যে ছায়ায় আলোর মায়া
আহমদ রাজু
‘তুই কি সত্যিই আমাকে চিনতে পারছিস না কাকন।’‘আমার আপু মারা গেছে বহু বছর আগে। কমপক্ষে দুই যুগ তো হবেই।’ কাকন যত সহজে কথা বলছে মনটা ঠিক ততটায় কঠিণ হয়ে প্রশ্ন উত্তরের দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছে।‘কী সব পাগলামো কথা? আমাকে তোরা তো পাগল করে দিবি মনে হচ্ছে। আমি তোর কাকলি আপুই।’হামিদ গাজী বলল, ‘আমার মেয়ে মারা গেছে বহু বছর আগে। এখন বিদায় হয়ে আমাদের উদ্ধার করো। এমনিতে খুব পেরেশানিতে আছি আমরা।‘আব্বা আমি আপনার মেয়ে কাকলি।’হামিদ গাজী ভয়ে ভয়ে দুইহাত করজোড়ে বলল, ‘আবারো বলছি, আমার মেয়ে মারা গেছে বহু বছর আগে। দেখলেতো গ্রামবাসী তোমাকে দেখে কীভাবে পালিয়ে গেল!’‘আমি যে আপনার মেয়ে কীভাবে প্রমাণ করবো বলুন?’‘কোন প্রমাণ লাগবে না আমার। আচ্ছা, তোমাকে মলয় শেখের লোকেরা পাঠায়নি তো?’‘ও তাইতো, আপনাকে তো বলাই হয়নি; কালকে কেউ আমার মাথায় বাড়ি দিয়ে জঙ্গলের পোড়ো বাড়িতে ফেলে দিয়ে এসেছিল। দেখেন এই যে, এখানে।’ বলে সামনে ঝুকে মাথার কাটা দাগ দেখায় কাকলি। ঠিকইতো মাথার কাটা দাগ এখনও স্পষ্ট।হাবলুর রাগ বাড়তে থাকে। সে খেঁকিয়ে ওঠে, ‘ও মানুষ না; নিশ্চয় টিকটিকি। আমাদের নামে বদনাম করার জন্যে এখানে এসেছে।’হামিদ গাজী বলল, ‘দেখো মেয়ে, তুমি যেখান থেকে এসেছো সেখানে ফিরে যাও। এসব মন ভুলানো কথা আমাকে বলে লাভ নেই।’‘আব্বা আমি আপনার মেয়ে কাকলি। আমি মরিনি- বেঁচে আছি।’‘তোমার বয়স দেখো- আর আমাদের বয়স দেখো- কাননের বয়স দেখো। এ দেখে যদি মনে হয় তুমি আমার মেয়ে তাহলে মেনে নেবো। আর হ্যাঁ, আমার মেয়ে মারা গেছে বহু বছর আগে। তাকে গ্রামবাসী মিলে যথাযোগ্য মর্যাদায় কবর দিয়েছিলাম।’‘আমার পরনের কাপড় দেখুনতো মনে পড়ে কী না?’‘তোমার পোশাক কী দেখবো? তোমাকে দেখেইতো মনে হয় বহু পুরোনো অতীত থেকে এসেছো। আমাদের অতীতের কোন প্রয়োজন নেই। আমরা বর্তমান আর ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবি। এখন তুমি বিদায় হও।’ হামিদ গাজী মুখে যতটা সহজে কথা বলছে মনে তার ভয় ঠিক ততটায় দানা বেঁধেছে।ভীড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিল নিতাই দর্জি। সে বলল, ‘গাজী ভাই, আমার ভাল করে মনে আছে, জাপানি টরে দিয়ে পোশাক বানানোর জন্যে আপনি নিজেই আমার কাছে অর্ডার দিয়েছিলেন। আমি কথাটা ভুলতে পারিনি এতদিন। কারণ, আমার দর্জি জীবনের প্রথম দিনই এই পোশাকটি আপনি নিজেই অর্ডার দিয়েছিলেন। পোশাকটার হয়তো রঙ বোঝা যাচ্ছে না, তবে আমার যে বানানো তা প্রথম দেখায় বুঝে ফেলেছি।’দর্জির কথায় আর কথা বাড়ায় না হামিদ গাজী।‘আপনি আমাকে কেন চিনতে পারছেন না আব্বা? নাকি অন্য কোন কারণ আছে?’ভয় ও শঙ্কা স্থায়ীভাবে দানা বাঁধে হামিদ গাজীর মনে। সে থতমত খেয়ে বলল, ‘সব মিথ্যা। আমার মেয়ে মারা গেছে তেইশ বছর আগে।’ নিজেকে সংযত করে কথাটি বলল হামিদ গাজী।
এত ভুল কীভাবে হতে পারে? মাত্র একটা দিনের ব্যবধানে এত পরিবর্তন! নিজের বাবা বৃদ্ধ হয়ে গেল! ময়েন কাকা- রশিদ দাদা...। কী হচ্ছে এসব! তাছাড়া আব্বা কেন বলছে আমি মারা গেছি! সে নিজের হাতে চিমটি কাটতেই দেখে ধূলো-ময়লার তার হাতের রঙটাই পরিবর্তন হয়ে গেছে। সে হতবাক হয়ে এপাশে-ওপাশে তাকিয়ে নিজের শরীর দেখে। পরনের পোশাক পঁচে কয়েক জায়গায় ছিঁড়ে গেছে! মুখে-চুলে হাত দেয়। মসৃণ মুখে-ঠোঁটে ধার ধার অনুভূত হয়। চুলে জট বেঁধেছে! কী অদ্ভুত ঘটনা ঘটছে নিজের সাথে?‘আব্বা এ নিশ্চয় পুলিশের চর। এই তুই বের হ আমাদের গ্রাম থেকে।’ তেড়ে এসে কথাটি বলে হাবলু। তাকে ঠেকায় কাকন। ‘বড় ভাই এত উত্তেজিত হচ্ছিস কেন? যদি পুলিশের চর হয় তাহলে সমস্যা কোথায়?’হাবলুর রাগ চরম আকার ধারণ করে। সে উত্তেজিত হয়ে বলল, ‘ওসব তুই বুঝবি না। এই চল।’ বলে কাকলির হাত ধরে টানতে টানতে মাঠের ওপারের রাস্তার মোড়ে দিয়ে যায়। কাকলি অনেকবার নিজেকে ছাড়াতে চেষ্টা করেও পারে না। সে আর একবার হেরে যায় পারিপার্শ্বিক অবস্থার কাছে। হাবলুকে হামিদ গাজী ঠেকাতে চেষ্টাও করে না। যেন কিছুই হয়নি। কাকলি তার মেয়ে নয়- এই গ্রামের কেউ নয়। উপস্থিত কেউ কেউ অবশ্য বলেছিল, তাকে এভাবে গ্রাম থেকে বের করে না দিতে। কার কথা কে শোনে। হাবলু গায়ের জোরেই কাজটা করে যেন গৌরাবান্বিত বোধ করে। সে সবার কথা না শুনলেও হামিদ গাজীর কথা অবশ্যই শুনতো। অথচ হামিদ গাজী সেখানে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে।কাকনের মনটা বার বার কেন যেন বলে ফিরছে, ও নিশ্চয় তার কাকলি আপু। সেই মায়া ভরা মুখ- চিতল হরিণ চোখ- কথা বলার ঢং ভুলবে কেমন করে? আবার তার মৃত্যুটাকে অস্বীকার করার উপায় নেই। সে পুর্বজন্ম বিশ্বাস করে বরাবরই। আর এই বিশ্বাসের জোরেই মনে প্রশ্ন জাগে- কাকলি আপুর পুনর্জন্ম হয়নি তো? বড়দের মুখের ওপর তর্ক করতে শেখেনি ছেলেবেলা থেকে কাকন। তাইতো কাকলিকে টেনে হিঁচড়ে বড় ভাই গ্রাম থেকে বের করে দেওয়ায় জোরালো প্রতিবাদ করতে পারে নি। সবাই যে যার বাড়ি চলে গেলে কাকন মাঠের ওপারে যায় যেখানে কাকলিকে ছেড়ে দিয়ে এসেছিল। না নেই- কোত্থাও সে নেই। এদিক-ওদিক যতদূর চোখ যায় কাউকেই দেখতে পায় না। তবে কী সে চলেই গেল! বিষণ্ন মন নিয়ে যখন বাড়ি ফিরে আসে তখন হঠাৎই আকাশে কালো মেঘে ছেয়ে চারিদিক অন্ধকার হয়ে আসে। কোনরূপ পূর্ব সতর্কতা ছাড়াই শুরু হয় তুমুল ঝড় বৃষ্টি। সামান্যর জন্যে ভিজে নেয়ে একাকার। সে নিজের ঘরে যেয়ে পোশাক পাল্টে খাটের ওপর বসলেও বিষণ্নতা তাকে অক্টোপাসের মতো ঘিরে ধরে। এই ঝড়-বৃষ্টিতে বোনটা তার না জানি কোথায় আছে- কী করছে? বেশ কিছুক্ষণ পরে বারান্দায় একটা শব্দ হওয়ায় ঘরের বাইরে যেয়ে দেখে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে কাকলি! কাকলিকে দেখে কাকন যেন ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে। অথচ এই কাকলিকে নিয়েই তার দুশ্চিন্তা বৃহৎ আকার ধারণ করেছিল। সে কিছুতেই যেন ভুলতে পারছিল না তার মুখ।‘তুইও কী আমাকে...।’ কাকলিকে কথা শেষ করতে না দিয়ে কাকন বলল, ‘আমি বুঝতে পারছি না কী হচ্ছে এসব!’‘আমি তোর বোন। তুই অন্তত বিশ্বাস কর।’‘বর্তমান অবস্থায় কীভাবে বিশ্বাস করবো? বিজ্ঞান এমন কিছু সমর্থন করে না।’‘আমি জানি না তুই কি বলছিস। কোন বিজ্ঞান ফিজ্ঞানের হিসাবে আমি যাবো না। তবে তুই যে আমার ভাই এটা কেউ বদলাতে পারবে না।’‘আপু তুমি তাহলে এত বছর কোথায় ছিলে? তোমার শরীরের অবস্থা এমন কেন? তাছাড়া তোমার লাশ...’কাকনের কথা শেষ না হতেই কাকলি বলল, ‘কাকন, ভাই আমার, ঘরে যেতে বলবি না? নাকি তুইও সবার মতো আমাকে ভয় পেয়ে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিতে চাচ্ছিস?’
কাকনের কেন যেন কান্না পায়। তার চোখ জলে ভরে ওঠেছে ইতিমধ্যে। বলল, ‘ছিঃ ছিঃ আপু; কী বলছো এসব! আসো ঘরে আসো।’ বলে কাকলিকে নিয়ে ঘরে যায়। পড়ার টেবিল লাগোয়া চেয়ার টেনে দিয়ে কাকন বলে, ‘বসো আপু।’ চেয়ারে বসে কাকলি। কাকন খেয়াল করে বাইরে যেহেতু ঝড় বৃষ্টি অবিরাম চলছে, এক ফোটাও পানি কাকলির গায়ে লাগেনি! তার মনে খটকা লাগে। কিন্তু কেন? সে ভিজতে ভিজতে ঘরের বারান্দায় যখন আসে তখন কেউ সেখানে ছিল না। অবশ্য ছিল না বললে ভুল হবে, একটা কুকুর বৃষ্টির পানি থেকে বাঁচার জন্যে বারান্দায় শুয়েছিল; কাকনকে দেখে সে আস্তে আস্তে বারান্দা থেকে নেমে ভিজতে ভিজতে সামনের দিকে চলে যায়। কাকন যদিও কুকুরটাকে তাড়াতে চায়নি কিন্তু কুকুরটা নিজের ইচ্ছায় নেমে চলে গিয়েছিল স্পষ্ট মনে আছে তার। এমনকি শতভাগ নিশ্চিত, বারান্দায় কেউই ছিল না। আর বৃষ্টির তেজ এমন, চালের তলা- গাছের তলা যেখানেই থাকুক না কেন ভিজতে তাকে হবেই। তাহলে কাকলির গায়ে কেন পানির একটা ফোঁটাও লাগেনি? মনে বিভিন্ন প্রশ্নের উদয় হলেও কোন প্রশ্নকে প্রশ্রয় দেয় না কাকন। সে জানে, যা কিছু হবে তা অবশ্যই প্রকৃতির নিয়মেই হবে। তবে অতি প্রাকৃত ঘটনা যে পৃথিবীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। মনে মনে ভাবে কাকন।‘কাকন, আমাকে একটা কথা বলতো। অবশ্য তোকে দেখে মনে হচ্ছে ত্রিশ বছর পার হয়ে গেছে আরো অনেক আগে। তুই-তুমারি করা যদিও ঠিক হচ্ছে না তবুও তুইতো আমার ছোট ভাই।’ বলল কাকলি।কাকন ঠোঁটের কোণে কিঞ্চিৎ হাসির রেখা ফুটাতে চেষ্টা করে বলল, ‘যা কিছু করি না কেন, তুমিতো আমার বড় আপু। কী কথা বলো?’ উৎসুক প্রশ্ন কাকনের।‘তুই হঠাৎ এত বড় হয়ে গেলি কী করে বলতো?’‘কী বলো আপু! শুধু কী আমার বড় হওয়াটাই দেখলে? ঢাকা বিশবিদ্যালয় থেকে পড়াশুনা শেষ করে নামকরা একটা প্রতিষ্ঠানে গবেষক হিসাবে নিয়োজিত রয়েছি সেটা কী জানো?’‘কী বলিস তুই! এক রাতে এতকিছু ঘটে গেল?’বিস্ময়ে চোখ কপালে তোলে কাকন। তখনও ঠিক একই কথা বলেছিল। কিন্তু কেন? এই ‘এক রাত’ এর অর্থ কী? কৌতুহল আর ধরে রাখতে পারে না সে। বলল, ‘তখনও এই এক রাতের কথাটা বলেছিলে। আসলে এই এক রাত বলতে কী বুঝাতে চাচ্ছো?’ ‘আগে বল, তোদের এই আকাশ-পাতাল পরিবর্তন হলো কীভাবে? এমনকী ছোট ছোট গাছগুলো কেমন যেন ইয়া বড় বড় হয়ে গেছে! ও আর একটা কথা, আব্বা বলছিল, আমি নাকি মারা গেছি! তোরাওতো বলেছিস। একথা কেন?’‘তুমি কী সত্যিই কিছু বুঝতে পারছো না আপু?’‘নারে; একদম না।’‘তোমার নিজের দিকে কী একবার তাকিয়ে দেখেছো? তোমার সারা শরীরে ময়লার স্তর জমে গেছে। চুলে ইয়া বড় জট। কাপড় পঁচে খসে পড়ার উপক্রম। যেন বহু বছর তাকে স্পর্শ করাই হয়নি।’‘আমিতো কিছুই বুঝতে পারছি না।’‘তোমার কী মনে আছে, আমাকে শেষ কী কথা বলে গিয়েছিলে?’‘আছে তো। সেতো গতকাল সকালে। বলেছিলাম- তোরা খেলতে থাক, আমি যাবো আর আসবো।’‘তুমি কি এসেছিলে?’‘আসবো কী করে- পানি খাবার জন্যে বাড়ি এসেছিলাম। তারপর হঠাৎ মাথায় একটা আঘাত লাগায় বেহুশ হয়ে পড়ি। চোখ মেলে দেখি জঙ্গলের পোড়ো বাড়িতে আমি। ওখানে কীভাবে গেলাম- কে আমাকে নিয়ে গিয়েছিল তা জানিনা।’বিস্ময় কাকনকে মোহাচ্ছন্ন করে তুলছে একটু একটু করে। অজান্তেই তার হাত- পা হীম হয়ে আসে। ‘তারপর কী হলো?’ উৎসুক প্রশ্ন কাকনের।‘তারপর আর কী, ঘুম ভাঙতেই হাঁটতে হাঁটতে যখন গ্রামে পা রাখি তখনই বুঝতে পারলাম সব উলট পালট। মনে হয় কত বছর যেন ঘুমিয়ে ছিলাম।’‘সত্যিই তাই আপু। এরই মধ্যে তেইশ বছর কেটে গিয়েছে।’‘কী বলিস তুই!’ বিস্ময়ে মহাবিস্মিত কাকলি। ‘এটা কীভাবে সম্ভব?’‘তা বলতে পারবো না আপু। তবে এটাই সত্য। রসায়নে এমন কোন ব্যাখ্যা পাইনি। তবে হ্যা, যদি তোমার কথা সত্যি হয়, তাহলে ঐ পোড়ো বাড়িতে তোমার লাশ পাওয়া, তাকে কবর দেওয়া, সেটা কী?’‘আবার সেই লাশ! ব্যাপারটা কী বলতো?’
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct