মোঃ সাহিদুল ইসলাম
সামাজিক গবেষক, ইনস্টিটিউট অফ রুরাল ম্যানেজমেন্ট আনন্দ, গুজরাট
আমার নাম মুর্শিদাবাদ। আমি একটি ঐতিহাসিক ও অতিহ্যবাহী জেলা। এক সময় গোটা বাংলার সমৃদ্ধিশালী রাজধানী ছিলাম, সেটা আপনারা ইতিহাস পড়লেই বুঝতে পারবেন আমার মহিমা । আমি সময়ের সাথে সাথে নবাব থেকে শুরু করে সাহিত্যিক, যোদ্ধা, গায়ক, গবেষক কতইনা বীর সন্তান-সন্ততির জন্ম দিয়েছি। কিন্তু আঠারো শতকের মাঝে-মাঝি , ওই রক্ত খেকো সাদা চামড়ার অর্থ পিপাসু জালিমের দল আমার নবাব পুত্রকে ষড়যন্ত্র করে হত্যা করে, আর আমাকে দ্রোপদীর মতো বস্ত্র হরণ করে চিরতোরে বৃদ্ধাশ্রমের অবহেলিত মায়ের মত, আজও আমার দিকে কেউ তাকাই না। সে যুগে বিদেশি সাদা চামড়ার জন্তু গুলো ছিড়ে খেয়েছে, কিন্তু খুব কষ্ট লাগে যখন আমার নিজের সন্তানেরা সাদা-কাপড় পড়ে শুভ্রতার প্রতীক হয়ে ক্রমশ আমার মহিমা কে কলঙ্কিত করে ধ্বংসের কাঠ-গোড়ায় খাড়া করে দিচ্ছে। আজকে যখন আমি সর্বগ্রাসী সাদা চামড়া ও সাদা পোশাক পরা লুটেরার কাছে পণ্যদ্রব্য হয়ে গেছি , তখন আমি আর দু-চার কথা না বলে থাকতে পারছিনা। বর্তমানে, আমার যে করুণ অবস্থা , আশা করছি সে নিয়ে আপনাদের কোনো সন্দেহ নেই । এই করুণ অবস্থা বিভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে গুটি বসন্তের মতো আমার বক্ষে ফুটে উঠছে, যেমন স্বাস্থ্য-পরিকাঠামোর তীব্র অভাব, অচল শিক্ষা ব্যবস্থা, দারিদ্রতা উচ্চ সীমা, জীবন-জীবিকার অনটন ইত্যাদি , এরকম ভাবে উদাহরণ দিলে হয়তো শেষ হবে না। করুণ অবস্থার আরেকটা দিক যদি তুলে ধরতে হয়, সেটি হলো “আঞ্চলিক বৈষম্যতা” বলা যেতে পারে। অর্থাৎ আমার অন্যান্য দিদি ভাই জেলা গুলি সরকার এবং বেসরকারের সহায়তায় যেভাবে উন্নতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, সেই নিরিখে আমি যেন মনে হচ্ছে আমি আমার মায়ের একটা সৎ-কন্যা যে বিভিন্ন ভাবে বঞ্চিত, যার কষ্ট ও দুঃখ্যের কোনো অন্ত নেই, আর তার নিবারণের কোনো প্রচেষ্টা চোখে পড়ছে না, ক্রমশ অবনতির শিখরে উঠছি । আরেকটু বিস্তারিত ভাবে বলা যাক। আমি রাজ্যের অন্যান্য জেলাগুলির মধ্যে চতুর্থ জনবহুল জেলা । মানব উন্নয়ন সমীক্ষা (২০০৪) অনুযায়ী আমি স্বাস্থ্য, শিক্ষা , এবং অর্থের দিক থেকে অনেক পিছিয়ে পড়েছি । আমার মোট ২৬ টি ব্লক এর মধ্যে ২৩ টি ব্লক এখনো অনুন্নত রয়েছে। আর্থ - সামাজিক ভাবে পিছিয়ে পড়ার সাথে সাথে ভারতবর্ষের মোট দারিদ্র জনগণের প্রায় ২% জনসংখ্যা আমার কাছে বসবাস করছে । বহুমাত্রিক দারিদ্র্য সূচক অনুযায়ীও আমি পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত জেলার মধ্যে শেষ দ্বিতীয় স্থানে রয়েছি যেটি চরম বঞ্চনাকে নির্দেশ করছে। ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (IFPRI ) অনুযায়ী, পুষ্টি অর্জনের (Nutrition attainment ) ক্ষেত্রে আমি ভারত মাতার ৫৯৯ টি জেলার মধ্যে ৪৭১ তম স্থানে রয়েছি, অর্থাৎ আমি আমার ছেলে মেয়ে কে দু বেলা ঠিক ভাবে খেতে দিতে পারছিনা।আমার স্বাস্থ্য- পরিকাঠামোর দিক থেকেও, গ্রামীণ এবং শহরের মধ্যে অনেক অন্তর বানিয়েছে ওরা । পশ্চিমবঙ্গের মোট জনসংখ্যার মোটামুটি ৭০ শতাংশ গ্রামাঞ্চলে বসবাস করে কিন্তু রাজ্যের সমস্ত ‘হাসপাতাল-বেড’ এর মাত্র ১৪ শতাংশ বেড এর সুবিধা রয়েছে যেখানে শহরাঞ্চলে মোটামুটি ৩০ শতাংশ জনগণ বসবাস করে সেখানে ৮৫ শতাংশের বেশি বেড এর বন্দোবস্ত আছে। আমাকে প্রতি বেড হিসাবে ৪১৯৭ জন গ্রামাঞ্চলের জন্যে দিয়েছে কিন্তু ২৬৮ জন শহরাঞ্চলে র জন্যে দিয়েছে । আপনারা বলতে পারেন এটা কোন ধরণের হিসাব ? এটা কি সাম্য ? আমাকে একটাই মেডিকেল কলেজ দিয়েছ সেটিও আবার অযোগ্য, প্রতিদিন হাজারো আমার সন্তানকে অযোগ্য ডাক্তারের শিকার হতে হয়। অনেক সময় তারা আবার তাদের OPD কক্ষ থেকে অপমান করে অন্যায় ভাবে চিকিৎসা না করেই বের করে দেয়।জীবনদায়ী পানীয় জলের যে সংকট সেটা অবর্ণনীয়। চিকিৎসা বিজ্ঞানের গবেষণালব্ধ পত্র তুলে ধরেছে যে , আমার পানিও জলে অন্যান্য জেলার তুলনায় আর্সেনিকের মাত্রা খুব বেশি। আর্সেনিকের যে কুফল, সেটা আপনারা সকলেই জানেন । বর্তমান পরিস্থিতে,অনিয়মিত বর্ষা কালের তান্ডব তো সকলেই দেখছেন, ভূগর্ভস্থ জলের সংকট ও দেখা যাচ্ছে। যারফলে মানব জীবন সহ কৃষিকাজ বিপুল ভাবে বিঘ্নিত। এ প্রসঙ্গে,বিভিন্ন জল-প্রকল্প গুলির বাস্তবায়িতার যে অভাব সেটা না বললেও হয়।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct