বিহারে জাতগণনার রিপোর্ট জনসমক্ষে প্রকাশ করে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার নিজেকে আরও একবার জাতীয় রাজনীতির কেন্দ্রে টেনে আনলেন। সেই সঙ্গে বিপাকে ফেলে দিলেন বিজেপিকে। জাতগণনার ফল প্রকাশিত হওয়ামাত্র বিরোধী মহলের পুরোনো দাবি নতুনভাবে জোরালো হয়েছে। দাবি উঠেছে, নারী সংরক্ষণ আইনের আওতায় অনগ্রসর ও অতি অনগ্রসরদের জন্য আনুপাতিক হারে আসন সংরক্ষণ করতে হবে। লিখেছেন সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়।
বিহারে জাতগণনার রিপোর্ট জনসমক্ষে প্রকাশ করে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার নিজেকে আরও একবার জাতীয় রাজনীতির কেন্দ্রে টেনে আনলেন। সেই সঙ্গে বিপাকে ফেলে দিলেন বিজেপিকে। জাতগণনার ফল প্রকাশিত হওয়ামাত্র বিরোধী মহলের পুরোনো দাবি নতুনভাবে জোরালো হয়েছে। দাবি উঠেছে, নারী সংরক্ষণ আইনের আওতায় অনগ্রসর ও অতি অনগ্রসরদের জন্য আনুপাতিক হারে আসন সংরক্ষণ করতে হবে। মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারের পাশাপাশি আরজেডি নেতা লালু প্রসাদও জাতগণনার রিপোর্ট পেশের সঙ্গে সঙ্গেই জানিয়ে দিয়েছেন, ২০২৪ সালে ক্ষমতায় এসে তাঁরা সারা দেশে জনগণনার সঙ্গে জাতগণনাও করাবেন। কংগ্রেসও একমত। সোনিয়া ও রাহুল গান্ধী বলেছেন, জাতগণনা করা অবশ্যই জরুরি। মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার জানিয়েছেন, শিগগিরই তিনি সর্বদলীয় বৈঠক ডেকে পরবর্তী কর্মসূচি ঠিক করবেন।এত দিন ধরে ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতি করে চলা বিজেপি এই ‘বিহারি চালে’ দৃশ্যতই হতচকিত। খোদ প্রধানমন্ত্রী ছত্তিশগড়ের জনসভায় বিরোধীদের লক্ষ করে বলেছেন, তারা জাতপাত দিয়ে দেশের মানুষদের বিভাজিত করতে চাইছে। তারা গরিব মানুষের ভাবাবেগ নিয়ে খেলছে। ফের শুরু করেছে গরিবি নিয়ে রাজনীতি। বিহারে জাতগণনার ফল গতকাল সোমবার প্রকাশ করা হয়। তাতে দেখা যায়, রাজ্যের মোট ১৩ কোটি ১০ লাখ জনসংখ্যার মধ্যে ৬৩ দশমিক ১ শতাংশ অত্যধিক (এক্সট্রিম) অনগ্রসর (ইবিসি) ও অনগ্রসর (ওবিসি) শ্রেণিভুক্ত। তফসিল জাতির (এসসি) সংখ্যা ১৯ দশমিক ৭ ও তফসিল উপজাতির (এসটি) সংখ্যা ১ দশমিক ৭ শতাংশ। রাজ্যে উচ্চবর্ণ বা ‘জেনারেল কাস্ট’ মানুষ সাড়ে ১৫ শতাংশ।জাতগণনার ফল প্রকাশের পরই নীতীশ কুমার জানিয়েছেন, এবার থেকে রাজ্যের প্রতিটি প্রকল্প তৈরির সময় এই রিপোর্ট বিবেচনা করা হবে। বেশি মানুষ যাতে উপকৃত হন, যাতে সামাজিক ন্যায় হয়, তা দেখা হবে।
মোদি–জমানায় বিজেপির ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতির মোকাবিলায় বিরোধীদের এই জাতগণনার দাবি বড় হাতিয়ার হতে চলেছে। বিরোধীরা মনে করেন, একমাত্র জাতগণনাই দিতে পারে সামাজিক ন্যায়। কোন জাতের মানুষ অর্থনৈতিক ও সামাজিক দিক থেকে কতটা পিছিয়ে, তা বোঝা সম্ভব একমাত্র জাতগণনার মধ্য দিয়েই। জাতগণনা না হলে সংরক্ষণ নীতিও অর্থহীন হয়ে পড়ে। কংগ্রেসসহ অধিকাংশ বিরোধী দল তাই সমস্বরে বলতে শুরু করেছে, সামাজিক ন্যায় সময়ের দাবি। অনগ্রসর, অতি অনগ্রসর, দলিত, তফসিল জাতি ও উপজাতিরা ন্যায্য অধিকার পাওয়ার যোগ্য যা বিজেপি দিতে নারাজ।জাতগণনার দাবি বিহারে বিজেপি–বিরোধী দলগুলোর অনেক দিনের। বিজেপির দোসর হিসেবে মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন নীতীশ কুমার ২০২০ সালে জাতগণনার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রথম সরব হয়েছিলেন। তা নিয়ে তিনি বিধানসভায় এক প্রস্তাবও পাস করান। দোসর হিসেবে বিজেপি তখন তাতে সায় দিয়েছিল। কিন্তু কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপি জাতগণনায় মত দেয়নি। বরং বিরোধিতা করেছিল। ২০২১ সালে নীতীশ কুমার ফের জাতগণনার দাবিতে ১০ দলের প্রতিনিধিদের নিয়ে দিল্লি যান ও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে দাবি রাখেন। কিন্তু কেন্দ্রের সায় পাননি। পরের বছর বিজেপি ছেড়ে বিরোধীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তিনি সরকার গড়েন ও রাজ্যে জাতগণনার নির্দেশ দেন। সে জন্য সরকারি কোষাগার থেকে ৫০০ কোটি রুপিও বরাদ্দ করেন। রাজ্য বিজেপি সেই প্রথম ওই পদক্ষেপের বিরোধিতায় নামে। কিন্তু তাতে লাভ না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত জাতগণনা বন্ধ রাখতে সুপ্রিম কোর্টে একাধিক জনস্বার্থ মামলা দায়ের করা হয়। সে জন্য গণনার কাজ কিছুদিন বন্ধ ছিল। পরে তা শুরু হয়। মামলাকারীদের যুক্তি ছিল, জনগণনা বা এ–সংক্রান্ত কাজ করার একমাত্র অধিকারী কেন্দ্রীয় সরকার। আদালতে বিহার সরকার যুক্তি দেয়, তারা যা করছে তাকে গণনা না বলে ‘সমীক্ষা’ বলা যেতে পারে। সেই যুক্তি আদালত মেনে নেন। সেপ্টেম্বর মাসে গণনার কাজ শেষ হয়। সোমবার প্রকাশিত হয় রিপোর্ট।
ব্রাহ্মণ্যবাদী সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ ও বিজেপি জাতগণনায় কখনো আগ্রহী হয়নি। বর্ণপ্রথায় বিশ্বাসী এই সংগঠন ও রাজনৈতিক দল সাংগঠনিক স্তরে নারীর ক্ষমতায়নেও উৎসাহ দেখায়নি। সংসদে নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা সত্ত্বেও নারী সংরক্ষণ বিল পাসে উদ্যোগী হয়নি। ক্ষমতা লাভের সাড়ে ৯ বছর পর সর্বভারতীয় রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা নরেন্দ্র মোদিকে বাধ্য করে নারী সংরক্ষণ বিল পাস করাতে। যদিও তাতে রয়েছে বহুবিধ শর্ত, যা পূরণ করে কবে আইনটি বাস্তবায়িত হবে, সে বিষয়ে ঘোর অনিশ্চয়তা রয়েছে। নীতীশ কুমারের ‘বিহারি চালের’ পর বিজেপি এখন বেশ বুঝতে পারছে, জাতগণনার দাবি জোরালো করে বিরোধীরা মোট সংরক্ষণে শতাংশের হার বাড়াতে আন্দোলনে নামবে। সেই প্রস্তুতি শুরুও হয়ে গেছে। দাবি জোরালো হলে ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতি ও তার আকর্ষণ স্তিমিত হতে বাধ্য। ভারতের সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুযায়ী মোট সংরক্ষণের মাত্রা ৫০ শতাংশের বেশি হবে না। বর্তমানে সরকারি চাকরি ও শিক্ষায় অনগ্রসর শ্রেণির জন্য সংরক্ষণের হার ২৭ শতাংশ, তফসিল জাতির জন্য ১৫ শতাংশ ও তফসিল উপজাতিদের জন্য সাড়ে ৭ শতাংশ। মোট সংরক্ষণ ৪৯ দশমিক ৫ শতাংশ। দেশে জনগণনার পাশাপাশি জাতগণনা হলে সেই হার একদিন না একদিন বাড়বেই। কারণ, বিহারের জাতগণনা বলে দিচ্ছে রাজ্যে রাজ্যে অনগ্রসর ও অতি অনগ্রসরের হার কতখানি। জেডিইউ, আরজেডি, এসপির মতো স্যোশালিস্ট দলগুলো এই দাবিতে অনেক দিন ধরেই মুখর। এবার কংগ্রেসও তার পুরোনো অবস্থান (জাতগণনায় তারা রাজি ছিল না) থেকে সরে এসে জাতগণনা ও সেই নিরিখে সংরক্ষণের দাবি জানিয়েছে। নারী সংরক্ষণ বিল নিয়ে সংসদে আলোচনার সময় সোনিয়া গান্ধী বলেন, ৩৩ শতাংশ সংরক্ষণের মধ্যে অনগ্রসরদের জন্য আনুপাতিক হারে সংরক্ষণ দিতে হবে। রাহুলও বলেছেন, ২০২৪ সালে ক্ষমতায় এসে তাঁরা সারা দেশে জাতগণনা করাবেন। রাহুল এই পরিসংখ্যানও দিয়ে বলছেন, বিহারে ইবিসি, ওবিসি, তফসিল জাতি ও উপজাতিরাই মোট জনসংখ্যার ৮৪ শতাংশ। কেন্দ্রে মোট সচিবের সংখ্যা ৯০। তার মধ্যে ওবিসি মাত্র তিনজন! অথচ প্রধানমন্ত্রী মোদি নিজেকে বারবার ওবিসি বা অনগ্রসর শ্রেণির প্রতিনিধি দাবি করেন! রাহুলের দেওয়া পরিসংখ্যানের মূল লক্ষ্য মোদিই। বিহারের জাতগণনা অন্য একটি বিষয়ের ওপরেও আলো ফেলেছে। কোভিডের দোহাই দিয়ে ২০২১ সালে সারা দেশের জনগণনা কেন্দ্রীয় সরকার বন্ধ রাখে। কোভিডের ভয়াবহতা কেটে গেলেও জনগণনা করা হয়নি। নীতীশ দেখিয়ে দিলেন সেই সিদ্ধান্ত কতটা অসাড় ছিল। এর আগে কর্ণাটক (২০১৪) ও তেলেঙ্গানা (২০২১) জাতগণনা করালেও তার রিপোর্ট প্রকাশ করেনি। বিহারের দেখাদেখি বিরোধী রাজ্যে জাতগণনা হলে কেন্দ্রের ওপর চাপ বাড়বে। দাবি উঠবে, প্রকল্প তৈরির আগে সামাজিক ন্যায়ের দিকটা বিবেচনা করতে। জাতগণনার সামাজিক অভিঘাতের মোকাবিলা বিজেপি কীভাবে করবে, হিন্দুত্ববাদের প্রকোপ আরও বাড়বে কি না, তা নিয়ে আগ্রহ বাড়ছে।
সৌ: প্র: আ:
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct