এম ওয়াহেদুর রহমান : রাধীন ভারতের রঙ্গমঞ্চে আবির্ভূত হয়েছিলেন ভারতীয় স্বাধীনতা-যজ্ঞের অন্যতম পুরোহিত মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী ওরফে ‘মহাত্মা গান্ধী ‘কিংবা ‘বাপুজী ‘। তিনি দিশেহারা পথভ্রান্ত মানুষ কে দীক্ষিত করেছিলেন নবজীবনের মহামন্ত্রে। ভারতের আপামর জনতা কে তিনি জাতীয়তাবোধের প্রবল উন্মাদনায় মাতিয়ে তুলেছিলেন। নব জাগ্ৰত জাতির হাতে তিনি তুলে দিয়েছিলেন এক অমোঘ অস্ত্র - ‘অহিংসা ‘। তিনি রক্তের বদলে রক্ত চান নি কিংবা আঘাতের প্রত্যুত্তরে প্রত্যাঘাতের কথা ও বলেন নি। তিনি চেয়েছিলেন আত্মত্যাগের মহানব্রতে দেশবাসী কে উদ্বুদ্ধ করতে। তাঁর অহিংসা দুর্বলের মুখোশ নয়, নয় ভীরুর নিরুপায় হুংকার, এ এক দুর্জয় শক্তি সাধনা। তিনি বিশ্বাস তথা অহিংসা নীতির ভিত্তিতেই শতাব্দী প্রাচীন সাম্রাজ্যবাদের ভীত নাড়িয়ে দিয়েছিলেন সর্বোপরি ভারতীয়দের মধ্যে স্বাধীনতার বীজ বপন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাই তিনি ক্ষমতার অলিন্দে না থেকে ও আজও হাজার হাজার মানুষের মনের গহীনে কিংবা হৃদ মাঝারে রাজত্ব কায়েম করে চলেছেন। তিনি দেশবাসীকে স্বাধীনতা সংগ্রামে যেমন উদ্বুদ্ধ করছেন তেমনি তিনি দেশবাসীকে পুনরায় স্বরাজ ও স্বনির্ভরতা অর্জনের জন্য ও অনুপ্রাণিত করেছেন। আজকে আমরা যে সকল সমস্যার সম্মুখীন সেই প্রেক্ষিতে গান্ধীজির এই দৃস্টিভঙ্গী অত্যান্ত প্রাসঙ্গিক। তাঁর জীবন কর্মই ছিল অনুপ্রেরণার উৎস। আমরা আজকে যে সমাজ ব্যবস্থায় বসবাস করছি, এখানে আমাদের উদ্দেশ্যই হলো অন্যকে প্রভাবিত করা। কিন্ত গান্ধীজির আদর্শ ছিল কিভাবে অন্যকে অনুপ্রাণিত করা যায়। আজকের স্বার্থমগ্ন সমাজ জীবনের প্রায় সর্বক্ষেত্রেই গান্ধীজির মূল্যবোধ গুলো মানবতার সুরক্ষায় দিশা দেখায়।
বিশ্বশান্তি তথা অহিংসার উজ্জ্বল ও বিরলতম ব্যাক্তিত্ব হলেন গান্ধী। তিনি ভারতের অন্যতম প্রধান রাজনীতিবিদ। অর্থাৎ তিনি ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্ৰগণ্য ব্যাক্তিদের মধ্যে অন্যতম একজন প্রভাবশালী নেতা। তিনি ছিলেন সত্যাগ্ৰহ আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা এই সত্যাগ্ৰহ ছিল ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম চালিকাশক্তি। এই আন্দোলন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল অহিংস মতবাদ বা দর্শনের উপর। তাঁর অহিংস নীতিকে স্বীকতি দিতেই তাঁর জন্মদিন ২ রা অক্টোবর কে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ ২০০৭ সালের ১৫ জুন সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সাধারণ সভা আন্তর্জাতিক অহিংসা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। অহিংসার মধ্যে কোনরকম স্বার্থপরতা, তিক্ততা, অহংবোধ থাকে না। তাঁর সত্যাগ্ৰহ হলো এক সুসংহত জীবন দর্শন। সত্যাগ্ৰহ হলো আত্মিক শক্তি। তাঁর নেতৃত্বে ভারতব্যাপী তিনটি অবিস্মরণীয় গণ আন্দোলন হয়েছিল - অসহযোগ আন্দোলন,আইন অমান্য আন্দোলন অর্থাৎ গান্ধীর ঐতিহাসিক ডান্ডি অভিযান, এবং ভারত ছাড়ো আন্দোলন। রাজনৈতিক চিন্তা জগতের আঙিনায় তিনি কিছু অভিনব কৌশল সৃষ্টি করেছিলেন, যেমন সর্বোদয় তত্ব, যার অর্থ হলো সকলের কল্যাণ। তিনি এই সর্বোদয় তত্বের ক্ষেত্রে তিনটি বিষয়ের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন - সমষ্টির কল্যাণের মাঝেই ব্যাক্তির কল্যাণ নিহিত,জীবিকা অর্জনের অধিকার সকলের সমান,ও ধর্মভিত্তিক জীবনই হলো সার্থক জীবন। তাই তিনি রাস্ট্র ক্ষমতা কে সংকুচিত করে ‘গ্ৰাম স্বরাজের ‘উপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। এই গ্ৰাম স্বরাজই হলো আজকের আধুনিক ভারতের পঞ্চায়েত ব্যাবস্থার মূল ভিত্তি। তিনি পুঁজিবাদ ও অর্থনৈতিক স্বৈরতন্ত্র - উভয়েরই বিরোধী ছিলেন। তিনি সামাজিক সম্পতিকে ব্যাক্তিগত বা রাস্ট্রীয় মালিকানাধীনে রাখার বিরোধী ছিলেন। এই সামাজিক ধনসম্পদ কে তিনি ‘অছি’র অধীনে রাখার সুপারিশ করেছেন। তিনি সর্ব ধর্মের প্রতি ছিলেন শ্রদ্ধাশীল। দেশের জন্য তাঁর ত্যাগ ও ভালোবাসা, স্বাধীনতা ও উন্নয়নের জন্য আমৃত্যু সংগ্ৰাম সর্বোপরি সুদৃঢ় জাতীয়তাবাদ, এই মানুষটিকে মহামানবে পরিণত করেছে।বর্তমান সমস্যা সঙ্কুল সমাজের বিশেষতঃ স্বার্থমগ্ন ও ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার প্রেক্ষাপটে গান্ধীজির আদর্শ কর্ম আজকের দিনে ও অত্যান্ত প্রাসঙ্গিক। তাঁর অহিংসা, শান্তি ও সেবার আদর্শ ভারত তথা সমগ্র বিশ্বের মনুষ্য সমাজ কে পথ দেখাবে। বর্তমান বিশ্বের প্রায় সকল সমস্যা সমাধানে গান্ধীজির চিন্তাধারা হয়তো অনেক টাই ফলপ্রসূ হবে। তাঁর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ধারণা আজকের দিনে খুব গুরুত্ব বহন করে। মানবতা যতদিন বেঁচে থাকবে তাঁর আদর্শ গুলি ও প্রভাবিত হতে থাকবে। তাঁর আদর্শ, জীবন, শিক্ষা আজ ও অনুকরণীয়। তাঁর অহিংস আন্দোলন, মানবতাবাদী দর্শন, ধর্মীয় সহিষ্ণুতা কেবল ভারতে নয় সমগ্ৰ বিশ্বের জন্য এক আলোকবর্তিকা। ভারত তথা বিশ্ব জাহানের মনুষ্য জগতের মাঝে আজকের দিনে ও তাঁর অহিংস, সর্বোদয়, গ্ৰাম স্বরাজের নীতি সমাহারে অম্লান ।
মতামত লেখকের নিজস্ব...
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct