মোহাম্মদ কাইকুবাদ আলি: সম্প্রতি ভারতীয় মৌসম বিভাগ এক বিবৃতিতে ঘোষণা করে যে ২০২৩ সালের আগষ্ট মাসটি বিগত ১২২ বছরের সবথেকে শুষ্ক আগষ্ট মাস। অর্থাৎ বিগত বছরের আগষ্ট মাসগুলিতে যে পরিমান বৃষ্টিপাত হয়ে এসেছে, তার তুলনায় এবছর অনেক কম বৃষ্টি হয়েছে। সাধারণত, ভারতীয় ভূখণ্ডে প্রতি বছর আগষ্ট মাসে গড়ে প্রায় ২৫৪.৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে, যার পরিমান এবছর কমে হয়েছে ১৬২.৭ মিলিমিটার। উপমহাদেশে বৃষ্টিপাতের পুরোনো রেকর্ড দেখলে জানা যায়, ১৯০১ সাল থেকে এটি আগষ্ট মাসের সর্বনিন্ম গড় বৃষ্টিপাত। এর আগে ২০০৫ সালে সর্বনিন্ম ১৯১.২ মিলিমিটার বৃষ্টির তথ্য মেলে।
বৃষ্টিপাতের এই তারত্যম্যের প্রভাব দেখা যাচ্ছে গড় তাপমাত্রার উপরেও। মৌসম বিভাগের তথ্য অনুয়ায়ী, আগষ্ট মাসে কম বৃষ্টিপাতের ফলে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা প্রায় ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে গেছে। যেখানে বিগত বছরগুলিতে আগষ্ট মাসে সর্বোচ্চ তাপমাত্রার গড় ৩১.০৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস, সেখানে এবছরে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩২.০৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এটিও বিগত ১২২ বছরে আগষ্ট মাসগুলিতে তাপমাত্রার সর্বাধিক অঙ্ক। পাশাপাশি, এ বছরের আগষ্ট মাসের সর্বনিন্ম তাপমাত্রাটিও ১৯০১ থেকে রেকর্ডেড গড় সর্বনিন্ম তাপমাত্রার থেকে বেশি ছিল। ফলে, এবারের আগষ্ট মাসটি অন্যান্য বছরেরে তুলনায় শুষ্ক ও গরম ছিল।
উল্লেখ্য, গত মার্চ মাসে ভারতীয় মৌসম বিভাগ জানিয়েছিল যে, এ বছরের ফেব্রুয়ারী মাসটি ছিল বিগত ১২২ বছরের সবথেকে উষ্ণতম। ফেব্রুয়ারী মাসের সর্বোচ্চ তাপমাত্রার গড় যেখানে ২৪.৮৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস, সেখানে এবছরে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ২৯.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অন্যান্য বছর যেখানে শীতকাল পুরো ফেব্রুয়ারী মাস ধরে থাকে, এবছর ফেব্রুয়ারীর দ্বিতীয়ার্ধ থেকেই উত্তর ভারতে গরমের শুরু হয়ে গিয়েছিল। ফলে শীতকাল এবার ছিল অনেক সীমিত।
বৃষ্টিপাত এবং তাপমাত্রার এই যে অনিয়ম তার অন্যতম কারণ হল, প্রশান্ত মহাসাগরে সমুদ্রস্রোতের বৈসাদৃশ্য। মৌসম বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, এবছর প্রশান্ত মহাসাগরে সমুদ্রস্রোতের তাপমাত্রা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে এবং পশ্চিম থেকে পূর্বে প্রবাহিত নিরক্ষীয় পাল্টা স্রোত ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে গেছে। এর ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠে প্রবাহিত উষ্ণ ও আর্দ্র্য বায়ু মহাসাগরের পশ্চিমে না এসে পূর্বের উপকূলে চলে গেছে। ফলে পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগর তুলনামূলক ভাবে শুকনো হয়ে রয়েছে। এই পরিস্থিতিকে ভূ-বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় এল নিনো। প্রসঙ্গতঃ ভারতে বৃষ্টিপাতকারী মৌসুমি বায়ু অধিকাংশ আর্দ্র্যতা পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগর থেকে নিয়ে থাকে। প্রতি বছর ১লা জুন মৌসুমি বায়ু কেরলে বৃষ্টি দিয়ে উপমহাদেশে বর্ষার সূচনা করে। এবছর এল নিনো পরিস্থিতির জন্য মৌসুমি বায়ুও শুকনো হয়েছে। এক সপ্তাহ দেরি করে শুরু হয়েছে। বৃষ্টিপাতও কম হয়েছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলিতে তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাতের অস্বাভাবিক অনিয়মের জন্য সাময়িকভাবে এল নিনো-কে দায়ী করা হলেও মৌসম বিভাগ ও জলবায়ু বিজ্ঞানীরা বিশ্ব উষ্ণায়ণ ও জলবায়ু পরিবর্তন-কে মূল কারণ হিসেবে তুলে ধরেছেন। আমাদের দৈনন্দিন কার্যকলাপ, বিশেষ করে কয়লা-পেট্রোলিয়ামের মতো জীবাশ্ম জ্বালানীর দহণ ও বেলাগাম বৃক্ষচ্ছেদনের ফলে বাতাসে কার্বন-গ্যাসের পরিমান বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিগত কয়েক দশকে আধুনিক জীবনশৈলির নামে আমাদের সমাজে কয়লা পুড়িয়ে উৎপাদিত তাপবিদ্যুতের ব্যবহার বেড়ে চলেছে। বেড়েছে ডিজেল-পেট্রোলচালিত যানবাহনের সংখ্যা এবং এসি, ফ্রিজ আর জেনারেটর-এর মতো পরিবেশ দূষণকারী প্রযুক্তির ব্যবহারও। ফলে বাতাস আস্বাভাবিকভাবে দূষিত হচ্ছে এবং বায়ুমণ্ডলে কার্বন-গ্যাসের পরিমান বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাতাসে জমে থাকা কার্বন আটকিয়ে দিচ্ছে পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে প্রতিফলিত তাপ। বেড়ে যাচ্ছে পৃথিবীরপৃষ্ঠের গড় উষ্ণতা। একেই বলা হচ্ছে বিশ্ব উষ্ণায়ণ। এর সাথে সাথে দেখা যাচ্ছে জলবায়ুর পরিবর্তনও। অর্থাৎ হেরফের হচ্ছে শীত, গ্রীষ্ম, এবং বর্ষার। শীতকাল তুলনামূলকভাবে উষ্ণ ও স্বল্প সময়ের হয়ে যাচ্ছে। গ্রীষ্মকালে সারাদেশ জুড়ে তাপপ্রবাহের প্রকোপ বেড়ে চলেছে। আর বর্ষাকালে কোথাও শুকনো খরা, তো কোথাও প্রবল বৃষ্টিপাতে বানভাসি।
আমরা বিশ্ব উষ্ণায়ণ ও জলবায়ু পরিবর্তন সম্বন্ধে অবগত হলেও, বেশিরভাগ মানুষই, বিশেষ করে শিক্ষিত সম্প্রদায়, অনেকাংশে উদাসীন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে অনেক আলোচনা ও নীতি নির্ধারণ হলেও জলবায়ু সংকট নিবারণে স্থানীয়ভাবে তেমন কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়ে না। অথচ, দিনদিন তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাতের অনিয়ম বেড়েই চলেছে। ফলে মানুষের শরীরে ও মনে দেখা দিচ্ছে নতুন সব রোগের। প্রতিবছর তাপপ্রবাহের ফলে মৃতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। অন্যদিকে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে কৃষিতে ফসল উৎপাদন। আফ্রিকার দরিদ্র দেশগুলিতে দেখা দিচ্ছে খাদ্য সংকট। বেঁচে থাকার তাগিদে অনেকে করছে পলায়ণ, হচ্ছে উদ্বাস্তু। আবার উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে গলছে মেরুপ্রদেশের বরফ, বাড়ছে সমুদ্রের জলতল। আগামিতে ডুবে যাওয়ার আশঙ্কায় অসংখ্য দ্বীপ ও উপকূলীয় শহর-জনবসতিগুলো।
জলবায়ু সংকটের দায় সমগ্র মানব সমাজের হলেও, শিক্ষিত সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসতে হবে এই সংকট মোকাবিলা করতে। একদিকে নিজেদের দৈনন্দিন জীবন ও ব্যবহারিক ক্ষেত্রে কার্বন নিঃসরণের পরিমান কমাতে হবে। তা সম্ভব হবে, বিদ্যুৎের সংযত ব্যবহার, এসি-ফ্রিজের কম ব্যবহার, ও প্রাইভেট কারের পরিবর্তে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার বৃদ্ধির ফলে। অন্যদিকে শিক্ষিত সম্প্রদায়ের দায়িত্ব জনসাধারণের কাছে বিশ্ব উষ্ণায়ণ ও জলবায়ু সংকট নিয়ে আলোচনা করা, জনসচেতনতা তৈরি করা।
লেখক অতিথি অধ্যাপক, ভূগোল বিভাগ আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়, আলিগড়
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct