ড. রমজান আলি: স্কুল ইন্সপেক্টর হয়ে বর্ধমানের জৌগ্রামে পরিদর্শনে এসে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে বিদ্যাসাগর মহাশয় মেয়েদের জন্য একটি স্কুল খুলে ফেললন। কেউ কেউ বলেন এটা স্থানীয় মজুমদাররা সাত বছর আগেই চালু করেছিলেন, বিদ্যাসাগর তার আর্থিক দায়ভার নিয়েছিলেন। বিতর্ক যাই থাক, বাঙালি সমাজে নারীদের শিক্ষা, উন্নতি ও প্রগতি নিয়ে যথাযথ আলোড়ন তুলেছিলেন বিদ্যাসাগর। প্রাচ্যদেশের এই আলোড়ন মধুসূদনকে ছুঁতে পেরেছিল। ওভিদের The Heroides or Epistle of the Heroines’ কাব্য পড়ে তিনি বাংলায় লিখলেন বীরাঙ্গনা (১৮৬২)। বন্ধু রাজনারায়ণ বসুকে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন- ‘I have been scribbling a thing to be called at i.e. Heroie Epistle from the most noted pouranic women to their lovers or lords.’ বোঝা যায় মধুসূদন ওভিদের ‘‘Heroine’ শব্দটির গুরুত্ব দিয়েছিলেন।
১৮৬১ খ্রিঃ রাজনারায়ণ বসুকে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন – “গত সপ্তাহের মধ্যে ‘বীরাঙ্গনা’ নামে একটি বস্তু কলমের আঁচড়ে সাড়া কারিয়াছি; প্রসিদ্ধ পৌরাণিক নারীরা তাহাদের প্রণয় অথবা পতিদের নিকট নায়িকার উপযুক্ত লিপি লিখিয়াছে ইহাই ‘বীরাঙ্গনা’।” বীরাঙ্গনা শব্দটি বিশ্লেষণ করলে দুটি শব্দ পাওয়া যায়। ‘বীর’ + অঙ্গনা। অভিধান অনুযায়ী বীর শব্দটি হলো -- বীর্ + অ (অন) + ক = বীর। অর্থাৎ শৌর্য ও বীরত্বের প্রকাশ করে যে। আর অঙ্গনা হল – অঙ্গ + ন (প্রশংসার্থে) + আ (স্ত্রীলিঙ্গে) অর্থাৎ সুন্দর দেহ যে নারীর। সামগ্রিক ভাবে বীরাঙ্গনা শব্দের অর্থ দাঁড়ালো শৌর্য বীর্য প্রকাশক সুন্দরী নারী। কিন্তু মধুসূদন সতী ললনা বা নারীর পরিবর্তে ‘অঙ্গনা’ শব্দটি নিলেন নারীর ব্যক্তিত্বে সৌন্দর্যকে গুরুত্ব দিতে। শিক্ষা যে ব্যক্তিত্বের জন্ম দেয় এটা বুঝতে মধুসূদনের অসুবিধা হয়নি।
চিঠি বা পত্রের আকারে লেখা কাব্যই ‘পত্রকাব্য’ । ল্যাটিন শব্দ ‘Epistula’ শব্দ থেকে ইংরাজি ‘Epistle’ শব্দের পারিভাষিক শব্দ রূপে বাংলায় পত্রকাব্য বলা। মার্টিন গ্রে এর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন – “A letter especilly one of the apostolic letters in the New Tshament. The word is also used of Poems or moral or semi Philosophical themes addressed to a friend or patron, in the manner of an informal well-argued letter” ইতালি ভাষা সাহিত্যে এই ধরনের কাব্যের সঙ্গে মাইকেল মধুসূদন পরিচিত লাভ করেছিলেন। কাব্যের এগারোটি পূর্ণ পত্রে নায়িকারা সবাই প্রচলিত অর্থে বীরনারী না হলেও মদুসূদনের অভিপ্রায়টি এক্ষেত্রে প্রতিফলিত। নবজাগরণের পটভূমিতে স্বামী ও প্রেমিকার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রকাশকেই অগ্রাধিকার দিয়েছেন তিনি।
জনা পুত্রের মৃত্যুর প্রতিশোধে স্বামী নীলধ্বজকে বীরনারীর মতোই উৎসাহ দিয়ে বলেছেন – “এই তো সাজে তোমারে, ক্ষত্রমণি তুমি,/ মহাবাহু !
যাও বেগে গজরাজ যথা/যমদণ্ড সম শুণ্ড আস্ফালি নিনাদে !/ টুট কিরীটিরি গর্ব্ব আজি রণস্থলে। দৃপ্ত ভাষণে, কুণ্ঠাহীন আত্ম ঘোষণায় এবং নিঃশঙ্ক আচরণের এমন নারী দেশ গঠনে খুবই প্রয়োজন।
আক্ষরিক অর্থে বীরাঙ্গনা শব্দের অর্থ বীর রমণী।
মধুসূদন কাব্যটি উৎসর্গ করেছেন ‘বঙ্গকূলচূড়া’ নারী দরদী ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়কে।
এ প্রসঙ্গে রাজনারায়ণ বসুকে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন – “আমাদের শুভানুধ্যায়ী বন্ধু বিদ্যাসাগরের নামে বইটি উৎসর্গ করিয়াছি। বিশ্বাস কর, এমন চমৎকার মানুষ হয় না। অনেক দিক দিয়া তাঁহাকেই আমি আমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ মানুষ বলিয়া মনে করি।” বিদ্যাসাগরের দৌলতেই প্রথম বাঙালি নারী সমাজ, মুক্তির আলো দেখতে পায়। সেই লক্ষ্যেই মধুসূদন পৌরাণিক নায়িকাদের মানবিক চেতনার উন্মোচন ঘটিয়েছেন।
নবজাগরণের আলোতে বাঙালির জীবনে যে নতুন চেতনার জাগরণ ঘটেছিল মধুসূদন তাকে সমর্থন করেছিলেন। বিষয়বস্তু সংগ্রহ করলেন পুরান ও মহাকাব্য থেকে যেমন দুষ্মন্তের প্রতি শকুন্তলা পত্রটির বিষয় সংগৃহীত মহাভারত ও বিদ্যাসাগরের শকুন্তলা গ্রন্থ থেকে, সোমের প্রতি তারা – ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, লক্ষ্মণের প্রতি সুর্পণখা রামায়ণ, দুর্যোধনের প্রতি ভানুমতি -- মহাভারত, দশরথের প্রতি কেকয়ী – রামায়ণ, নীলধ্বজের প্রতি জনা -- কাশীরাম দাসের মহাভারত ইত্যাদি ইত্যাদি।
মধুসূদনের পাঠ অভিজ্ঞতা অসাধারণ, প্রয়োগক্ষমতাও ছিল অসাধারণ।
রোমক কবি ওভিদ (খ্রিষ্টপূর্ব ৪৩ -- খ্রিস্টপূর্ব ১৭ অব্দ হেরিওদেস কাব্যে সপ্তম পত্রে রাজা সিকাওশের বিধবা পত্নী ডিডোর সঙ্গে এই পত্রের নায়িকা সূর্পণখার মিল খুঁজে পাওয়া যেতেই পারে। তবু সূর্পণখা মধুসূদনের নিজস্ব সৃষ্টি, দ্রাবিড় গোষ্ঠীর প্রতিনিধি। মুনি বিশ্বামিত্রের ঔরসে কৈকেয়ীর গর্ভে তার জন্ম হয়। তার বিয়ে হয়েছিল কালকেয় বংশের রাক্ষসরাজ বিদ্যুৎজিহ্বার সঙ্গে, যিনি রাবণের হাতে নিহত হন। পরে অনুতপ্ত হয়ে রাবণ সূর্পণখার ইচ্ছা অনুযায়ী তাকে দণ্ডকারণ্যে ভ্রমণে রেখে আসে।
মধুসূদন তাঁর কাবে চরিত্রটিকে এমনভাবে এঁকেছেন যেন অনূঢ়া রাজকন্যা রূপসী যুবতী। সূপ বা কুলোর মত নখ- এর অধিকারী নয়, বরং সুন্দর নখের অধিকারী যার হৃদয় ভালোবাসায় পূর্ণ। রাক্ষসীর এমন মানবী রূপ কোথায় মেলে ?
‘Epistle’ হিসাবে কাব্যটি লেখা হলেও মধুসূদন প্রতিভা অপূর্ব গীত-মাধুর্যকে স্পর্শ করে। এই কাব্যের পত্রগুলি নিছক সংবাদ প্রেরণ জাত পত্র হয়ে ওঠেনি। বীরাঙ্গনা নায়িকারা হৃদয়ের গৌরবে যে ভালোবাসা অনুভব করেছে তাকেই রোমান্টিক ও রহস্যময় করে প্রকাশ করেছে। শ্রেণি বিচার এটি নিছক পত্রকাব্য নয়, একোক্তি মূলক কাব্য (ড্রামাটিক মনোলগ) জাতীয় বৈশিষ্ট দুর্লভ নয়। যেহেতু নায়িকার একক উক্তিতে মনের কথা ব্যক্ত সেই সূত্রে এটিকে ড্রামাটিক মনোলগ বলতে বাধা নেই। কিন্তু শৈলির বিচারে মধুসূদনের গীতিকবি সুলভ প্রতিভা এই পত্রিকায় পূর্ণ রূপে বর্তমান। শুধু তাই নয় গীতিকাব্যের মন্ময়তা বা সাব্জেক্টিভটি এবং একই সঙ্গে নাটকীয়তায় অসাধারণ। ওভিদের পত্র কাব্য অনুসরণে এই পত্রগুলি লিখিত হলেও পত্র প্রাপক এগুলি হাতে পাক আর না পাক, নায়িকাদের মর্মযন্ত্রণা ব্যাপারটাই প্রাধান্য লাভ করেছে।
শিক্ষায় নারীদেরকে প্রতিষ্ঠানমুখী না করলে ভালো মা তৈরি হবে না, ভালো সমাজ তৈরি হবে না। বিদ্যাসাগরীয় উৎসাহ মূলক সৃজনের এই টিউনিংটা ধরতে পেরেছিলেন মাইকেল মধুসূদন। সুলতানা রিজিয়াকে নিয়ে ইংরেজিতে লিখলেন নাটক। শিক্ষিত দক্ষ শাসক চরিত্রটিকে নিয়ে বাংলায় বৃহত্তর নাটক লেখার পরিকল্পনা গ্রহণ করেও তাঁকে পিছিয়ে যেতে হল। ‘শর্মিষ্ঠা’ নাটকের দাসী শর্মিষ্ঠা হয়ে উঠল প্রেমিকা।
মেঘনাদবধ কাব্যে রাক্ষসী প্রমীলা হয়ে উঠলো ব্যক্তিত্বময়ী আর এক নারী। নারীকে সমাজে প্রতিষ্ঠার এই বিদ্যাসাগরীয় symphony শুনেছিলেন ছিলেন মধুসূদন।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct