ড. মুহাম্মদ ইসমাইল: নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধান/ বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান/ ৩৩ কোটি মোরা নাহি কভূ ক্ষীন,/ হতে পারি দীন,/তবু নহি মোরা হীন।
ভারতবর্ষ বরাবর গৌরবের ভূমি তার বৈচিত্র্য এবং ঐক্যের জন্য। এই দেশে বসবাস করে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, জৈন, পারসি থেকে পৃথিবীর সকল ধর্মালম্বী মানুষজন। ভারতবর্ষ হাজারো সংস্কৃতি, বর্ণ ও জাতির আশ্রয়স্থল। যুগ যুগ ধরে শান্তি, মৈত্রী ও সম্প্রীতির দেশ হিসেবে প্রশংসা পেয়েছে বহু দেশি ও বিদেশি লেখকদের কলমে। এই দেশ শাসন করেছে মোগল, খিলজি, পাঠান, সুলতানী বাজবংশ থেকে শুরু করে ইংরেজরা কয়েকশো বছর ধরে। যেখানে সুরক্ষিত ছিল ধর্মীয় উপাসনালয় ও ধর্ম পালনের অধিকার এবং প্রয়োজন হয়নি অভিন্ন দেওয়ানী আইন। হিন্দু, মুসলমান ও সকল ধর্মাবলম্বীদের মিলিত প্রচেষ্টায় দেশের স্বাধীনতা এবং কাঁধে কাঁধ জড়িয়ে তিল তিল করে গড়ে উঠেছে সব কিছু। কিন্তু হঠাৎ করে ২০১৪ সালের পর থেকে পরিবর্তনের হাওয়া জোরালো হয়েছে। সব কিছুর বিভাজন, নাম পরিবর্তন, ইতিহাসের পাতার পরিবর্তন থেকে সব কিছু একটা মতাদর্শে রূপান্তরিত করার চেষ্টা চলছে। তা নিয়ে গেল গেল আওয়াজ চারদিকে, তা করতে দেশের উন্নয়ন চাপা পড়েছে এবং দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অশান্তি, বেকারত্ব, আর্থিক মন্দা, সাম্প্রদায়িক শক্তির উৎপাত, ধর্মীয় উস্কানিমূলক বক্তব্য, বিদ্বেষমুলক বক্তৃতা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। যা ভারতীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে বিনষ্ট করছে। তার জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে ভারতের মর্যাদা ক্ষুন্ন হয়েছে এবং নানা আন্তর্জাতিক মহলে বারবার জবাবদিহি করতে হচ্ছে ভারতকে। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠছে বারবার কাঠগড়ায় কেন সরকারি কার্যকলাপ?সরকার কি সত্যি নিরপেক্ষ? তা হলে কেন, কয়েক বছর শাসন ব্যবস্থা চালাতে গিয়ে হাজারো সমালোচনা ও সমস্যার সম্মুখীন? তার কারণ হিসেবে অসৎ উদ্দেশ্য রয়েছে বলে অনেকে মনে করছে। আসলে দেশভক্তি ও দেশের অখণ্ডতা রক্ষার নামে দেশে একনায়কতন্ত্র গড়ে তুলতে চাইছে। শুধু তাই নয়, কয়েক দশক ধরে ধর্মের নামে মাথাচাড়া দিয়েছে নানা সংগঠন এবং কট্টর রাজনৈতিক দল যাদের প্রধান উদ্দেশ্য হল একতার আড়ালে ভারতের মহান ঐতিহ্য ও বৈচিত্র কে ভেঙ্গে চুরমার করে একটা বিশেষ মতাদর্শের দেশ তৈরি করা। সারা বছর নানা ধর্ম ও ধর্মীয় উৎসব অনুষ্ঠিত হয় কোন না কোন ধর্মের। যে দেশে এক ধর্মের লোক অন্য ধর্মের উৎসব পালনে সুরক্ষা দেই, সেই দেশের জনগণের জন্য অভিন্ন দেওয়ানী আইন প্রণয়ন করার প্রয়োজনীতা কতটা যুক্তি সস্মত তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে নানা মহলে? যার ফলে ভারতীয় সভ্যতার নিজস্বতা ভুলন্ঠিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে ও সহিংসতা বৃদ্ধি সম্ভাবনা রয়েছে।
ভিন্নতায় যেখানে দেশের নিজস্বতা সেখানে এক করা মানেই ব্যক্তি স্বাধীনতার ওপর কুঠারাঘাত করা। ভিন্নতা হওয়া সত্বেও দেশে সমস্ত মানুষ একই সূত্রে বাঁধা। আমরা ভিন্ন ধর্মের, ভিন্ন মতের, ভিন্ন বর্ণের, ভিন্ন জাতের, ভিন্ন খাদ্যের, ভিন্ন পোশাকের, ভিন্ন জায়গার বসবাসকারী হলেও আমাদের মাঝে কোন ভিন্নতা ও ভেদাভেদ নেই। সর্ব প্রথম ভারতবাসী হিসেবে সকলের পরিচয় যা বহু যুগ ধরে চলে আসছে। যেখানে একতার নামে কোন অভিন্ন দেওয়ানী আইন ছিল না। তবে গত ২০১৪ সালের পর থেকে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে নানা ধরনে বিভাজন তৈরি করছে। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য মন্দির, মসজিদ ও নানা ধর্মীয় বিশ্বাসের উপর বারবার আঘাত হানার চেষ্টা করছে ও বিভিন্ন আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ধর্মীয় নানা বিধির সংযোজন ও পরিযোজন করার প্রয়াস চালাচ্ছে। যা দেশের অখুন্নতা, বৈচিত্র্যতা, সংহতি ও ঐক্যের পরিপন্থী। কারণ ভারতবর্ষ কয়েক হাজার বছর ধরে নানা ধর্ম, সংস্কৃতি নিয়ে তার ঐতিহ্য ও মহানতা প্রকাশ করেছে। লিঙ্গুইস্টিক সার্ভে অফ ইন্ডিয়া বলছে ভারতে ৭৮০ টি ভাষা রয়েছে যার মধ্যে ৫০ টি ভাষা অবলুপ্ত হয়ে গেছে গত ৫০ বছরে। তবে অফিশিয়াল তালিকায় ১২২টি ভাষা আছে, যাদের মধ্যে ২৩ টি ভাষায় কার্যাবলী সম্পাদন হয়। প্রায় সাতশোর বেশি আদিবাসী সম্প্রদায়ের বাসভূমি। এই দেশ বৈচিত্রের ভূমি, যেখানে নানা ধর্ম, নানা মত, নানা প্রকার খাদ্য, নানা ধরনের ভাষা আছে এবং নানা ধরনের উৎসব নানা সময়ে অনুষ্ঠিত হয়। বিবাহের পদ্ধতি, রীতিনীতি, রেওয়াজ, আঞ্চলিকতা থেকে কত কিছুর পার্থক্য।
ইংরেজরা ভারতে শাসন করার সময় চেষ্টা করেছিল পশ্চিমা ধ্যান ধারণা ভারতীয় সমাজ ও সংস্কৃতিতে মেশাতে এবং নানা ধর্মীয় বিধানকে ভেঙে একটা অভিন্ন আইন প্রণয়ন করতে। কিন্তু ভারতীদের নানা ধর্মের বিশ্বাস, সমাজ, সংস্কৃতি ও ধ্যান ধারণার উপর আঘাত আসবে বলে তা করা থেকে বিরত ছিল এবং শুধু তাই নয়, ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে একই ধর্মের মানুষ বিভিন্ন ধ্যান ধারণায় বিশ্বাসী এবং তাদের ধর্মীয় আচরন থেকে শুরু করে সাংস্কৃতিক ও নানা বিষয়ে বিস্তার পার্থক্য দেখা যায়। তাই ১৪০ কোটি মানুষের ধ্যান ধারণা, ধর্মীয় বিশ্বাস, রেওয়াজ, রীতিনীতি, ভাষা খাদ্য এক করা সম্ভবপর নয়। তেমনই ভাবে বিভিন্ন বিষয়ে একই আইনে সকল ধর্মীয় মানুষকে বাধাও সম্ভবপর নয়। কারণ ধর্ম মনের বিশ্বাস, বিশ্বাসে আঘাত হানা যায় না।
ভারতে ধর্মীয় স্বাধীনতা মৌলিক অধিকার যা সংবিধানের ২৫ থেকে ২৮ অনুচ্ছেদে বর্ণিত। প্রত্যেকের অধিকার আছে শান্তিপূর্ণ ভাবে ধর্ম পালন করার ও প্রচার করার। ভারত পৃথিবীর চারটি ধর্মের জন্মভূমি হলেও , লাক্ষাদ্বীপ, জম্মু ও কাশ্মীরে ইসলাম ধর্মের আদিত্য দেখা যায়, পাঞ্জাবের শিখ ধর্মের আধিক্য, নাগাল্যান্ড মেঘালয় এবং মিজোরামে খ্রিস্টান ধর্মের আধিক্য রয়েছে এবং বাকি রাজ্যগুলো হিন্দু ধর্মালম্বীদের আধিক্য রয়েছে।
পরবর্তী অংশ আগামীকাল...
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct