সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় : প্টেম্বর মাসের দ্বিতীয়ার্ধ সংসদীয় ভারতের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। ভারতের নতুন সংসদ ভবনের পথচলা শুরু এই সময়েই। পাঁচ দিনের বিশেষ অধিবেশনের প্রথম দিনে সংসদ সদস্যরা পুরোনো ভবনে জড়ো হন তাকে কৃতজ্ঞচিত্তে বিদায় জানাতে। পরের দিন সদস্যরা নতুন ভবনে যান মার্চ করে। শাসক দলের মিছিলে ছিল হিন্দুত্ববাদী স্লোগান, বিরোধীদের হাতে হাতে ভারতের সংবিধান। দুটোই অর্থবহ। দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে নতুন ভবনে। বিনা বাধায় পাস হয় নারী সংরক্ষণ বিল, দীর্ঘ ২৭ বছর যা ছিল প্রতীক্ষায়।কৃতিত্ব পুরোটাই নিজের কোলে টেনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নতুন ভবনে দাঁড়িয়ে বলেন, ঈশ্বর সম্ভবত এই কারণেই তাঁকে বেছেছিলেন।হয়তো ভুল বলেননি। কেননা নতুন সংসদ ভবন গড়ার তাগিদ সবার চেয়ে মোদিই বেশি অনুভব করেছেন। লোকসভা ও বিধানসভায় নারীদের জন্য এক-তৃতীয়াংশ আসন সংরক্ষণের আইন পাসের চেষ্টায় সাবেক প্রধানমন্ত্রীরা ব্যর্থ হয়েছিলেন শরিকি নির্ভরশীলতার কারণে। মোদি সেই বাধা অতিক্রম করেছেন অনায়াসে। গত ২৯ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু বিলে সই করেছেন। নারী সংরক্ষণ বিল ওই দিন থেকেই আইনে রূপান্তরিত।এ পর্যন্ত সবকিছুই ঠিক। কিন্তু পরবর্তী অধ্যায় ধোঁয়াশাচ্ছন্ন। কারণ, ভারতীয় নারীরা কবে থেকে সংরক্ষণের সুবিধা পাবেন, কেউ জানে না। ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটে তো নয়ই, সম্ভবত ২০২৯ সালেও নয়। এ অনিশ্চয়তা ঘিরে রাজনীতি উত্তপ্ত। ‘ঈশ্বরপ্রেরিত’ প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর ‘ম্যান ফ্রাইডে’ গুজরাটি দোসর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ প্রশ্নবাণে জর্জরিত। আইন প্রচলনের ক্ষেত্রে কেন এত অযৌক্তিক শর্ত, তার যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা তাঁরা দিতে পারছেন না। ফলে প্রাধান্য পাচ্ছে তাঁদের রাজনৈতিক কৌশলের প্রসঙ্গ।
তা আলোচনার আগে একটু অতীতচারী হতে হবে। রাজনীতিতে নারীদের এক-তৃতীয়াংশ আসন সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা প্রথম অনুভব করেছিলেন রাজীব গান্ধী। ১৯৮৭ সালে প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে তিনি যে কমিটি গড়েছিলেন, তার সুপারিশ কার্যকর করেন প্রধানমন্ত্রী নরসিমা রাও। পঞ্চায়েত ও পৌরসভায় নির্দিষ্ট হয় নারীদের এক-তৃতীয়াংশ আসন সংরক্ষণ। তেমন সংরক্ষণ লোকসভা ও বিধানসভায় চালু করতে চেয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী এইচ ডি দেবগৌড়া, অটল বিহারি বাজপেয়ী ও মনমোহন সিং। ১৯৯৬ সালের ১২ সেপ্টেম্বর দেবগৌড়া নারী সংরক্ষণ বিল সংসদে পেশ করলেও পাস করাতে পারেননি। ২০১০ সালের ৯ মার্চ মনমোহন সিং তা রাজ্যসভায় পাস করান ১৮৬-১ ভোটে, কিন্তু লোকসভায় পারেননি শরিকি মতপার্থক্যের জন্য। নরেন্দ্র মোদির জিয়নকাঠির ছোঁয়ায় ২৭ বছরের প্রতীক্ষা শেষে সেই বিল আইন হলো। কিন্তু অপেক্ষার আশু অবসান ঘটছে না। কেন ঘটছে না, সেটাই রাজনীতি।দেবগৌড়া-বাজপেয়ী-মনমোহন সিংদের বাধ্যবাধকতা নরেন্দ্র মোদির ছিল না। ২০১৪ সালেই ইচ্ছা করলে তিনি লোকসভায় এই বিল পাস করাতে পারতেন। কারণ, এই কক্ষে তাঁর দলের গরিষ্ঠতা নিরঙ্কুশ। বাড়তি সমর্থনের দরকারই নেই। রাজ্যসভাতেও এই সাড়ে ৯ বছরে অনেক কঠিন বাধা মোদি উতরেছেন বিরোধী শিবিরকে ছন্নছাড়া রেখে। সেখানেও এই বিল পাস হতো অনায়াসে। অথচ সাড়ে ৯ বছরে এর বিন্দুমাত্র প্রয়োজনীয়তা তিনি উপলব্ধি করেননি। করলেন যখন, দেশ তখন মোটামুটিভাবে ‘ইলেকশন মুড’-এ চলে গেছে।দ্বিতীয়ত, দেবগৌড়া ও মনমোহন সিংয়ের পেশ করা বিল আইন হলে সঙ্গে সঙ্গেই তার সুফল নারী সমাজ পেতে পারত। কিন্তু মোদি সরকারের এই ১২৮তম সংবিধান সংশোধন বিলে জোড়া হয়েছে তিনটি ফেঁকড়া। বলা হয়েছে, বিল আইনে পরিণত হওয়ার পর দেশে জনগণনা হবে। তার ভিত্তিতে লোকসভা ও বিধানসভা কেন্দ্রের সীমানা নতুনভাবে নির্ধারিত হবে। তারপর নির্বাচন কমিশন ঠিক করবে, পাঁচ বছরের জন্য কোন কোন কেন্দ্র নারীদের জন্য সংরক্ষিত হবে। আইন অনুযায়ী এ ব্যবস্থা ১৫ বছর বলবৎ থাকার কথা।এই ফেঁকড়া বা শর্ত দেবগৌড়া-মনমোহনের বিলে ছিল না। মোদি কেন রাখলেন? নারী সংরক্ষণের জন্য জনগণনা তো আবশ্যিক নয়? সীমানা পুনর্বিন্যাসেরও দরকার নেই। তাহলে? কারণটি স্পষ্ট। বিজেপি ও রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের মতো মোদিও চান না এখনই পুরুষশাসিত রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের এক-তৃতীয়াংশে নারীরা থাবা বসান। তাহলে তাঁর দলের পুরুষ প্রার্থীদের ক্ষোভে বিপর্যয় অনিবার্য। অথচ নারীমন জিততে এই ভণিতাটুকু জরুরি। বিশেষ করে এই বছরের পাঁচ বিধানসভা ও পরের বছরের লোকসভা ভোটে। তাই এই ‘ভাবের ঘরে চুরি’।
হালের ভোট-রাজনীতিতে নারীরা পশ্চিমবঙ্গে তরিয়েছেন মমতাকে, বিহারে নীতীশকে, দিল্লিতে কেজরিওয়াল ও কর্ণাটকে কংগ্রেসকে। মোদিও বুঝেছেন, ২০২৪-এ জয়ের হ্যাটট্রিক করতে হলে নারী মহলের বিশেষ সমর্থন প্রয়োজন। না হলে ‘ইন্ডিয়া’র মোকাবিলা কঠিন। ২০১৪ সালে তিনি ছিলেন স্বপ্নের ফেরিওয়ালা। তাঁর রাষ্ট্রীয় স্তরের রাজনীতির সাদা খাতায় কোনো আঁকিবুঁকি ছিল না। ২০১৯ সালে মুশকিল আসান হয়ে উঠেছিল পুলওয়ামা ও বালাকোট। জাতীয়তাবাদের নামাবলির সঙ্গে হিন্দুত্ববাদের মিলমিশ তিনি ঘটিয়েছিলেন চমৎকারভাবে। এবার জ্বলজ্বল করছে ১০ বছরের সাফল্য-ব্যর্থতার খতিয়ান। জমা-খরচের ঘরে অনেক হিসাব, মিল-অমিল-গরমিলের প্রাচুর্য। ‘পারসেপশন’-এরও বদল ঘটেছে নানাভাবে। প্রশ্ন উঠছে হরেক রকম। সবচেয়ে বড় কথা, ১০ বছরে যা হয়নি, এবার সেই লক্ষ্যে বিরোধীরা অটল। ‘ইন্ডিয়া’ তাঁর রাতের ঘুম কেড়েছে। এ সময় একটা চমকের বড় দরকার ছিল তাঁর।সাড়ে ৯ বছর ধরে উপেক্ষিত নারীদের কাছে টেনে তাই বৈতরণি পেরোনোর চেষ্টা। যদিও সেখানেও ছলনার শেষ নেই। শারদ পাওয়ারের কন্যা সংসদ সদস্য সুপ্রিয়া সুলে বলেছেন, বিলটা ‘পোস্টডেটেড চেক’। ঠিকই বলেছেন। তবে সেই চেকেও একটা তারিখ থাকে। এখানে সব আবছা!ভারতের শেষ জনগণনা ২০১১ সালে। ১০ বছর পর ২০২১ সালে পরের গণনার কথা ছিল। কোভিডের জন্য পিছিয়েছে। লোকসভা ও বিধানসভা কেন্দ্রের সীমানা পুনর্বিন্যাসের কাজ ২০২৬ পর্যন্ত বন্ধ। জনগণনায় সময় লাগে দুই বছর। ২০২৪-এর আগে তা হচ্ছে না। পরের বছর শুরু হলে ২০২৭-এর আগে শেষ হবে না। কেন্দ্রগুলোর সীমানা পুনর্বিন্যাস শেষবার হয়েছিল ২০০২ সালে। শেষ হয়েছিল ২০০৮-এ। এবারও সে রকম সময় লাগলে ২০৩৪ সালের লোকসভা ভোটের আগে নারীদের সংরক্ষণের সুবিধা পাওয়ার কথা নয়। সংগত প্রশ্ন, মোদি তাহলে এত তাড়াহুড়া করলেন কেন?এর একটা উত্তর আগেই দেওয়া হয়েছে। এই আইন দেখিয়ে আগামী ভোটে তিনি নারী সমর্থনকে ‘ফোর্স মাল্টিপ্লায়ার’ করতে চাইছেন। সেই কারণে নিজেকে ‘ঈশ্বরপ্রেরিত’ বলে জাহির করেছেন। দ্বিতীয়ত, এই আইনকে এমনভাবে প্রচারের আলোয় তুলে ধরার ছক কষেছেন (সেই কাজ শুরুও হয়ে গেছে), যাতে সরকারবিরোধী প্রচার চাপা পড়ে। জোর করে সহমরণে নিয়ে যাওয়া বধূর আর্তনাদ চাপা দিতে অতীতে এভাবেই সতীর নামে জয়ধ্বনি করা হতো। কাড়া-নাকাড়া বাজানো হতো। বিজেপি ওইভাবেই বেহাল অর্থনীতি, মুদ্রাস্ফীতি, মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব, আইনের শাসনের অনুপস্থিতি, দুর্নীতি, আদানি, সাম্প্রদায়িকতা ও স্বৈরাচারিতার প্রচার চাপা দিতে চাইছে। চাইছে প্রধানমন্ত্রীর ভাবমূর্তি নতুন করে ঘষেমেজে চকচকে করে তুলতে।সুপ্রিয়া সুলের জবানিতে নারী সংরক্ষণ আইন যদি ‘পোস্টডেটেড চেক’ হয়, বঙ্গজ উপমায় তাহলে ‘গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল’। বিরোধী বয়ানে এটাই নরেন্দ্র মোদির নবতম ‘জুমলা’ বা ধাপ্পাবাজি!
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct