বর্তমানে উদগ্র সাম্প্রদায়িকতা জনজীবনকে প্রায় বিপন্ন করে তুলেছে। বস্তুত ধর্মাশ্রয়ী ফ্যাসীবাদ— যা কিনা রাষ্ট্রযন্ত্রের দ্বার উৎসাহিত হচ্ছে, জাতির জীবনে তা ভয়ানক ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ হিন্দু-মুসলমান বাঙালি জীবনের সদর্থক দিক এবং সম্প্রীতির বিষয়গুলোতে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে যুক্ত সাধনাকে ব্রত করেছিলেন ক্ষিতিমোহন সেন। সেই ধারা অব্যাহত রেখেছেন তাঁর দৌহিত্র অমর্ত্য সেন। হিন্দু-মুসলমানের যুক্ত সাধনার প্রবক্তার স্মৃতিচারণা করেছেন বিশিষ্ট ইতিহাসবেত্তা খাজিম আহমেদ।
হাল আমলে উদগ্র সাম্প্রদায়িকতা জনজীবনকে প্রায় বিপন্ন করে তুলেছে। বস্তুত ধর্মাশ্রয়ী ফ্যাসীবাদ— যা কিনা রাষ্ট্রযন্ত্রের দ্বারা উৎসাহিত হচ্ছে, জাতির জীবনে তা ভয়ানক ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ বাঙালি জীবন কখনোই ক্ষুদ্রবৈশিষ্ট্য--খণ্ডচিন্তাকে প্রশ্রয় বা প্রাধান্য দেয়নি। সোজাসুজি বলতে কি আজকের দিনে অখণ্ড বাঙালি জাতিসত্তার যে চিরন্তন বৈশিষ্ট্য-- সহিষ্ণুতার সঙ্গে সব বিষয়কে বিচার করর প্রবণতা, তাকেই উজ্জীবিত করতে হবে। মনে রাখা জরুরি, হিন্দু-মুসলমানের যুক্ত সাধনার ধারা সাবেক বাংলায় ক্রিয়াশীল ছিল। সম্প্রীতি বোধে উদ্দীপ্ত জীবনের কথা বহু বাঙালি পণ্ডিত বহু আগেই আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। বহুত্ববাদে বিশ্বাসী এমন একজন পণ্ডিত-বিদ্বজ্জন হচ্ছেন ক্ষিতিমোহন সেন (১৮৮০, ২ ডিসেম্বর-১৯৬০, ১২ মার্চ)। বাংলা সাহিত্যে হিন্দু মুসলমানের যুক্ত সাধনা একদা বাংলা সাহিত্যের বিকাশে সহায়তা করেছে। বাংলায় বৈষ্ণব ভাবাপন্ন মুসলমান কবি মান্যজন হিসেবে সমাজে আদৃত ছিলেন। প্রাজ্ঞ-পণ্ডিতপ্রবর ক্ষিতিমোহন সেনের ‘ভারতীয় মধ্যযুগের সাধনার ধারা’ (১৯৩০) এবং ‘ভারতের হিন্দু-মুসলমান যুক্ত সাধনা’ (১৯৪৯) নামক গ্রন্থদ্বয়ে তার বিশদ বর্ণনা বাঙালি মানসে প্রোথিত হয়ে গেছে। উনিশ শতকে ‘হিন্দু অভ্যত্থানবাদ’ আর মুসলমান সমাজের ‘ইসলামিকরণ’ বহু দূর অতীত থেকে বহমান উদার চেতনার মূলে সংশয় আর অবিশ্বাস ডেকে এনেছিল। তার ঐতিহাসিক প্রতিক্রিয়া এবং প্রত্যক্ষ ফল ভয়ানক মারাত্মক ক্ষতিকর হয়েছে। সে কথা প্রায় ৭৫ বছরে প্রমাণিত হয়ে গেছে। এমন দুঃসময়ে অধ্যাপক ক্ষিতিমোহন সেন সম্পর্কে যৎকিঞ্চিৎ আলোচনা করা যেতে পারে।
ক্ষিতিমোহন সেন উনিশ শতকের এক সুশিক্ষিত অভিজাত পরিবারের সন্তান। তাঁর জন্ম হয়েছিল শহর বেনারসে। তাঁর বাবা ভুবনমোহন সেন। তিনি পেশাগত বিচারে একজন শিক্ষিত চিকিৎসক ছিলেন। এই সম্মানিত পরিবারটির আদি বাসভূমি ছিল ঢাকা জেলার বিক্রমপুর। ক্ষিতিমোহন সেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে সংস্কৃত ভাষা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। মেধাবী ছাত্র ছিলেন। এই সময়ে তিনি ‘শাস্ত্রী’ উপাধি অর্জন করেছিলেন। ১৯০৭ সারে দেশীয় একটি রাজার অধীনে শিক্ষা বিভাগের সেক্রেটারি হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন। কিন্তু সে চাকরি পরিত্যাগ করে রবীন্দ্রনাথের আমন্ত্রনে শান্তিনিকেতনে ‘ব্রহ্মচর্য আশ্রমে’ প্রিন্সিপাল-এর পদে বহাল হন। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যেতে পারে যে বিশাল ভারত আর চিন পরিভ্রমণের সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে সঙ্গী হিসেবে নিয়ে গিয়েছিলেন। ডাইরি (দিনলিপি) লেখার কাজটিও সে সময়ে তিনি করতেন।
ক্ষিতিমোহন সেন বাংলার তর্কপ্ররোচক জাগরণের এক উজ্জ্বল ফসল। তিনি বাংলা, ইংরেজি, সংস্কৃত, হিন্দি, গুজরাটি, রাজস্থানি এবং ফার্সি-আরবি ভাষায় পরদর্শী ছিলেন। প্রতিটি ভাষায় স্বচ্ছন্দে ভাব-বিনিময় করতে সমর্থ ছিলেন। মধ্যযুগের বাঙালি জীবনের সাংস্কৃতিক বিকাশের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ তাঁর সাহিত্য কর্মে প্রকাশ করেছেন।
এই সমস্ত সাহিত্য নির্মাণে হিন্দু-মুসলমান বাঙালি জীবনের সদর্থক দিক এবং সম্প্রীতির বিষয়গুলোতে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। ধর্মীয় বিচারে পরস্পর বিরোধী হলেও সমাজজীবনে ঐক্য আর সংহতির যে উপাদানগুলো ছিল তা জনসমক্ষে হাজির করেছেন। এর ফলে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে অপরিচয়ের আড়াল ক্রমেই অপসৃত হতে সাহায্য করেছে। অশুভ সাম্প্রদায়িক এবং বিভেদকামী শক্তি একটি বিশেষ গণ্ডির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছে। বিস্তীর্ণ সমাজ-অংশকে গ্রাস করেনি।
বড় বেদনার কথা ফিলহাল সম্প্রীতি আর মিশ্র সংস্কৃতির উপাদানগুলো প্রায় অনালোচিত থেকে যায়। বিরুদ্ধবাদীদের কথাগুলোই বারবার উচ্চারিত হচ্ছে এবং দুর্বল জনমানসে প্রভাব বিস্তার করছে তুরন্ত গতিতে। কিংবদন্তীতুল্য ঐতিহাসিক রোমিলা থাপার বলছেন, এই ধ্বংসাত্মক মতবাদগুলোকে জোরেশোরে খণ্ডন করতে হবে এবং তা করতে হবে বারে বারে। যা কিছু মুছে ফেলার চেষ্টা হচ্ছে বারবার তা উচ্চারণ করে জাগরুক করতে হবে। অধ্যাপক ক্ষিতিমোহন সেন এই বিষয়টি শুধুমাত্র গুরুত্ব দিয়েছিলেন তাই নয়, পুরো জীবনটাই এ বাবদে সঁপে দিয়েছিলেন। তাঁর বৌদ্ধিক সাধনার ‘প্রোডাক্ট’গুলোর দিকে তাকালে সে কথার যথার্থতা অনুধাবনযোগ্য হয়ে উঠবে।
১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ‘লীলা বক্তৃতামালা’য় অংশ নিয়েছিলেন। ১৯৫৩-৫৪তে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ভাইস চ্যান্সেলর’-এর দায়িত্বও তাঁকে নিতে হয়েছিল। অধ্যাপক সেন বিস্তর বইপত্তর প্রকাশ করেছেন। সেগুলোর একটি তালিকা এখানে উল্লেখ করা গেল। ১. কবির (১৯১০), ২. ভারতীয় মধ্যযুগের সাধনার ধারা (১৯৩০), ৩. ভারতের সংস্কৃতি (১৯৪৩), ৪. বাংলার সাধনা (১৯৪৫), ৫. যুগপুরুষ রামমোহন (১৯৪৫), ৬. জাতিভেদ (১৯৪৬), ৭. বাংলার বাউল (১৯৪৭), ৮. হিন্দু সংস্কৃতির স্বরূপ (১৯৪৭), ৯. ভারতের হিন্দু মুসলমান যুক্ত সাধনা (১৯৪৯), ১০. প্রাচীন ভারতে নারী (১৯৫০), ১১. চিন্ময় বঙ্গ (১৯৫৭), ১২. সাধক ও সাধনা (?), ১৩. রবীন্দ্র প্রসঙ্গ, ১৪. হিন্দুইজম (১৯৬৩) ইত্যাকার যাবতীয় গ্রন্থসমূহ। হিন্দি আর গুজরাটি ভাষাতেও গ্রন্থ প্রণয়ন করেছিলেন। গ্রন্থের নামকরণ থেকেই বিষয়বস্তুর ইঙ্গিত পেয়ে যাই।
পণ্ডিত দার্শনিক ক্ষিতিমোহন সেন মধ্যযুগের সুফি-দরবেশ কবির যে ভালবাসার বাণী উচ্চারণ করেছিলেন তার উপর গুরুত্ব দিয়ে মানুষের প্রতি মর্যাদা আরোপের বিষয়টিতে প্রাধান্য দিয়েছেন। ভারতেতিহাসের বহু আলোচক মধ্যযুগকে (তুর্ক-আফগান-মুঘল) ‘মুসলিম যুগ’ হিসেবে চিহ্নিত করে, ‘বর্বর আর অসভ্য’ যুগ হিসেবে চিহ্নিত করতে চান এবং বিদ্বেষের বিষ জীবিত করতে চান। ক্ষিতিমোহন সেন বিরলদৃষ্ট উদারতায় তাকে নস্যাৎ করেন এবং সম্প্রীতি সৌহার্দ্য আর চেনাজানার পরিধিকে প্রশস্ত করেন। বস্তুত কেশবচন্দ্র সেন, ভাই গিরীশচন্দ্র সেন, রায় বাহাদুর দীনেশচন্দ্র সেন বাঙালি জাতিক হিন্দু-মুসলমান হিসেবে পৃথক বা ‘অপর’ হিসেবে ভাবেননি। ভাবতে শেখাননি। ক্ষিতিমোহন সেন এই ধারারই একজন নীরব সাধক। রাবীন্দ্রিক অধ্যাপক সেনের দৌহিত্র ‘নোবেল লরিয়েট’ অমর্ত্য সেনও এই মহাদর্শেরই উত্তরসূরী। বর্তমান দুঃসময়ে তিনি তো এই উপ-মহাদেশের এক নিঃসঙ্গ পদাতিক। অতি সম্প্রতি নানান সাক্ষাৎকারে সে কথা স্পষ্ট উচ্চারণ করেছেন। উগ্র ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদ আর সাম্প্রদায়িকতাবাদীরা তাঁকে ‘না-পসন্দ’ তালিকার মধ্যে ফেলেছেন। ইদানীংকালে বাংলার জনজীবনে এমন দুর্যোগ, সমস্ত রকমের সুনীতিগুলোকে ধ্বস্ত করে দিচ্ছে। চিন্ময় বঙ্গ, রবীন্দ্র প্রসঙ্গ, হিন্দু ধর্ম সংস্কৃতি ইত্যাকার বিষয়গুলোতে ক্ষিতিমোহন উদার মানবতাবাদের চর্চা আর সন্ধান করেছেন। আজকের দিনেও তাঁর মতাদর্শ পুরো প্রাসঙ্গিক আর জরুরি হয়ে রয়েছে।
ক্ষিতিমোহন সেন (শাস্ত্রী) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অশেষ স্নেহভাজন ছিলেন। ভারতের সভ্যতার বিকাশ হিন্দু-মুসলমান যৌথ সাধনার ফল— এই কথা তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন।
সারা জীবনের জ্ঞানসাধনার সম্মানসূচক পুরস্কার ‘রবীন্দ্র মেমোরিয়াল গোল্ড মেডাল’ (১৯৪২), বিশ্বভারতীর প্রথম ‘দেশিকোত্তম’ এবং ‘মহাত্মা গান্ধি পুরস্কার’ (১৯৫৩), ‘মুরারকা পুরস্কার’ (১৯৫৩) এবং ১৯৫৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রদত্ত ‘সরোজিনী বাসু গোল্ড মেডাল’ গ্রহণ করেন। মিশ্র সংস্কৃতির আবহমান ধারায় বিশ্বাসী এই মহৎ প্রাণ মানুষটির জীবনদীপ ১৯৬০ সালের ১২ মার্চ নির্বাপিত হয়। ক্ষুদ্র রাজনৈতিক চিন্তা সমাজ জীবনেও বড় বিপদের সম্ভাবনা তৈরি করেছে। এমন সময়ে অধ্যাপক সেন অবশ্যই স্মরণার্হ।
শেষ কথা
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য অধ্যাপক ক্ষিতিমোহন সেন-এর দৌহিত্র ড. অধ্যাপক অমর্ত্য সেন গত বছরেই আনন্দবাজার পত্রিকায় লিখেছিলেন যে বাঙালি জাতিসত্তার নির্মাণে শুধু হিন্দু ধর্ম নয়, সুদীর্ঘ বৌদ্ধ ও তুর্ক-আফগান আর মুঘল শাসনেরও অতুল্য অবদান রয়েছে।
অতি সম্প্রতি আনন্দবাজার পত্রিকার শতবর্ষ উপলক্ষে প্রদত্ত বক্তৃতায় অমর্ত্য সেন পরিষ্কার বলেছেন, ‘এদেশে নতুন যে সমস্যা আমাদের জাতীয় ঐক্য পিছিয়ে দিচ্ছে তার মধ্যেও সুচিন্তার অভাব আমরা অনেক সময় দেখতে পাই। ভারতীয় মানুষদের নানা ভাগে ভাগ করার প্রচেষ্টা এবং হিন্দু-মুসলমানের সহকর্মের জায়গায় বিভেদ তৈরি করার প্রচেষ্টা আমাদের খুবই দেখতে হচ্ছে, রাজনৈতিক সুবিধাবাদের ব্যবহারের জন্য।’ (আনন্দবাজার পত্রিকা, রবিবার, ১০ জুলাই, ২০২২)।
২০২১-এ ড. সেনের আত্মজীবনী বেরিয়েছে ইংরেজি ভাষায়। এই সেদিন তাঁর বাংলা ‘তরজমা’ (অনুবাদ) বের হল। অমর্ত্যের স্মৃতিকথাটি ‘জগৎ কুটির’ নামে প্রকাশিত হল। তাঁর স্মৃতিকথাটি আদতে বৌদ্ধিক আর মানবিক সত্তা নির্মাণের দলিল। এই ‘জগৎ কুটির’ ঢাকায় অমর্ত্যের ঠাকুরদা সারদাপ্রসাদ সেনের তৈরি বাড়িরও নাম। নামেই স্পষ্ট একটি বাড়ির পরিসরে গোটা জগতেরই তাতে অবাধ আবাহন।
বস্তুত অধ্যাপক ক্ষিতিমোহন সেনের দৌহিত্র ড. অমর্ত্য সেন তাঁর মাতামহের ‘লিগেসি’কেই বহন করছেন।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct