মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে গণ-আন্দোলন থেমে যাওয়ার প্রায় এক দশক পর আবার বড় ধরনের বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। ২০১০-এর দশকের শুরুর দিকে সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব ও মিশর ২০১১ সালের জনপ্রিয় বিদ্রোহের অর্জনগুলোকে ফিরে পেতে নিরাপত্তা বাহিনীর সহিংসতা, সামরিক হস্তক্ষেপ এবং রক্ষণশীল ও বিদ্রোহী মিলিশিয়াদের সমর্থনের ওপর নির্ভর করে, যা তিউনিসিয়া, মিশর, লিবিয়া ও ইয়েমেনের দীর্ঘস্থায়ী স্বৈরাচারী নেতাদের পতন ঘটায়। আলজেরিয়া, ইরাক, লেবানন ও সুদানে ২০১৯ ও ২০২০ সালে আবার বিদ্রোহ শুরু হয়। কিন্তু স্বৈরাচারী রাজনৈতিক দলগুলোর জোট ও করোনা মহামারীর কারণে এসব আন্দোলনকারী অনেকটা কোণঠাসা হয়ে পড়ে। লিখেছেন জেমস ডরসি।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকেরা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, ২০১৯-২০২০ সালে মহামারি ও রাজনৈতিক নিপীড়নের কারণে মধ্যপ্রাচ্যে চলমান নানা ধরনের বিক্ষোভ কমে যাবে। কিন্তু সিরিয়া, বাহরাইন, লিবিয়া, এমনকি ইরানে আবারও অস্থিরতা শুরু হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। মিশর ও সৌদি আরব উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে যে আরব বিশ্বে এত দিন যে শান্ত পরিবেশ বিরাজ করছিল, তা যে কোনো সময় আগুনের ফুলকির মতো জ্বলে উঠতে পারে। সিরিয়া, বাহরাইন, লিবিয়া, ইরান ও ইসরাইলের বিক্ষোভকারীরা বেশ লম্বা সময়ের শান্ত পরিবেশের পর এখন স্বৈরাচারী শাসক ও স্বৈরাচারী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে লড়াই করতে শুরু করেছে। এর প্রতিক্রিয়ায় আরব স্বৈরাচারীরা এক দশকেরও বেশি সময় ধরে তাদের যে ক্ষমতার প্রাসাদ বানিয়েছেন, তা যে কোনো সময় ভেঙে পড়তে পারে এই আশঙ্কায় বিক্ষোভ দমনের সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন। স্বৈরশাসকেরা রাস্তার প্রতিবাদ দমন থেকে শুরু করে একে অপরের সঙ্গে অযৌক্তিক সংলাপে জড়িত হওয়াসহ বিক্ষোভকারীদের দমন-পীড়ন বাড়ানোসহ সব ধরনের পন্থা অবলম্বন করছেন, যেন এই প্রতিবাদ বড় কোনো আন্দোলনে রূপ না নেয়। তাদের আসন ভেঙে ভবিষ্যতে যেন অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি না হয়, তা নিশ্চিত করতে মরিয়া হয়ে উঠছেন তারা।
মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে গণ-আন্দোলন থেমে যাওয়ার প্রায় এক দশক পর আবার বড় ধরনের বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। ২০১০-এর দশকের শুরুর দিকে সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব ও মিশর ২০১১ সালের জনপ্রিয় বিদ্রোহের অর্জনগুলোকে ফিরে পেতে নিরাপত্তা বাহিনীর সহিংসতা, সামরিক হস্তক্ষেপ এবং রক্ষণশীল ও বিদ্রোহী মিলিশিয়াদের সমর্থনের ওপর নির্ভর করে, যা তিউনিসিয়া, মিশর, লিবিয়া ও ইয়েমেনের দীর্ঘস্থায়ী স্বৈরাচারী নেতাদের পতন ঘটায়। আলজেরিয়া, ইরাক, লেবানন ও সুদানে ২০১৯ ও ২০২০ সালে আবার বিদ্রোহ শুরু হয়। কিন্তু স্বৈরাচারী রাজনৈতিক দলগুলোর জোট ও করোনা মহামারীর কারণে এসব আন্দোলনকারী অনেকটা কোণঠাসা হয়ে পড়ে। বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্লেষক, সাংবাদিক ও শিক্ষাবিদেরা বলেছিলেন, ২০১১ সালের আরব বসন্তের সময় চলমান আন্দোলন বন্ধ করতে যেসব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল, সেগুলো জনগণের আন্দোলনকে পুরোপুরি বন্ধ করেনি বরং তাদের হিমঘরে রেখেছিল। সাম্প্রতিক বিক্ষোভগুলো আভাস দেয় যে ঐ জমাটবাঁধা বরফ গলতে শুরু করেছে, এই বিক্ষোভ আবার গণ-আন্দোলনে রূপ নিতে পারে।
ইরান ১৬ সেপ্টেম্বর মাহশা আমিনির প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী পালন করেছে। ধারণা করা হয়, মাহশা আমিনি ইরানের ধর্মীয় পুলিশের হেফাজতে মারা যান, যারা তাকে মাথার স্কার্ফ ঢিলেঢালাভাবে পরার অভিযোগে আটক করেছিল। আমিনির মৃত্যু দেশব্যাপী বিক্ষোভের জন্ম দেয়, যা কয়েক মাস ধরে চলছিল এবং এই বিক্ষোভে ইরানের নিরাপত্তা বাহিনী ৫৩০ জনকে হত্যা করে এবং ২২ হাজারেরও বেশি মানুষকে গ্রেপ্তার করে। ইরানের একজন সাবেক সরকারি কর্মকর্তা বলেছেন, সরকারের নেওয়া যে কোনো ধরনের ভুল সিদ্ধান্ত মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনতে পারে, জনগণ এত অবিচার সহ্য করবে না। এই অবিচার চলতে থাকলে আমরা আবার রাস্তায় নেমে অন্যায়ের প্রতিবাদ করব। ডসরিয়ায় প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে দ্রুজ-জনবহুল এলাকা দক্ষিণ-পশ্চিম প্রদেশের সুওয়াইদায় সরকারবিরোধী বিক্ষোভ চলছে, যেখানে দীর্ঘদিন ধরে সিরিয়ার সরকার সমর্থক জনগোষ্ঠী বাস করে আসছে। প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের পতনের দাবিতে প্রতিবেশী সুন্নি অঞ্চল দারাতে এমনকি বাশার আল-আসাদের আলাউইটদের ঘাঁটি লাতাকিয়ায়ও বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। প্রাথমিকভাবে বাশার আল-আসাদ সম্ভবত ভেবেছিলেন, ‘আমি ইতিমধ্যে জিতে গিয়েছি, এসব ছোটখাটো বিক্ষোভে কোনো সমস্যা হবে না। আমরা দ্রুজ জনগোষ্ঠীকে কিছুটা ছাড় দিতে পারি।’ প্রেসিডেন্ট আসাদের এই ধারণা ভুল বলে প্রমাণিত হয়েছে। সিরিয়া বিশেষজ্ঞ জোশুয়া ল্যান্ডিস বলেছেন, আসাদের ক্ষমতায় থাকতে হলে তাকে তার সামরিক বাহিনীকে ব্যবহার করতে হবে। বাহরাইনে জেলখানার ৮০০ বন্দি তিন সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে অনশন করছেন। উপসাগরীয় রাজ্যের জেলের প্রায় ২০ শতাংশ বন্দির দাবি, তাদের কারাগারের অবস্থার উন্নতি করা হোক। কারাগারে বন্দির সংখ্যা এত বেশি হয়ে গেছে যে, সেখানে বন্দিদের থাকা কষ্টসাধ্য হয়ে উঠেছে। কিন্তু বাহরাইন কর্তৃপক্ষ তাদের অবস্থার উন্নতি ঘটাতে ব্যর্থ হয়েছে। বরখাস্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী নাজলা আল-মঙ্গুশ এবং তার ইসরায়েলি প্রতিপক্ষ এলি কোহেনের মধ্যে একটি বৈঠকের বিরুদ্ধে নতুন করে বিক্ষোভ প্রতিরোধ করতে এই সপ্তাহে রাজধানী ত্রিপোলির রাস্তায় লিবিয়ার নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছিল। এই বিক্ষোভগুলো লিবিয়ার আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত অন্তর্বর্তী জাতীয় ঐক্য সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে এবং নতুন প্রশাসনের ক্ষমতায় আসার পথ সুগম করে।
একইভাবে ইরানের মতো ইসরাইলেও কয়েক মাস ধরে বিক্ষোভ চলছে। যদিও ইসরাইলের গণতন্ত্রপন্থি বিক্ষোভগুলো ফিলিস্তিনি ভূমিতে ইসরাইলের দখলদারিত্বের ব্যাপারে চুপচাপ। কিন্তু বিক্ষোভকারীরা প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর বিচারিক সংস্কারের বিরুদ্ধে জোর দাবি তুলেছে। অন্যদিকে ইরাকেন বহুজাতিগত শহর কিরকুকে কুর্দিদের রাজনৈতিক উপস্থিতির বিরোধিতাকারী আরব ও তুর্কমেন বিক্ষোভকারীরা গত সপ্তাহের শেষ দিকে কুর্দিদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে। এটা আভাস দিচ্ছে যে সামাজিক অস্থিরতার সম্মুখীন মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশের মতো ইরাকেও অস্থিতিশীল পরিবেশ বিরাজ করছে। বিক্ষোভে চার জন নিহত হওয়ার পর কর্তৃপক্ষ প্রাথমিকভাবে কিরকুকে কারফিউ জারি করে। সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ মিশরের রাষ্ট্রপতি আবদুল ফাতাহ আল-সিসির সমর্থকেরা আশঙ্কা করছে যে, মিশর আরব বিশ্বে চলমান বিক্ষোভের পরবর্তী নতুন সাক্ষী হতে চলেছে। এখন এমন একটা অবস্থা বিরাজ করছে যে মিশরের সাধারণ জনগণ এখন কোনো কিছুতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে না। ঋণসংকট, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও মুদ্রাস্ফীতি নাটকীয়ভাবে বেড়েছে। মানুষের জীবন ও সার্বিক পরিস্থিতির অবনতি ঘটেই চলেছে। এমন পরিস্থিতিতে মানুষ বেশি দিন চুপ থাকবে না। মিশরীয়-কানাডিয়ান সাংবাদিক করিম জিদান গত মাসে একটি সফরে কায়রোতে আসার কয়েক দিন পর বলেছিলেন মানুষ এখন মিশরের রাস্তায় প্রকাশ্যে তাদের অসন্তোষের কথা বলতে শুরু করেছে। ‘মিশরের প্রেসিডেন্ট আব্দুল ফাতাহ ত্রাসের রাজত্ব করছেন’ শিরোনামে মিশর বিশেষজ্ঞ স্টিভেন এ. কুক বলেছেন, ‘সরকার মিশরীয়দের যেমন জীবনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল এবং বর্তমানে তারা কীভাবে জীবন যাপন করছে, তার মধ্যে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে।’ সৌদি আরবের মতো দেশ, যেখানে রাস্তায় অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি কম, সেখানেও বিক্ষোভের ভয় রয়েছে। টুইটারে সরকারের বিরুদ্ধে লেখালেখি করার জন্য ৫৪ বছর বয়সি শিক্ষক মুহাম্মদ আল-গামদির মৃত্যুদন্ড কার্যকর এই বিষয়েরই ইঙ্গিত দেয়।
এ প্রসঙ্গে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, আদালতের নথিতে পেশ করা আল-গামদির সঙ্গে যুক্ত দুটি টুইটার অ্যাকাউন্টে মাত্র ১০ জন ফলোয়ার ছিলেন। আল-গামদি মূলত সৌদি সরকারের সমালোচকদের টুইটগুলো রিটুইট করতেন। লেখক রবার্ট ডি. কাপলান তার সদ্য প্রকাশিত বইয়ে উল্লেখ করেছেন, সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন ভ্লাদিমির লেনিন বুঝতে পেরেছিলেন যে ‘নিরপরাধকে হত্যা করা এবং বন্দি করার প্রয়োজন আছে। তা না হলে একজন স্বৈরশাসক কীভাবে জনগণের মধ্যে ভয় জাগিয়ে তুলবে? শুধু দোষীদের শাস্তি দিয়ে নিরপরাধ সাধারণ মানুষের মনে ত্রাসের রাজত্ব তৈরি করা সম্ভব নয়।
কাপলানের বিশ্লেষণের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে সাধারণ মানুষের বিক্ষোভের প্রতি ইরানের প্রতিক্রিয়া এবং ইসরাইলের পশ্চিম তীর ও গাজা অঞ্চলে ইসরাইলি সেনাদের কর্মকাণ্ডের উদ্দেশ্য বোঝা যায়। তাছাড়া এই বিশ্লেষণটা সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান তার বিরুদ্ধে যে কোনো ধরনের ভিন্নমতকে যে কঠোরভাবে দমন করছেন—এ বিষয়েরও সুন্দর ব্যাখ্যা প্রদান করে।
যাই হোক, ইরান ও সিরিয়ার মতো দেশগুলোতে এবং মিশরের মতো অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজমান দেশের প্রতিবাদ ইঙ্গিত দেয় যে দমন-পীড়ন ও ত্রাসের রাজত্ব হয়তো স্বৈরাচারী এবং কর্তৃত্ববাদীদের একটু বেশি সময় ক্ষমতায় থাকতে সাহায্য করে,কিন্তু তাদের শাসনকে চিরস্থায়ী করে না। পৃথিবীর ইতিহাস আমাদের এই শিক্ষাই দেয় যে, যেসব শাসক ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না,তারাই স্বৈরাচারী হয়ে ওঠে।
লেখক :লাতিন আমেরিকা ও পশ্চিম এশিয়ার রাজনীতিবিষয়ক গবেষক ‘ফেয়ার অবজারভার’ থেকে অনূদিত।
ভাষান্তর: আব্দুল্লাহ আল মামুন
সৌ: ইত্তে:
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct