একাংশমাত্র। একদিকে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল, অন্যদিকে ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী হলে যা হয়, মেইতেই পাঙালদের অবস্থাও তা–ই।
ধর্মের পাশাপাশি গায়ের রং কালো বলেও সমাজে তাদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য আছে। ‘পাঙাল’ উচ্চারণের মধ্যে সংখ্যাগুরুরা খানিক অবজ্ঞাও মিশিয়ে দেয় অনেক সময়। তাদের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ারও অপ্রমাণিত অভিযোগ তোলা হয়।
অতীতে পাঙালদের বিরুদ্ধে ছোটখাটো সহিংসতায় থানায় অভিযোগ গ্রহণ না করারও অভিযোগ করতেন ওই সম্প্রদায়ের অভিভাবকেরা। ৬০ সদস্যবিশিষ্ট রাজ্যের বিধানসভায় তাদের সম্প্রদায়ের জনপ্রতিনিধি সংখ্যা সচরাচর তিন থেকে চারজনের বেশি থাকে না।
সামাজিক বঞ্চনা, জাতিগত অবজ্ঞা ও স্বল্প রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বের মধ্যেই এবার নাটকীয়ভাবে পাঙালদের কদর বেড়ে গেছে রাজ্যজুড়ে
সামাজিক বঞ্চনা, জাতিগত অবজ্ঞা ও স্বল্প রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বের মধ্যেই এবার নাটকীয়ভাবে পাঙালদের কদর বেড়ে গেছে রাজ্যজুড়েছবি: সংগৃহীত
যদিও ৫০ বছর আগে রাজ্য হিসেবে যাত্রার সময় এখানে প্রথম মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন একজন মুসলমান, কিন্তু এখন তাদের প্রতিনিধিত্ব ক্রমে কমছে। সর্বশেষ রাজ্য নির্বাচনে ৬০ আসনের মধ্যে মুসলমান প্রার্থী ছিলেন ১৩ জন, জিতেছেন ৩ জন।
৬০টি আসনের ভেতর ৩ থেকে ৪টি নির্দিষ্ট আসনেই মুসলমান প্রার্থীরা বিভিন্ন দল থেকে বেশি সংখ্যায় দাঁড়ান। অন্যত্র দলগুলো তাদের মনোনয়ন দেয় না।
সামাজিক বঞ্চনা, জাতিগত অবজ্ঞা ও স্বল্প রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বের মধ্যেই এবার নাটকীয়ভাবে পাঙালদের কদর বেড়ে গেছে রাজ্যজুড়ে। দাঙ্গায় যে তারা কোনো পক্ষ নেয়নি—তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, বিপজ্জনক এলাকাগুলোয় তাদের কাজে লাগিয়ে জীবনযাত্রাকে টিকিয়ে রাখা যাচ্ছে।
কুকি ও মেইতেই উভয়ে নজর রাখছে পাঙালদের
এটা বিস্ময়কর ঘটনা যে মণিপুরে ১৯৯৩ সালের সহিংসতা এবং এবারের দাঙ্গা—দুটোই শুরু হয় ৩ মে। প্রথমোক্ত ঘটনায় পাঙালরা ছিল খুবই অসহায়। এবারের দাঙ্গার পরের চিত্রটা কিছুটা আলাদা। মেইতেই পাঙালরা রাজ্য থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত সব স্তরে শান্তির জন্য রাজনীতিবিদদের কাছে অনেক প্রস্তাব নিয়ে ধরনা দিচ্ছে।
ছোট এই মুসলমান জনগোষ্ঠীতে একটি সংস্থা হলো ‘মেইতেই পাঙাল কমিটি’। এই কমিটি কেন্দ্রে প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে জানিয়েছে সম্প্রদায়গতভাবে তারা কী চায় এখন। তাদের দাবির মধ্যে আছে সব সন্ত্রাসের জবাবদিহি। বলা বাহুল্য, সে রকম দাবি শান্তিপ্রিয় সবারই।
প্রশ্ন হলো, জবাবদিহি আদায় করবে কে? ইতিমধ্যে এবারের দাঙ্গায় মারা গেছেন ১৮০ জন। ঘরবাড়ি ছাড়তে হয়েছে প্রায় ৫০ হাজার জনকে। সন্ত্রাসের উৎস সেখানে বহু; তাতে স্বার্থও রয়েছে বহু পক্ষের। পাঙালদের অনুরোধে এ রকম সন্ত্রাস চট করে থামবে বলে মনে হয় না।
তবে সন্ত্রাস ও সহিংসতা আরও বাড়লে পাঙালরাও আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি আছে। যেমন কুকিদের সঙ্গে তাদের বৈরিতার নজির না থাকলেও একটা বিষয়ে কুকি ও মুসলমানদের অবস্থান ভিন্ন।
কুকিরা রাজ্যটি ভেঙে একটা পৃথক রাজ্য চাইলেও পাঙাল মুসলমানরা ভাঙাভাঙির বিপক্ষে। তারা চায় রাজ্যটি এক রেখে কুকি-মেইতেই দ্বন্দ্বের সমাধান হোক। কুকিদের দিক থেকে পাঙালদের এ রকম অবস্থানে সমর্থন নেই।
তা ছাড়া জাতিগত বৈরিতা এত তীব্র যে কুকি ও মেইতেইরা আদৌ আর কোনো দিন ইম্ফলে মিলেমিশে ঘোরাফেরা করতে পারবে কি না, কিংবা সেটা কতটা সম্ভব, তা নিয়ে সন্দেহগ্রস্ত অনেকেই।
পাঙালরা যে মণিপুরের বিভক্তি চাইছে না, সেটা নিজস্ব কৌশলগত কারণে। তাদের বসতি মূলত মেইতেইদের কাছাকাছি সমতলীয় জেলাগুলোয়। ফলে রাজ্য বিভক্ত হলে তারা হিন্দু মেইতেইদের একমাত্র সংখ্যালঘুতে পরিণত হবে।
হিন্দু মেইতেইদের মধ্যে বিজেপির জনপ্রিয়তাও হয়তো পাঙালদের ভাবাচ্ছে। তা ছাড়া রাজ্য ভাগ হলে কাজকর্মের জগৎও ছোট হয়ে আসবে। ১৬টি জেলার মধ্যে ভ্যালির বাইরের ১২টিই কুকি ও নাগাদের এলাকায় পড়ে যেতে পারে তখন।
এ ছাড়া বর্তমান কাঠামোয় কুকি, নাগাসহ অন্যান্য সম্প্রদায় থাকায় মণিপুরজুড়ে সব সংখ্যালঘু জোটবদ্ধ হয়ে প্রায় ৫০ ভাগ হয়ে সংখ্যাগুরুর সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করতে পারে। রাজ্য ভেঙে নতুন রাজ্য হলে এ রকম সুযোগ থাকবে না। সম্ভাব্য সেই অধ্যায় মেইতেই এলাকা পাঙালদের জন্য অসহনীয় হয়ে উঠতে পারে। আবার এখন কুকি ও মেইতেই উভয় সম্প্রদায় পারস্পরিক যোগাযোগের দরকারে পাঙালদের ওপর ভরসা করলেও উভয়ে শেষোক্তদের সন্দেহের চোখেই দেখছে। কুকিরা ভাবে, পাঙালরা মেইতেইদের হয়ে কাজ করছে, কারণ তারা একই জাতিগত উত্তরাধিকার বহন করছে এবং একই ভাষার মানুষ। অন্যদিকে, মেইতেইরা ধরে নেয়, উভয়ে সংখ্যালঘু হওয়ায় কুকিদের প্রতি পাঙালদের গোপন দরদ আছে। উভয় বড় সম্প্রদায় পাঙালদের চোখে চোখে রাখার মুখে কোনো সম্প্রদায়ের কোনো সদস্যের প্রতি তাদের ন্যূনতম পক্ষপাত রাজ্যজুড়ে সহিংসতার আরেক উৎসমুখ খুলে দিতে পারে। পাঙালদের জন্য আরেকটি সমস্যা হলো, কুকি ও মেইতেই কেউ ‘শিডিউল ট্রাইব’ হিসেবে তাদের গণ্য হওয়ার দাবি পছন্দ করছে না। বর্তমানে কুকিরা এই স্বীকৃতি পেয়ে আছে। মেইতেইরাও সেটা চাইছে। দাঙ্গার সূত্রপাত মেইতেইদের ওই দাবি নিয়েই। অথচ এই দুই সম্প্রদায়ের চেয়ে অনেক ছোট জনগোষ্ঠী হয়েও পাঙালরা একই মর্যাদার দাবি তোলামাত্র কুকি-মেইতেই কেউ ব্যাপারটা ভালো চোখে দেখছে না।
আলতাফ পারভেজ: ইতিহাস বিষয়ে গবেষক
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct