নাথান হজ : শিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন গত বুধবার এক বৈঠকে মিলিত হয়েছেন। রাশিয়ার মহাকাশযান উেক্ষপণকেন্দ্র ভস্তোচনি কসমোড্রোমে ‘একান্ত আলোচনা’ চলে এ দুই নেতার মধ্যে। মজার ব্যাপার হলো, পুতিন-কিম মিটিংয়ের কয়েকটি ছবি প্রকাশ্যে এসেছে মাত্র; কিন্তু তাদের মধ্যে ঠিক কী নিয়ে কথাবার্তা হয়েছে, তা নিয়ে সবাই অন্ধকারে। বলা বাহুল্য, এ নিয়ে জল্পনা-কল্পনার অন্ত নেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে! গণমাধ্যমগুলোর খবরে বলা হচ্ছে, দুই নেতার আলোচনায় গুরুত্ব পেয়ে থাকতে পারে সমরাস্ত্র, ইউক্রেন যুদ্ধ ও উত্তর কোরিয়ার স্যাটেলাইট কর্মসূচির মতো বিষয়। ক্রেমলিন এই বৈঠককে আখ্যায়িত করেছে ‘খুবই গুরুত্ববহ বৈঠক’ হিসেবে। তবে সত্যি বলতে, বৈঠকের প্রকাশিত ঐ কয়েকটি ছবি ছাড়া বেশি কিছু জানার সুযোগ নেই বাইরের জগতের! বন্ধ দরজার আড়ালে ঠিক কী ঘটল, সে ব্যাপারে সামান্যতম ধারণা করাটাও মুশকিল যে কারো জন্য।রাশিয়ার আমুর অঞ্চলে পুতিন ও কিম যখন মহাকাশকেন্দ্র পরিদর্শন করছিলেন, তখন বেশ আত্মপ্রত্যয়ী হিসেবে দেখা গেছে দুই স্বৈরশাসককে। দুই নেতা যখন পরস্পরের সঙ্গে ৪০ মিনিট ধরে করমর্দন করেন, তখন তাদের মুখাবয়বে ফুটে ওঠে সেই একই চিত্র—‘পরস্পরের বিশ্বস্ত বন্ধু’। রুশ অধিপতির সঙ্গে মুখোমুখি বৈঠকের পর প্রতিপক্ষের উদ্দেশে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে কিম বলেছেন, ‘দুষ্টশক্তি’কে ধরাশায়ী করবে রাশিয়া। শত্রুপক্ষকে শাস্তি দিতে স্বৈরশাসক কিমের এ ধরনের কথাবার্তা ‘ভয়ংকর’ পুতিনের গত্বাঁধা কথার প্রতিধ্বনি বই আর কিছুই নয়। শুধু তাই নয়, সার্বভৌম ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যে ঘৃণ্য-অপ্রত্যাশিত যুদ্ধ শুরু করেছেন যুদ্ধবাজ পুতিন, তার প্রতি সমর্থন পুর্নব্যক্ত করেছেন কিম। যদিও বৈঠকের পর কোনো ধরনের সংবাদ সম্মেলন করতে দেখা যায়নি উভয় পক্ষের কাউকেই। এমনকি কোনো বিবৃতিও জারি করেনি ক্রেমলিন কিংবা পিয়ংইয়ং। বাস্তবিক অর্থে, নিজেদের মধ্যে কোনো বিশেষ চুক্তি হয়েছে বা হতে যাচ্ছে কি না, সে সম্পর্কে খোলাসা করে কিছু বলছে না কেউই (এবং বলবেও না!)। অর্থাত্, চুক্তির বিষয়াবলি প্রকাশ্যে না আসায় বিশেষ করে রাশিয়ার জন্য ‘আসল পথ খুঁজে বের করা’ চ্যালেঞ্জিং হয়ে পড়বে সম্ভবত। বাস্তবতা হলো, সংকট উত্তরণে জুতসই কোনো রাস্তা বের করাটা ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়ছে উভয় দেশের জন্যই। এর কারণ, দুই দেশই কার্যত বিচ্ছিন্ন বহির্বিশ্ব থেকে!মনে থাকার কথা, রাশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু ‘আপাত কেনাকাটার তালিকা’ হাতে নিয়ে পিয়ংইয়ংয়ে উড়ে গিয়েছিলেন গত জুলাই মাসে। কিমের রাজ্যে শোইগুর ছুটে যাওয়ার পেছনে কারণ ছিল, দেড় বছরকাল ধরে চলমান ইউক্রেন যুদ্ধে এখন পর্যন্ত খুব একটা কায়দা করে উঠতে পারেনি মস্কো। আক্রমণ ও পালটা আক্রমণ তথা যুদ্ধের ময়দানে টিকে থাকার প্রশ্নে রাশিয়ার হাতে পর্যাপ্ত গোলাবারুদও নেই। খালি হয়ে আসছে অস্ত্রভান্ডার। এই অবস্থায় পুতিন যে ‘পরম বন্ধু’ কিমের দ্বারস্থ হবেন, তা জানাই ছিল। মার্কিন কর্মকর্তারা সতর্ক করে বলেছিলেন, ‘ইউক্রেনে হাড্ডাহাড্ডি সংঘর্ষ চলমান রাখতে রাশিয়ার জন্য যে মাত্রায় যুদ্ধসরঞ্জামের প্রয়োজন পড়বে, তাতে করে রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়া বিশেষ কোনো চুক্তিতে আবদ্ধ হতে পারে। এবং সন্দেহ নেই, এর জন্য কোরীয় উপদ্বীপের অস্ত্রাগারে হাত দিতে রাজি হবে দুই মিত্র।’ এই প্রসঙ্গে বলে রাখা দরকার, যদি সত্যি সত্যিই মস্কো ও পিয়ংইয়ং অস্ত্রচুক্তিতে আবদ্ধ হয়, তবে ইউক্রেন যুদ্ধ নতুন মোড় নেবে—এটা একপ্রকার নিশ্চিত। যদিও এখন পর্যন্ত এমন কোনো তথ্য-প্রমাণ প্রকাশ্যে আসেনি, যাতে নিশ্চিত হওয়া যায়, এ ধরনের কোনো চুক্তিতে সম্মত হয়েছেন কিম-পুতিন।
আরো উল্লেখ করা দরকার, প্রকৃতপক্ষেই যদি রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়ার মধ্যে অস্ত্রচুক্তির কোনো ঘটনা ঘটে থাকে, তবে তা থেকে শুরু হবে ‘নতুন খেলা’! মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর সঙ্গে রাশিয়ার যে সংঘাত, তাতে রুশ শিবিরে যুক্ত হবে পিয়ংইয়ং। এবং এর ফলে উভয় পক্ষের প্রতিযোগিতার মাঠে পিয়ংইয়ংয়ের প্রবেশের ফলে যুদ্ধ-সংঘাত ঠিক কোন দিকে মোড় নেবে, সেটাই দেখার বিষয়! পশ্চিমা পক্ষের তরফ থেকে ইতিমধ্যে বেশ কয়েক দফা হুঁশিয়ার করে বলা হয়েছে, পিয়ংইয়ং যদি রাশিয়াকে অন্ত্র-গোলাবারুদ সরবরাহ করে, তবে রাশিয়ার সঙ্গে সঙ্গে উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধেও পালটা ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এই পক্ষের কড়া উচ্চারণ, ‘এটা একটা জীবন-মরণ খেলা। বাঁচা-মরার প্রতিযোগিতা। কাজেই রাশিয়াকে অস্ত্রসরঞ্জাম দিয়ে সমর্থন করলে কিমকে বরণ করতে হবে পুতিনের মতো পরিণতি।’ পুতিন সম্ভবত এমন চিন্তা করছেন, ইউক্রেনকে সমর্থন করার প্রশ্নে সামনের দিনগুলোতে ‘ধীরে চলো’ নীতিতে হাঁটবে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আসন্ন ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দিনক্ষণ যতই ঘনিয়ে আসবে, ততই ইউক্রেনের প্রতি সমর্থন কমানোর পথে হাঁটতে বাধ্য হবে পশ্চিমা পক্ষ। একটি বিষয়ে দৃষ্টি দেওয়া জরুরি, মস্কোকে জোর সমর্থন দেওয়ার মধ্য দিয়ে পিয়ংইয়ং হয়তোবা কিছু একটা পাওয়ার চিন্তা করছে! কারণ, কিমের শাসনব্যবস্থা ব্যাপকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। দফায় দফায় নিষেধাজ্ঞা আরোপের মাধ্যমে উত্তর কোরিয়াকে দীর্ঘকাল ধরে বেশ কোণঠাসা করে রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। মূলত কিমের পারমাণবিক ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির লাগাম টানতেই এই ব্যবস্থা। এই অবস্থায় পুতিনকে সমর্থন করা ছাড়া কিমের হাতে তেমন কোনো জুতসই বিকল্পও নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বাস, শুরু থেকেই ইউক্রেন যুদ্ধের ‘আড়ালের খেলোয়াড়’ পিয়ংইয়ং। এমনকি রাশিয়ার ভাড়াটে সেনা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ওয়াগনার গ্রুপকে অস্ত্র সরবরাহ করে থাকতে পারেন কিম—এমন ধারণাও রয়েছে! আমরা দেখেছি, গত মাসে যখন ওয়াগনারের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান ইয়েভজেনি প্রিগোশিনের বিমান দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার খবর আসে, তখন তাকে খুব একটা পাত্তা দিতে চায়নি উত্তর কোরিয়া। বরং এই ঘটনাকে প্রথম দিকে ‘গালগল্প ও জল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়’ বলেও চালিয়ে দিতে চেষ্টা করে মস্কোর বন্ধু পিয়ংইয়ং। অর্থাত্, রাশিয়া-উত্তর কোরিয়া মিত্রতা যেন কোনোভাবেই ‘শেষ হওয়ার নয়’। পরিশেষে বলতে হয়, সত্যিই যদি রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়া কোনো ধরনের অস্ত্রচুক্তির পথে হাঁটে, প্রযুক্তি হস্তান্তর করে থাকে, তাহলে বিশ্ব সম্ভবত ঢুকে যাবে ‘এক অন্য যুগে’—যে রকমটা বলা হয়েছে আগেও। আর সেক্ষেত্রে ১৯৪৫ সালের পর থেকে ইউরোপে সবচেয়ে বড় স্থলযুদ্ধের সাক্ষীতে পরিণত হব আমরা। রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়ার মতো পারমাণবিক শক্তিধর দুই রাষ্ট্রের একসঙ্গে পথ চলার অর্থই হচ্ছে ‘ধ্বংসের বার্তা’! সুতরাং, ‘কিম-পুতিন মিলন’ অপ্রত্যাশিত সব সময়ই। এবং এ দুই স্বৈরশাসকের মিলিত শক্তি যে কতটা বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে, তা না বুঝতে পারার কথা নয়!
লেখক: সিএনএনের জ্যেষ্ঠ সম্পাদক
সিএনএন থেকে অনুবাদ: সুমৃৎ খান সুজন
সৌ: ইত্তে:
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct