সজল মজুমদার: ঙালি তথা সমগ্র ভারতবাসীর কাছে প্রথম সারির উৎসবগুলির মধ্যে শারদ উৎসব, দীপাবলি অন্যতম। বছর শেষে সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষ নানান ধরনের কর্মব্যস্ততার শেষে উৎসবমুখর ওই দিনগুলোতে পরিবারের সকলকে নিয়ে কাটানোর মাধ্যমে পরবর্তী সময়ে নিত্যদিনের কর্ম সম্পাদন করবার জন্য যেন আলাদা রসদ খুঁজে পায়।জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সমস্ত মানুষেরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে উৎসবগুলোর আনন্দ উদ্দীপনা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়। আনন্দ উচ্ছ্বাসের পারদ ক্রমাগত বাড়ার মধ্য দিয়ে কচি কাচা, কিশোর থেকে যুবরা বিভিন্ন প্রকারের আতশবাজি, পটকা পুড়িয়ে নিজেদের উদ্দীপনার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। কিন্তু এই আতশবাজি পটকা পরিবেশ মানুষ এবং প্রাণীদের উপর ভয়ংকর ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলে থাকে। আসলেই যেকোনো ধরনের আতশবাজি এবং পটকা স্থানীয় এলাকার বায়ু দূষণ এবং শব্দ দূষনের অন্যতম প্রধান কারণ। চিরাচরিত প্রায় সব আতশবাজি, পটকাতেই কপার ,ক্যাডভিয়াম জিংক ,সীসা ,ম্যাগনেসিয়াম সোডিয়াম ,বোরিয়াম নাইট্রেট এসব ধাতব খনিজ থাকে। যেগুলো প্রত্যেকটিই আমাদের চরম স্বাস্থ্যহানি ঘটাতে পারে। আতশবাজি ,পটকা পোড়ানোর ফলে ক্ষণিক সময়ের মধ্যেই বাতাসে ধাতব পদার্থ, ক্ষতিকর টক্সিন, বিষাক্ত রাসায়নিক এবং কালো বা সাদা ধোঁয়া মিশ্রিত হয়। এই বিষাক্ত ধোঁয়া মানব দেহের সংস্পর্শে আসামাত্রই পরবর্তীতে হাঁপানি, হার্ট অ্যাটাক, ফুসফুসের রোগ, শ্বাসকষ্ট, স্নায়ু ঘটিত রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটায়। তবে শুধুই কি মানুষ!! আতশবাজি ,পটকা পোড়ানোর ফলে বিভিন্ন ধরনের প্রাণী, পাখিরাও পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। কুকুর, বিড়াল এসব প্রাণীরা অত্যন্ত সংবেদনশীল হয়।বাজি ,পটকা পোড়ানোর মুহূর্তে এরা খানিকটা ভীত হয়ে পড়ে, এদের শ্রবণ যন্ত্রেও তার প্রভাব পড়ে। তা সত্ত্বেও বাজি পটকা তো আমাদের পোড়াতেই হবে!! পুজোর সময় বলে কথা!! কিন্তু পুজো, উৎসবে কি বাজি পটকা পোড়ানো খুবই প্রয়োজনীয়!!? এসব বিষয় নিয়েই কথা হচ্ছিল জলপাইগুড়ির সাইন্স এবং নেচার ক্লাবের সম্পাদক তথা উত্তরবঙ্গের বিশিষ্ট বন্যপ্রাণ বিদ ড: রাজা রাউথের সঙ্গে। তিনি এই বিষয়ে বিশদে জানালেন। তিনি বললেন, “ আতশবাজি, পটকা বৈধভাবে বিক্রি ছাড়াও অবৈধ পথেও বিক্রি হয়ে থাকে। তাছাড়া প্রত্যেকটা জীবের একটা নিজস্ব সহন ক্ষমতা আছে। সেই সহ্য ক্ষমতার বাইরে গিয়ে এসব বাজিগুলো ফাটানো হয়। যার জেরে মানুষরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, বিশেষ করে বর্তমান সময়ে নানান কারণে মানুষ নিরাপত্তাহীনতা, অনিশ্চয়তায় ভুগছেন। তাছাড়াও মানুষের ঠিকমতো কাজকর্ম নেই, রোজগার ঠিকমতো হচ্ছে না, মানসিক ও শারীরিক বিভিন্ন অশান্তিতে মানুষ জর্জরিত, এরকম অবস্থায় উৎসবের মরশুমে বাজি ,পটকা ফাটালে অনেক সময় সরাসরি মানুষের হৃদপিণ্ড প্রভাবিত হতে পারে। শ্রবণ ক্ষমতাও কমে যেতে পারে। বাজি, পটকা থেকে নির্গত ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ বায়ুতে মিশে বায়ুকেও দূষিত করে তোলে। প্রাণীরাও বাজি ,পটকাতে ভীষণভাবে বিচলিত হয়। এই সময় প্রচুর পাখি মারা যায়। প্রাণীদের প্রজনন ক্ষমতার উপর একটা কু - প্রভাব ফেলে। এমনকি পতঙ্গ শ্রেণীর প্রাণীরাও মৃত্যুবরণ করে। তাই আনন্দের বহিঃপ্রকাশ করবার জন্য আমি বলতে চাই, বাজি পোড়ানোর চলটাই বন্ধ করা দরকার। তার বিনিময়ে আলোক ছটা ছড়ানো, প্রদীপ জ্বালিয়ে সীমাবদ্ধভাবে সকলে আনন্দ ভাগ করে নেওয়াই শ্রেয়। দ্বিতীয়তঃ পরিবেশবান্ধব বাজি বা গ্রীন বাজি তৈরির উপর জোর দেওয়া প্রয়োজন। এইজন্য সরকারি তরফ থেকে বাজি উৎপাদন কারখানাগুলোর সাথে কথা বলে বিশেষ ভর্তুকি দিয়ে কম দামে বাজারে গ্রীন বাজি আনলে অনেকটাই ভালো হয়। শুধু তাই নয়, বাজি উৎপাদন কারখানাগুলোতে সরকারি তরফ থেকে নিয়মিত নজরদারি, তদারকি প্রয়োজন। “অপরদিকে বাজি, পটকা পোড়ানো নিয়ে দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার সুপরিচিত সমাজকর্মী প্রদীপ সাহার সাথেও এই বিষয়ে কথা হচ্ছিলো। তিনি এই প্রসঙ্গে জানালেন, “ একজন আমজনতা হিসেবে বলতে চাই, মানুষ ও জীবজন্তু দুটো ক্ষেত্রেই বাজি, পটকার চরম ক্ষতিকারক প্রভাব রয়েছে। বিশেষ করে বয়স্ক মানুষদের এর ফলে হঠাৎ করে হৃদযন্ত্র বিকল হয়েও যেতে পারে। অনেক ক্ষেত্রেই আবার কৌতূহলবশত পটকা ফাটিয়ে অনেককে পশুদের বিরক্ত করতেও দেখা যায়। তবে এক্ষেত্রে গ্রীন বাজিতে যেসব রাসায়নিক উপাদান রয়েছে সেগুলো মানুষ, পশু, পরিবেশের পক্ষে তুলনামূলক কম ক্ষতিকর, তাই আনন্দ উৎসবে গ্রীন বাজি পোড়ানোর জন্য বিশেষ প্রচার চালানো প্রয়োজন। সাথে সাথে বিষাক্ত ধোঁয়াযুক্ত শব্দবাজি নিজের স্বার্থে, পরিবারের স্বার্থে, সমাজের স্বার্থে , সর্বোপরি পরিবেশের স্বার্থে বর্জন করা উচিত।” প্রসঙ্গত গ্রীন বাজি বা পরিবেশবান্ধব বাজি তৈরীর পরিকল্পনা ২০১৮ সালে Council for Scientific and Industrial Research সংস্থার অধীনে National Environmental and Engineering Research Institute গ্রহণ করেছিল। গ্রীন বাজিতে মূলত বোরিয়াম নাইট্রেটের বদলে পটাশিয়াম নাইট্রেট ও অ্যালুমিনিয়াম দেওয়া হয়। যেটা কম ক্ষতিকারক। পাশাপাশি শব্দ মাত্রা ১০০-১৩০ ডেসিবেল এর মধ্যেই থাকে। সুতরাং সব শেষে বলতে হয়, পুজোর মরশুমে সকলেই আনন্দে মেতে উঠুক, কিন্তু সেটা অন্যের পক্ষে হানিকারক, দুঃখজনক যেন না হয়ে দাঁড়ায়। পাশাপাশি সাময়িক সময়ের জন্য হলেও পরিবেশও যেন সুস্থ থাকে। তাই আসুন, পূজোর মরশুমে আমাদের চিন্তাশীল ,সচেতন মনকে আরো প্রসারিত করে আতশবাজি, পটকা মুক্ত আনন্দ উৎসবে সকলে, সমবেতভাবে মেতে উঠি।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct