মধ্যযুগের এশিয়া ও ভারতের ইতিহাস রচনার ব্যক্তিত্বদের মধ্যে অন্যতম আবু ওমর মিনহাজ উদ্দিন উসমান ইবনে সিরাজ উদ্দিন আল জুযজানি। তিনি ৬৫৮ হিজরি/১২৫৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মধ্য এশিয়া ও ভারতের মুসলিম শাসকগোষ্ঠীর সাধারণ ইতিহাস বিষয়ক একটি অসাধারণ ইতিবৃত্ত লেখেন। তিনি মিনহাজ সিরাজ নামেই সমধিক পরিচিত। তাকে নিয়ে আলোকপাত করেছেন ফৈয়াজ আহমেদ।
মধ্যযুগের এশিয়া ও ভারতের ইতিহাস রচনার ব্যক্তিত্বদের মধ্যে অন্যতম আবু ওমর মিনহাজ উদ্দিন উসমান ইবনে সিরাজ উদ্দিন আল জুযজানি। তিনি ৬৫৮ হিজরি/১২৫৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মধ্য এশিয়া ও ভারতের মুসলিম শাসকগোষ্ঠীর সাধারণ ইতিহাস বিষয়ক একটি অসাধারণ ইতিবৃত্ত লেখেন। তিনি মিনহাজ সিরাজ নামেই সমধিক পরিচিত। প্রথিতযশা এই ব্যক্তিত্বকে নিয়ে আজকে আমাদের এই আয়োজন। প্রথম পর্ব তথা এই পর্বে আমরা জানব মিনহাজ সিরাজ কে ছিলেন, সাথে তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনের ওপরও সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করা হবে। দ্বিতীয় পর্বে আমরা তাঁর কালজয়ী সৃষ্টি তাবাকাত ই নাসিরি সম্পর্কে বিশদে জানব। চলুন তবে শুরু করা যাক!
মিনহাজ সিরাজ তাঁর ফার্সি ভাষায় লেখা রচনাবলীর বিভিন্ন অংশের বর্ণনায় নিজের ও পরিবার সম্বন্ধে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিবেশন করেছেন। তিনি বলেন, তার তৃতীয় প্রজন্মের পূর্বপুরুষ ইমাম আবদুল খালিক জুজান (মার্ভ ও বলখের মধ্যবর্তী একটি জায়গা) থেকে গজনি এসেছিলেন। গজনিতে তিনি শাসক ইব্রাহিমের কৃপা লাভ করেন এবং তার চল্লিশ কন্যার একজনের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। এদের বংশধর মাওলানা সিরাজুদ্দিন মোহাম্মদ তাজিক হলেন তাবাকাত ই নাসিরির লেখক মিনহাজ সিরাজের পিতা। সিরাজউদ্দিন মোহাম্মদ তাজিককে ১১৮৬ খিস্টাব্দ/৫৮২ হিজরিতে মুহম্মদ ঘুরি সেনাবাহিনীর কাজে নিয়োগ করেন। তিনি আজু বাতুজ জামান আফসাহুল আজম খেতাব লাভ করেন। জানা যায়, তিনি মাকরান হয়ে বাগদাদ যাবার পথে দস্যুদের আক্রমণে মৃত্যুবরণ করেন।
মিনহাজ সিরাজও তার পিতার ন্যায় প্রতিভাধর ব্যক্তি ছিলেন। তিনি ৬২৪ হি./১২২৭ খ্রিস্টাব্দে ঘুর থেকে সিন্ধু, উচ ও মুলতান আসেন। এসময়ে তিনি জ্ঞান-বিজ্ঞানে সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন বিধায় উচের ফিরূজি কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পান। এর পরের বছর অর্থাৎ ১২২৮ খ্রিস্টাব্দে সুলতান ইলতুৎমিশ যখন নাসির উদ্দিন কুবাচার বিদ্রোহ দমনে আসেন, তখন তার সাথে মিনহাজের সাক্ষাৎ ঘটে এবং এ সুবাদে তার সঙ্গী হয়ে দিল্লি চলে আসেন। ৬২৯ হিজরিতে সুলতানের গোয়ালিয়র অবরোধেও তিনি তার সফরসঙ্গী ছিলেন। সুলতান প্রথমে তাকে গোয়ালিয়রের অন্যতম দরবার-প্রচারক হিসেবে নিয়োগ দিলেও শীঘ্রই তাকে আইন কর্মকর্তা ও সকল ধর্মীয়, নৈতিক ও বিচার সংক্রান্ত বিষয়াবলির পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেন।
সুলতান রাজিয়ার আমলে (১২৩৬ খ্রি. – ১২৪০ খ্রি.) তিনি এ পদ ত্যাগ করেন। তবে মুইজ উদ্দিন বাহরাম শাহের (১২৪০ খ্রি. – ১২৪২ খ্রি.) সিংহাসনারোহণ উপলক্ষ্যে অভিনন্দন বার্তা রচনায় ও মোঙ্গল অনুপ্রবেশ অভিযানে দিল্লিতে যখন সন্ত্রস্ত অবস্থা বিরাজ করছিল, তখন মানুষের মনে প্রশান্তি ও অনুপ্রেরণা জোগানোর জন্য তাকেই আহবান জানানো হয়।
১২৪১ খ্রিস্টাব্দে সুলতান বাহরাম শাহ মিনহাজকে রাজধানী দিল্লি ও এর সকল অধীনস্ত অঞ্চলের জন্য কাজি হিসেবে নিয়োগ দেন। বেশি দিন তিনি এ পদে আসীন থাকেননি। সুলতানকে অপসারণ করা হলে তিনিও ৬৩৯ হি./১২৪১ খ্রিস্টাব্দে চাকুরি থেকে ইস্তফা দেন এবং বাংলার রাজধানী লক্ষ্মেীতির দিকে রওয়ানা হন। বাংলায় তিনি দু’বছর (১২৪৩-৪৫ খ্রিস্টাব্দ) অবস্থান করেন। এখানে অবস্থানকালে তিনি বিশ্বস্ত সূত্রে মুসলিম শাসিত প্রত্যন্ত অঞ্চল সম্পর্কে বস্তুনিষ্ঠ তথ্য সংগ্রহের অসাধারণ সুযোগ লাভ করেন।
৬৪৩ হিজরির শুরুতে তিনি পুনরায় দিল্লি পৌঁছেন। সঙ্গে সঙ্গে তাকে নাসিরিয়া কলেজের অধ্যক্ষ এবং এর যাবতীয় সম্পত্তির তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। তাকে গোয়ালিয়রের কাজি ও এর পৌর মসজিদের ইমাম হিসেবেও নিযুক্ত করা হয়। ১২৪৬ খ্রিস্টাব্দে সুলতান নাসির উদ্দিনের সিংহাসনারোহণ উপলক্ষ্যে তিনি যে অভিনন্দন বার্তা রচনা করেছেন তা তাঁর গ্রন্থে সংযোজিত। তিনি সুলতান নাসির উদ্দিন এবং বিশিষ্ট অভিজাত উলুঘ খান-ই-মুয়াজ্জাম অর্থাৎ গিয়াস উদ্দিন বলবনের (১২৬৬ খ্রি. – ১২৮৬ খ্রি.) কাছ থেকে অনেক উপঢৌকন ও স্বীকৃতি লাভ করেন। তিনি ইনাম হিসেবে একটি গ্রাম বরাদ্দ পান। পরিশেষে তিনি সদর-ই-জাহান খেতাবপ্রাপ্ত হন এবং পুনরায় তাকে রাষ্ট্রের কাজি ও রাজধানীর ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়।
মূলত পৃষ্ঠপোষক সুলতান নাসির উদ্দিনের (১২২৭-২৯ খ্রি.) নামেই মিনহাজ তাঁর বইয়ের নামকরণ করেন। সুলতানের উত্তরাধিকারীকে তিনি যে স্তুতিমূলক অভিধায় উল্লেখ করেন তাতে এ বিশ্বাস জন্মে যে, তাঁর লেখা পরবর্তী সুলতান অর্থাৎ গিয়াস উদ্দিন বলবনের সময়ে প্রকাশিত হয়।
সিরাজের লেখনী ছিল ফার্সি ভাষায় অতি সরল, অবিকৃত রচনাশৈলী। এর ভাষা অধিকতর শুদ্ধ। লেখক উচ্চমাত্রার স্তুতিমূলক বক্তব্য পরিবেশনায় নিজেকে বেশি নিয়োজিত করেননি। বরঞ্চ সহজ ও সরলভাবে সরাসরি ঘটনাসমূহ বিবৃত করেছেন। লেখক বিশ্বস্ত ব্যক্তিবর্গের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহে পরিশ্রমের স্বাক্ষর রেখেছেন। তিনি কখনো কখনো তার তথ্য উৎসের তথা প্রামাণিকতার উল্লেখ করেছেন। কতিপয় ক্ষেত্রে নির্ভুল সন ও তারিখ উপস্থাপন করেছেন। ফলে পরিবেশিত বক্তব্যে তাঁর আন্তরিকতা, জ্ঞানের নির্ভুলতা ও বস্তুনিষ্ঠতা বিষয়ে আস্থার মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে।
এতদসত্ত্বেও, অনেক ক্ষেত্রে মিনহাজের উপস্থাপনা অপ্রতুল। সমালোচকদের দৃষ্টিতে, তাঁর পরিবেশিত অনেক ইতিহাস এত সংক্ষিপ্ত যে, তা কোনো ব্যবহারে আসে না। গ্রন্থকার পাঠককে হতাশ করেন যখন কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তিনি অধিকতর বিস্তৃত তথ্য সংগ্রহ ও উপস্থাপন করতে পারতেন, কিন্তু তিনি তা না করে সেসব অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত করেছেন।
এক্ষেত্রে ১২৪৫ খ্রিস্টাব্দে বিশেষ করে লক্ষ্মণাবতীর ভৌগোলিক সীমানা বা দেয়াল পর্যন্ত চেঙ্গিস খান বাহিনীর আগমনের কথা দৃষ্টান্ত হিসেবে উপস্থাপন করা যায়। তাঁর রচনার আরেকটি ত্রুটি পরিলক্ষিত হয় পরিকল্পনায়। মুখ্যত তাবাকাত পদ্ধতিতে রচিত হলেও নাসির উদ্দিন মাহমুদ থেকে লেখক বর্ষভিত্তিক ইতিহাস উপস্থাপনার রীতি অনুসরণ করেছেন। আবার একাধিক জায়গায় একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। নাসির উদ্দিনের শাসনকাল ও গিয়াসউদ্দিন (উলুঘ খান) এর জীবনালেখ্য পরিবেশনায় একই ঘটনা ভিন্ন ভিন্ন বিবরণীতে ঠাঁই পেয়েছে। ফলে একদিকে বংশভিত্তিক কালবিভাজন বাধাগ্রস্ত হয়েছে, অন্যদিকে তারিখ উল্লেখে অসংলগ্নতা ঘটেছে। একই ব্যক্তি বা ঘটনার ক্ষেত্রে মাঝে মাঝে ভিন্ন ভিন্ন তারিখ পরিদৃষ্ট হয়। উদাহরণস্বরূপ, সুলতান গিয়াস উদ্দিন ও তার ভাই মুইজ উদ্দিন ঘোরির হাতে খসরু মালিকের মৃত্যুর দুটো তারিখ যথাক্রমে ৫৯৮ হিজরি ও ৫৮৭ হিজরি উল্লেখের কথা বলা যায়। প্রথম তারিখ দেয়া হয়েছে ঘোরি বংশের বর্ণনায় আর দ্বিতীয় তারিখ গজনবি বংশের বর্ণনায়।
বাংলার মুসলিম শাসনের প্রাথমিক পর্যায়ের ইতিহাস-তথ্য সরবরাহে তাবাকাত ই নাসিরি এক বিশেষ স্থান দখল করে রয়েছ। এর লেখক বাংলায় দু’বছর (১২৪৩–৪৫ খ্রি.) অবস্থান করে দেশ ও শাসক সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করেন। তিনি জাজনগর (ত্রিপুরা) ও কাটাসিন (উড়িষ্যা) রাজন্যবর্গের বিরুদ্ধে ৬৪১ হিজরিতে মালিক তুঘরিল তুঘান খান পরিচালিত অভিযানে তার সঙ্গী ছিলেন। মুসলিমদের লক্ষ্মণাবতী জয়, রাজধানী স্থাপন ও তৎপরবর্তী ঘটনা বর্ণনায় গ্রন্থটি খুবই বিশ্বস্ত।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct