বছর ১৭ আগে আমি যখন ইন্টারন্যাশনাল রিলেশন্স অ্যান্ড ইউরোপিয়ান স্টাডিজ (আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও ইউরোপীয় পাঠ) বিষয়ে মাস্টার্স করছিলাম, তখন ‘ইউরোপীয় মূল্যবোধ’ কথাটার খুব চল ছিল। আমার মনে আছে, সেই সময়টাতে অধ্যাপক ও শিক্ষার্থীরা ইউরোপীয় মূল্যবোধ শুধু ইউরোপিয়ান ইউনিয়নেই (ইইউ) নয়, বরং তার বাইরেও ব্যাপক গুরুত্ব বহন করে বলে বিশ্বাস করতেন।ইইউ সম্প্রসারণের প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ওই সময়টায় ইউরোপীয় মূল্যবোধ ও ইউরোপীয় মান বজায় রাখার বিষয়গুলো বারবার সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে উপস্থাপন করা হচ্ছিল। মধ্য ইউরোপ ও বাল্টিক অঞ্চলের ১০টি দেশকে ২০০৪ সালে নতুন সদস্য হিসেবে নিয়ে ইইউ যখন নিজেকে সম্প্রসারিত করেছিল, আমি ঠিক তার পরের সময়কার কথা বলছি। নতুন ইইউ সদস্য হওয়া রাষ্ট্রগুলো থেকে আসা আমার সহপাঠীদের তখন খুব আনন্দিত মনে হচ্ছিল। তাঁরা তাঁদের দেশের নতুন ভবিষ্যৎ নিয়ে উচ্ছ্বসিত ছিলেন।এমনকি আমার জন্মভূমি বসনিয়ার মানুষও ইউরোপের একীভূত হওয়াকে ইতিবাচকভাবে নিয়েছিল। সেখানকার নাগরিকেরা এটিকে তাঁদের যুদ্ধপরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার একটি অন্যতম সহায়ক শক্তি হিসেবে দেখেছিলেন। বসনিয়ার মানুষ তখন ইইউতে যোগ দেওয়াকে ইউরোপীয় মূল্যবোধ ও মানকে গ্রহণ করে নেওয়ার সমার্থক মনে করছিলেন। তাঁরা মনে করছিলেন, বসনিয়া ইউরোপীয় মূল্যবোধকে আত্মস্থ করলে তা বসনিয়ার সমস্যাগুলোর সমাধান করবে। তাঁরা মনে করছিলেন, বসনিয়া ইউরোপীয় মূল্যবোধকে গ্রহণ করলে তার বিনিময়ে ব্রাসেলস পূর্ণ সদস্যপদ দিয়ে দেশটিকে পুরস্কৃত করবে।
সাবেক কমিউনিস্ট, তৎকালীন জাতীয়তাবাদী, উদারপন্থী এবং সংখ্যায় দ্রুত বাড়তে থাকা ইইউ বিশেষজ্ঞরা ইউরোপীয় মূল্যবোধের এই প্রসারকে তখন স্বাগত জানাচ্ছিলেন। বিশেষ করে বলকান অঞ্চলে ইউরোপীয় মূল্যবোধের বিষয়ে তখন এতটাই আশাবাদ দেখা যাচ্ছিল যে ইউরোপীয় মূল্যবোধের ধারণা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন এমন কোনো জনপরিচিত ব্যক্তিত্বের কথা আমি মনে করতে পারি না। ৩০ লাখ মানুষের আবাসস্থল বসনিয়ায় কয়েক ডজন রাজনৈতিক দল থাকলেও সেখানে তখন একটি দলও ইউরোপবিরোধী ছিল না। কিন্তু এই মূল্যবোধের ধারণাটি মূলত ইইউর একটি কাল্পনিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল।বিপুল ইস্পাত ও কয়লা সম্পদের মালিকানা থাকা যে ছয়টি শক্তিধর দেশ ইইউর মূল চালিকা শক্তি, তারা ১৯৫০ এর দশকে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রশ্নে আজকের ইউরোপীয় মূল্যবোধের ধারেকাছেই ছিল না। জার্মানি ওই সময়টাতে যুক্তরাষ্ট্রের ‘অভিভাবকত্বে’ এবং ইতালি কমিউনিস্টদের দখলে যাওয়ার দ্বারপ্রান্তে ছিল। গ্রিসে জান্তা শাসনের অবসানের মাত্র সাত বছর পর দেশটি ১৯৮১ সালে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে যোগ দেয়। ফ্রাঙ্কো ও সালাজারের এক যুগের বেশি সময়ের স্বৈরশাসনের পর ১৯৮৬ সালে স্পেন ও পর্তুগাল যোগ দেয়।এই গ্রুপে যোগদানের শর্ত হিসেবে আজকে পশ্চিম বলকানের দেশগুলোর কাছ থেকে যতখানি ইউরোপীয় মূল্যবোধের চর্চা আশা করা হয়, গ্রুপটি সম্প্রসারণের প্রথম দিকে তা কারও কাছে আশা করা হতো না। তবে গত কয়েক দশকে ইইউ তার মূল্যবোধ সমুন্নত রাখা প্রশ্নে যথেষ্ট এগিয়েছিল। কিন্তু ইইউ সম্প্রসারণের এতগুলো বছর পর আজ মনে হচ্ছে, ইউরোপীয় মূল্যবোধের ভিত নড়বড়ে হয়ে গেছে।আজকের ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে এই বিষয়গুলো ক্রমাগত কমছে। ফলে ইউরোপীয় মূল্যবোধ একসময় যেভাবে ইইউয়ের আদর্শিক শক্তি হিসেবে কাজ করত, এখন তা আর করে না।ইউরোপীয় মূল্যবোধ গ্রহণ করলে দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের সমাজগুলো এগিয়ে যাবে—এই ধারণা এখন আর আগের মতো বিশ্বাসযোগ্য নয়।বছরের পর বছর ধরে ইইউ কর্মকর্তারা ইউরোপীয় মূল্যবোধের পরিসরকে ক্রমাগত প্রসারিত করে যাচ্ছে। মূলত ইউরোপীয় মূল্যবোধ গ্রহণ করার অর্থ হলো রাজনীতিতে আরও ভব্যতা আনা, দুর্নীতি কমিয়ে আনা, স্বার্থের সংঘাত কমানো, জাতীয়তাবাদের অবনমন ঘটানো এবং অধিকতর সংহতি নিশ্চিত করা। কিন্তু আজকের ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে এই বিষয়গুলো ক্রমাগত কমছে। ফলে ইউরোপীয় মূল্যবোধ একসময় যেভাবে ইইউয়ের আদর্শিক শক্তি হিসেবে কাজ করত, এখন তা আর করে না।
মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত আকারে অনূদিত
হামজা কার্সিক ইউনিভার্সিটি অব সারায়েভোর রাষ্ট্রবিজ্ঞান অনুষদের একজন সহযোগী অধ্যাপক
সৌ: প্র: আ:
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct