যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর কয়েকটি সদস্য দেখতে চেয়েছিল, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি রাশিয়ার সঙ্গে শান্তির পথে যেতে পারেন কি না। কিন্তু সেই প্রচেষ্টা হাতছাড়া হয়েছে। ভলোদিমির জেলেনস্কি জাতিসংঘ ও ওয়াশিংটন সফরে গেছেন, যাতে যুদ্ধ চালিয়ে নেওয়ার মতো সমর্থন তিনি আদায় করে নিতে পারেন। সুনির্দিষ্টভাবে এই সফরে মার্কিন কংগ্রেসে ইউক্রেনকে সামরিক খাতে নতুন করে সহায়তার জন্য যে ২৪ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার দেওয়ার প্রস্তাব উঠেছে, সেটার যাতে অনুমোদন মেলে, সেই চেষ্টা করবেন।মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদে যেকোনো অর্থবিল পাস হয়। এ মুহূর্তে কেন্দ্রীয় তহবিল থেকে এত বড় অঙ্কের অর্থ ছাড় করা কঠিন।বাইডেন প্রশাসন ইউক্রেনের জন্য প্রতিশ্রুত সহায়তার ১৩ দশমিক ১ বিলিয়ন সামরিক সহায়তা, ৮ দশমিক ৫ বিলিয়ন মানবিক সহায়তা এবং ২ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার বিশ্বব্যাংকের মাধ্যমে সহায়তার জন্য অনুরোধ করেছে।কিয়েভ ছাড়ার আগমুহূর্তে জেলেনস্কি তাঁর ছয়জন উপ-প্রতিরক্ষামন্ত্রীকে দুর্নীতির অভিযোগে বরখাস্ত করেন। এই পদক্ষেপ এটা প্রমাণ করে যে বাইডেন প্রশাসন খোলা হাতে ইউক্রেন সরকারকে যে সহায়তা দিয়ে চলেছে, তার একটা বড় অংশ গায়েব হয়ে যাচ্ছে। ইউক্রেনকে দেওয়া সহায়তার ঠিকমতো ব্যয় হচ্ছে কি না, সেটা নিরীক্ষার পথ বন্ধ করে রেখেছে বাইডেন প্রশাসন।এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে যেকোনো শান্তি প্রচেষ্টার বিরোধিতা করা হয়েছিল। কিন্তু সেটা যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো অস্ত্র-গোলাবারুদের ভান্ডার ফুরিয়ে আসার আগের ঘটনা। একই সঙ্গে পুতিনকে ছুড়ে ফেলার চেষ্টার আগের ঘটনা। ব্যর্থতার খেসারত হিসেবে ওয়াশিংটন ও ন্যাটো ইউক্রেনীয় বাহিনীকে অস্ত্র তুলে দিয়ে রাশিয়ার প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে ভেঙে দিতে চেয়েছে।কিন্তু বাস্তবে প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ভাঙার ক্ষেত্রে বিরাট কোনো সাফল্য আসেনি। ইউক্রেনের এরই মধ্যে তাদের কৌশলগত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মজুত বাহিনীকে ক্ষতিগ্রস্ত করে ফেলেছে। জাপোরিঝঝিয়া ফ্রন্টে ২৫তম এয়ার মোবাইল ও ৮২তম এয়ার অ্যাসল্ট—গুরুত্বপূর্ণ এ দুটি ব্রিগেডের অনেক সৈন্য ও সরঞ্জাম খুইয়েছে। এ দুটি ব্রিগেডের বেশির ভাগ অস্ত্র ও সাঁজোয়া যান দিয়েছিল ন্যাটো। তা সত্ত্বেও যুদ্ধে পারদর্শিতা দেখাতে না পারায় তাদের প্রত্যাহার করে নিতে হয়েছে।অন্যদিকে যুদ্ধ যদি নতুন ফ্রন্টে বিস্তার হয়, সেটা হবে ইউক্রেনের জন্য ভয়ংকর। তাদের এখন এমনিতেই জনবল ও সামরিক রসদের সরবরাহে ঘাটতি রয়েছে। ইউক্রেনের বর্তমান সরকারের সেই চাপ নেওয়ার সক্ষমতা কতটা রয়েছে, সেটা কেউই জানে না। ইউক্রেনের কতজন সেনা শেষ পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যেতে চাইবেন, সেটাও পরিষ্কার নয়।ইউক্রেনের পাল্টা আক্রমণ যত দীর্ঘায়িত হচ্ছে, ততই তাদের জনবল ও সামরিক সরঞ্জাম দরকার পড়ছে। প্রতিবেদন বলছে, ইউক্রেনীয় বাহিনী প্রতিদিন এক হাজারের বেশি সেনা হারাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর কয়েকটি সদস্যের এটা ভালো করে জানা উচিত যে ইউক্রেন যে সামরিক কৌশল নিয়েছে, সেটা আসলে কাজ করছে না। যদিও ন্যাটোর সরবরাহ করা গোয়েন্দা তথ্য ও অন্যান্য উপাত্তের ওপর ভিত্তি করেই সামরিক কৌশল প্রণয়ন করে ইউক্রেন।যেকোনো দেশ কিংবা ব্যক্তি একটি শান্তি পরিকল্পনা দিতে পারে অথবা মধ্যস্থতা করতে এগিয়ে আসতে পারে—এ ধরনের কয়েকটি প্রচেষ্টা প্রাথমিক পর্যায়েও আছে। ইউক্রেনের দিক থেকে কয়েকটি শর্ত আছে।
এক. ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে ইউক্রেন কোনো আলোচনায় যাবে না। তবে রাশিয়ার সঙ্গে তারা আলোচনা করতে পারে। ইউক্রেন সরকার এ বিষয়ে ফরমান জারি করেছে, যেখানে সই করেছেন জেলেনস্কি।দুই. কোনো পরিস্থিতিতেই ইউক্রেন তাদের এক ইঞ্চি ভূমিও কারও কাছে ছেড়ে দেবে না। ক্রিমিয়া থেকে দনবাস—কোনো অঞ্চলই তারা ছাড় দেবে না। যদিও প্রথম পর্যায়ে ক্রিমিয়ার ব্যাপারে আলাপ-আলোচনায় সম্মত ছিল কিয়েভ।তিন. ইউক্রেনের দাবি হলো, রাশিয়ান সব সৈন্যকে ইউক্রেনের ভূখণ্ড ছাড়তে হবে। পুতিনসহ সব যুদ্ধাপরাধীকে বিচারের আওতায় আনতে হবে।চার. ন্যাটোর কাছে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা অথবা সদস্যপদ চায় ইউক্রেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যপদও চায় কিয়েভ, কিন্তু মাঝপথেই সেটা থমকে আছে। যুক্তরাষ্ট্র কিয়েভের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেওয়ার জন্য কাজ করছে দাবি করলেও বাস্তবে সেই প্রচেষ্টায় স্থবিরতা এসেছে।এই ফাঁকে ইউক্রেন ন্যাটোর কাছে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রসহ দূরপাল্লার অস্ত্র চেয়েছে, যাতে রাশিয়ার ভূখণ্ডে তারা হামলা চালাতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এমজিএম-১৪০ এটিএসিএমএস ক্ষেপণাস্ত্র এবং জার্মানির কাছে টাওরাস ক্ষেপণাস্ত্র চেয়েছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানির কেউই এ ধরনের অস্ত্র দিতে এখন পর্যন্ত সাড়া দেয়নি। যাহোক, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ডেপুটি সেক্রেটারি ভিক্টোরিয়া ন্যুল্যান্ড ইউক্রেন যাতে রাশিয়ার অতি মূল্যবান স্থাপনা লক্ষ্যবস্তু করে হামলা চালাতে পারে, সে জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন। ন্যুল্যান্ডের প্রচেষ্টা যদি জয়ী হয়, তাহলে এমজিএম-১৪০ এটিএসিএমএস ক্ষেপণাস্ত্র ইউক্রেন পাবে।বাস্তবে সেটা ঘটলে যুদ্ধের ক্ষেত্রে রাশিয়ার যে উদ্দেশ্য, তাতে প্রভাব ফেলবে। রাশিয়া এখন দনবাস, খেরসন, জাপোরিঝঝিয়া অঞ্চল ও ক্রিমিয়াতে বেশির ভাগ লড়াই কেন্দ্রীভূত রেখেছে। কিন্তু রাশিয়ার নেতারা বারবার করে বলছেন, ইউক্রেনে সরকার পরিবর্তন, ওদেসাসহ অন্য শহরগুলোতে যুদ্ধের বিস্তার ঘটাতে। সেটা করতে হলে রাশিয়াকে সেনাবাহিনীতে আরও সেনা নিয়োগ দিতে হবে এবং নতুন নতুন অস্ত্র ও গোলাবারুদ তৈরি করতে হবে।অন্যদিকে যুদ্ধ যদি নতুন ফ্রন্টে বিস্তার হয়, সেটা হবে ইউক্রেনের জন্য ভয়ংকর। তাদের এখন এমনিতেই জনবল ও সামরিক রসদের সরবরাহে ঘাটতি রয়েছে। ইউক্রেনের বর্তমান সরকারের সেই চাপ নেওয়ার সক্ষমতা কতটা রয়েছে, সেটা কেউই জানে না। ইউক্রেনের কতজন সেনা শেষ পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যেতে চাইবেন, সেটাও পরিষ্কার নয়।যুদ্ধ অব্যাহত থাকায় যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরেও অসন্তুষ্টি বাড়ছে। এই যুদ্ধ চীন ও রাশিয়ার মধ্যে নতুন করে মৈত্রী বাড়াচ্ছে এবং সামরিক রসদের ভান্ডার শূন্য করে দিচ্ছে। এতে এশিয়ার ক্ষেত্রে অসুবিধায় পড়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে তাইওয়ানের প্রয়োজনীয় অস্ত্র সরবরাহ করতে দেরি হচ্ছে।মার্কিন কংগ্রেসকে মানিয়ে জেলেনস্কি যুদ্ধের জন্য আরও অর্থ বরাদ্দ করে নিতে সক্ষম হয়েছেন। কিন্তু এটাই তাঁর জন্য হয়তো শেষ উল্লাস।
স্টিফেন ব্রায়েন সেন্টার ফর সিকিউরিটি পলিসি অ্যান্ড ইয়র্কটাউন ইনস্টিটিউট
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
সৌ: প্র: আ:
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct