অভিনয় ও কৌশল সব সময়ই রাজনীতির অংশ ছিল। আজকের বিশ্বে সম্ভবত তা আরো বেশি! নিখুঁত ‘রাজনৈতিক অভিনেতা’ হিসেবে আমরা রোমান অধিপতি নিরোর নাম বলি কথায় কথায়; কিন্তু তিনিই কি একমাত্র রাষ্ট্রনায়ক, যার নামের সঙ্গে এই তকমা লেপ্টে আছে? এই প্রশ্নের উত্তর গল্পে-ঘটনায় মিলিয়ে দেখা যাক। লিখেছেন মেরি বিয়ার্ড।
অভিনয় ও কৌশল সব সময়ই রাজনীতির অংশ ছিল। আজকের বিশ্বে সম্ভবত তা আরো বেশি! নিখুঁত ‘রাজনৈতিক অভিনেতা’ হিসেবে আমরা রোমান অধিপতি নিরোর নাম বলি কথায় কথায়; কিন্তু তিনিই কি একমাত্র রাষ্ট্রনায়ক, যার নামের সঙ্গে এই তকমা লেপ্টে আছে? এই প্রশ্নের উত্তর গল্পে-ঘটনায় মিলিয়ে দেখা যাক।নিরোর অন্যতম প্রিয় শখ ছিল ‘অভিনয়’। তিনি যে পাকা অভিনেতা হিসেবে নাট্যমঞ্চ কাঁপাতেন, তেমন কথা শোনা যায়নি। তবু অভিনেতা হিসেবে নিরোর নাম ছড়িয়ে পড়তে থাকে সাম্রাজ্য জুড়ে। তার অভিনয় নিয়ে চলতে থাকে আলোচনা-সমালোচনা।নিজের অভিনয় পারদর্শিতার কথা মানুষের মধ্যে প্রচার করতে বিশেষ কৌশলও আঁটতেন নিরো। তার উদ্দেশ্য সফলও হয়! আগেকার জামানার বিখ্যাত সব নাটক ও শোর সঙ্গে নিজের মতো করে নিরো নতুন কিছু সংযোজন করতেন এবং সেগুলোই আওড়াতেন অভিনয়ের মঞ্চে! এসব পাঁচমিশালি কাজ দেখে যে কেউই বুঝতে পারত নিরোর অভিনয়কর্মের ধরনধারণ! লক্ষ করার বিষয়, প্রধান চরিত্রে হলেও তিনি কখনো নিয়মিত ও পেশাদার অভিনেতাদের সঙ্গে অভিনয় করতেন না। এর কারণ, নিরো সম্ভবত চাইতেন না, তিনি ছাড়া লাইমলাইটে অন্য কেউ আসুক!নিরোর অভিনয়ের প্রথম ও প্রধান শো মঞ্চস্থ হয় নেপলসে। সময়টা ছিল ৬৪ খ্রিষ্টাব্দ। এখানেও কৌশল খাটান নিরো! তার চিন্তা ছিল, শিল্পকর্মের নগরী হিসেবে প্রসিদ্ধ শহরে নাট্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করলে তা রাতারাতি প্রচার পাবে দূর-দূরান্ত পর্যন্ত। মজার ব্যাপার হলো, এ ক্ষেত্রে নিরো সফল হন এবং তাঁর অভিনীত নাটকও শেষ হয় সফলভাবে। কিন্তু বিপত্তি বাঁধে অন্যখানে। নিরো যেই না অভিনয় শেষ করে মঞ্চ থেকে নেমে যান, সঙ্গে সঙ্গে ভেঙে পড়ে থিয়েটার মঞ্চ!এ ঘটনায় অনেকে বলতে শুরু করেন, এটা একটা জলজ্যান্ত দৃষ্টান্ত, যা দেখে বুঝে নিতে হবে, দেবতারা সম্রাট নিরোর অনাচারের প্রতি খুশি নন মোটেই। দেবতারা চান নিরো আর অভিনয় না করুক, খামখেয়ালিপনা বাদ দিক।জনগণ যাই বলুক না কেন, নিরো এক ধাপ এগিয়ে প্রচার করতে থাকেন—‘এই বিপর্যয়ে যেহেতু কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি এবং আমি আমার অভিনয় সম্পূর্ণরূপে শেষ করতে পেরেছি, সুতরাং এটাই প্রমাণিত হয় যে, দেবতারা আমার পক্ষেই আছেন।’পরে তার অভিনয় নিয়ে যত কথাই উঠুক না কেন, সেসবে কর্ণপাত করেননি নিরো। রোমের এক হোটেলের বাগানের মাটি খুঁড়তে গিয়ে সম্প্রতি নিরোর হাতে নির্মিত পুরোনো এক থিয়েটার মঞ্চ আবিষ্কার করেছেন প্রত্নতাত্ত্বিকেরা, যা নিরোর খেয়ালি অভিনয়জীবনের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। শুধু তাই নয়, এই থিয়াটার মঞ্চের খুঁটিনাটি দেখে খুব ভালোমতো আন্দাজ করা যায়, অভিনয়ের প্রশ্নে কতটা স্বেচ্ছাচারী ছিলেন রোমান অধিপতি!৬৭ খ্রিষ্টাব্দ তথা নিরোর রাজত্বের শেষের দিকের কথা। ‘অভিনয়প্রতিভা’ ছড়িয়ে দিতে গ্রিসে পাড়ি জমান তিনি। অ্যাথলেট, যুদ্ধরথ রেসার ও যথারীতি অভিনেতা হিসেবে গ্রিসের মাটিতে নিজেকে প্রকাশ করতে চেষ্টা চালান। এই লক্ষ্যে গ্রিসের হেন কোনো খেলা নেই, যেখানে নাম লেখান না রোমান সম্রাট! মজার কথা হলো, প্রতিটি প্রতিযোগিতায় প্রথম হতেন তিনি! কি খেলাধুলা, কি অভিনয়—প্রতিটি ক্ষেত্রে নিরো হয়ে ওঠেন ‘অপ্রতিদ্বন্দ্বী’! তার সামনে যেন কেউ দাঁড়াতেই পারত না!
নিজেকে সব সময় ‘প্রথম ও সর্বসেরা’ হিসেবে দেখতে চাওয়া এই রোমান অধিপতি যে অনেকের বিরাগভাজন হয়ে উঠেছিলেন, তা এতক্ষণে সবার বুঝে যাওয়ার কথা। বাস্তবিক অর্থেই নিরোর কর্মকাণ্ডে ব্রিবত বোধ করতেন রোমের প্রথম সারির ব্যক্তিবর্গ। খ্যাতনামা লেখক থেকে শুরু করে ইতিহাসবিদ—নিরোর ওপর ভেতরে ভেতরে ক্ষুব্ধ ছিলেন প্রায় সবাই। এ নিয়ে বহু ব্যঙ্গাত্মক লেখালেখিও চলত। অর্থাত্, সম্রাটের কর্মকাণ্ডের বিরোধিতায় সোচ্চার ছিলেন দেশবাসী। সমালোচকেরা এমন আওয়াজও তুলতেন, ‘নিরোকে রোমান সম্রাট হিসেবে স্বীকার করা অনুচিত।’লোকজনের এসব কথাবার্তার প্রতি-উত্তর আসত না সম্রাট নিরোর মুখ থেকে। এর কারণ, তিনি বেশ ভালো করেই জানতেন, কী সব করে বেড়ান তিনি! একজন সম্রাটের পক্ষে যে নিঃস্ব ভিক্ষুকের চরিত্রে অভিনয় করা মানায় না, আর যাই হোক, এটা বুঝতে না পারার কথা নয় সম্রাটের!নিরোর অভিনয়জীবন নিয়ে কেন এত কথা? শোনা যায়, সম্রাট নিরো যখন পারফর্ম করতেন, তখন থিয়েটার থেকে বের হওয়া দর্শকদের জন্য একদম বারণ ছিল! শো শেষ না হওয়া পর্যন্ত কেউ হলরুম ত্যাগ করতে পারবে না—রোমান সম্রাটের ফরমান ছিল এরকমই। এমনকি কেউ মারা গেলেও নয়! জনগণও কম যায় না। নিরোর এ ধরনের ‘অযাচিত অত্যাচার’ থেকে বাঁচতে অনেকেই মরার ভান করতেন! এবং থিয়েটার থেকে লাশের খাটিয়ায় চড়ে বের হয়ে দিতেন ভো দৌড়!এমনও জনশ্রুতি আছে, দর্শকদের মধ্যে বসা অনেক গর্ভবতী নারী সন্তান প্রসব করতে বাধ্য হতেন থিয়েটার রুমে বসেই! অভিনয় দেখতে মন না দিয়ে মাথা হেলানো-দুলোনোতে ব্যস্ত থাকার কারণে বহিষ্কার পর্যন্ত করা হয়েছিল রোমের ভাবী সম্রাট ভেসপাসিয়ানকে!শুধু যে নিজের লোকজনের ওপর স্বেচ্ছাচারিতা চালাতেন নিরো, তা নয়; গ্রিসে যখন নিরোর সঙ্গে এক ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতায় গ্রিসের শাসক অবতীর্ণ হন, তখন গ্রিসের রাজা প্রথম হলেও বিজয়ীর তালিকায় নাম ওঠে নিরোর! অথচ নিরো দৌড় শেষ করেননি মাঝ রাস্তা অবধিও!রোমান সম্রাট নিরোকে নিয়ে যেসব গল্প বলা হলো এবং তাকে নিয়ে এরকম যেসব গল্প প্রচলিত আছে, সেগুলো কতটা সত্য, তা জানা মুশকিল। আবার এসব ঘটনাকে হালকা করে দেখা বা ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেওয়ারও সুযোগ কম। নিরো যে ‘অভিনেতা’ ছিলেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই! তবে প্রকৃতপক্ষে তিনি কী কারণে অভিনয় থেকে বের হতে চাইতেন না, আজকের দিনে তা নিয়ে যেসব আলাপ-আলোচনা চলে, তা ইঙ্গিত দেয় ‘অন্য কিছুর’!
যত কথাই বলা হোক না কেন, যত যুক্তিই দাঁড় করানো হোক না কেন, অভিনয়ের প্রতি নিরোর অতি আবেগের এই গল্পগুলোতে ‘ভিন্ন ও তাত্পর্যপূর্ণ’ কিছুর গন্ধ পাওয়া যায়! এবং একধরনের রূঢ় বাস্তবতা রয়েছে গল্পগুলোর পরতে পরতে। সম্ভবত বড় ধরনের বিতর্ক এবং রাষ্ট্রের উদ্বেগজনক ঘটনাগুলো থেকে দৃষ্টি সরিয়ে রাখতে অভিনয়ের পথ বেছে নিয়েছিলেন সম্রাট! রোমান সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক ব্যবস্থা কতটা ভঙ্গুর, ছলনায় ভরা ছিল, সেসব নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ রয়েছে এসব ঘটনার বিচারে।বাস্তব সত্য হলো, আমাদের নেতারা মাঝেমধ্যে যেসব বিস্ময় জাগানোর মতো কর্মকাণ্ড করে বসেন, আমাদের প্রজন্মই তার প্রথম ও একমাত্র সাক্ষী নয়। ঋষি সুনাকের দিকে যদি আমরা দৃষ্টি দিই, তবে কী দেখতে পাই? অন্যান্য বিশ্বনেতার দিকে তাকালেও কি আমরা দেখতে পাই না যে, বড়বড় সব নেতা অন্যের লেখা স্ক্রিপ্ট দেখে দেখে হুবহু নকল করে চলেছেন? নিরোর অভিনয়জীবনের খণ্ডিত গল্পগুলোর দিকে দৃষ্টি দিলেই এর প্রমাণ মিলবে।প্রাচীন রোমে মঞ্চে পারফরম্যান্স ছিল সাম্রাজ্য বিস্তারের শক্তির প্রতীক! রূপক, সঠিক কিংবা ভুলভাবে হলেও রাষ্ট্রের বহু ঘটনা চিত্রিত হতো নিরোর প্রদর্শনীগুলোতে! ‘রোম যখন পুড়ছিল, তখন ঠিকই বুঝতে পারা যাচ্ছিল, কতটা নড়বড়ে ছিল রাষ্ট্রের কাঠামো!’ বর্তমানে বিশ্ব জুড়ে নিরোর কৃতকর্ম নিয়ে লেখালেখি, কার্টুন, নাটক-সিনেমা প্রদর্শিত হয় নিয়মিতভাবে। কিন্তু আমরা কি কখনো ভেবে দেখেছি, নিরোর মতো করেই অভিনয় ও কৌশল অবলম্বন করে চলার পথে হাঁটছেন বহু রাষ্ট্রনায়ক?এমন অনেক রাজনীতিবিদ আছেন আজকের বিশ্বে, যারা রাষ্ট্রীয় সংকটের মাঝখানে দাঁড়িয়েও জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে ব্যঙ্গ করার সাহস করেন! সংকটের মহাসাগরে দাঁড়িয়েও ‘অভিনয়’ চালিয়ে যাচ্ছেন সমানতালে! বলসোনারো থেকে শুরু করে বারাক ওবামা—সবার ক্ষেত্রেই এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না। বারাক ওবামাকে যখন গল্ফ খেলায় মজে থাকতে দেখা গেছে, তখন কি সংকটের মাঝ সমুদ্রে ক্রমাগতভাবে নিমজ্জিত হচ্ছিল না যুক্তরাষ্ট্র? ক্রমবর্ধমান হারে যখন জাতীয় ঋণের আগুন পুড়িয়ে মারছিল ওয়াশিংটন ডিসিকে, তখন কি মহাসুখে ছিল দেশটি? এরকম বহু গল্পের উদাহরণ টানা যাবে, যেখানে রাষ্ট্রের গভীর সংকটের সময়ও অভিনয়ের পথ বেছে নিয়েছিলেন অধিপতিরা! বর্তমান বিশ্বের রাষ্ট্রনায়কদের এসব অভিনয় একেকটি প্রাচীন গল্পের নতুন রূপে ফিরে আসা যেন!কথিত আছে, রোম শহর অগ্নিদগ্ধ হওয়ার খবরে প্রথম দিকে নিরো কেবল মজাই করেননি, উপরন্তু জ্বলন্ত শহরকে তিনি তার অভিনয়-অনুষ্ঠানের মঞ্চ-সেট হিসেবে ব্যবহারের খায়েশের কথা ঘোষণা করেছিলেন দ্ব্যর্থহীন চিত্তে! সত্যি বলতে, বর্তমান বৈশ্বিক বাস্তবতা হলো, জাতীয় সংকটের দৃশ্যপটে দাঁড়িয়েও বেশির ভাগ রাজনীতিবিদ জনগণের সঙ্গে মজা করে চলেছেন! সুতরাং, আমরা শুধু নিরোকে দোষ দিলে কি তার ওপর অবিচার করা হয় না? বর্তমান বিশ্বনেতাদের অনেকেই ধোয়া তুলসীপাতা নন!
লেখক: কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক
দ্য গার্ডিয়ান থেকে অনুবাদ: সুমৃৎ খান সুজন
সৌ: ইত্তে:
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct