এম মেহেদী সানি, হাওড়া, আপনজন: দারিদ্রতার সঙ্গে লড়াই করে আক্তার আজ ইঞ্জিনিয়ার, ভুলে যান নি সে কথা, তাই সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে সেরার সেরা করে গড়ে তুলতে দ্বীনি শিক্ষার সমন্বয়ে উচ্চমানের শিক্ষাদানের লক্ষ্যে নিজ উদ্যোগে গড়ে তুলেছেন হামদান মিশন ৷ তবে এসবের পেছনে রয়েছে এক হার না মানে জীবনের গল্প ৷ আক্তার ছিল বাড়ির বড় ছেলে ৷ আর্থিক দুর্দশা গ্রস্থ সংসারের হাল ধরতে একসময় পড়াশোনার পাশাপাশি জরির কাজেও করতে হয়েছে। নিদারুণ দারিদ্রতাকে সঙ্গী করেই বেড়ে উঠেছেন হাওড়ার উলুবেড়িয়ার বাগান্ডার কৃতী ছাত্র ইঞ্জিনিয়ার সৈয়দ আক্তার আলি ৷ বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম মুসলিম রাষ্ট্র ওমানে কর্মরত রয়েছেন। জানা গিয়েছে, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইনফরমেশন টেকনলজির উপর ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি অর্জন করেন করেন ৷ আক্তার আলি ২০০৮ সাল থেকে বিদেশেই কর্মরত। তবে চাকরিজীবন শুরু হয়েছিল সল্টলেকের আইবিএম কম্পানিতে। আইবিএম-এ থাকাকালীন ২০০৮ সালে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে চলে যান। এরপর আক্তারকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। তাঁর জীবন সংগ্রাম রূপকথার গল্পের মতো। পিতা-মাতাসহ তিন ভাই, তিন বোনকে নিয়ে তাদের সংসার। পিতা বাসের ড্রাইভারের কাজ করতেন, মা গৃহবধূ। পিতা যেটুকু আয় করতেন, তাতে সংসার চলা দায়, তাই তিনি হাত লাগান জরির কাজে। সপ্তম থেকে দশম শ্রেণিতে পড়াকালীন নিজের খরচ নিজেই চালানোর জন্য জরির কাজে নেমে পড়েন আক্তার। এভাবেই চারটি বছর কাটিয়ে দেওয়ার পর গ্রামের স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাশ করেন ১৯৯৯ সালে ৷ এরপর তার বিদ্যালয়ের এক শিক্ষকের পরামর্শে হাওড়ার খলতপুরে আল-আমীন মিশনে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হন। সেখান থেকেই উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেন ২০০১ সালে এবং ওই বছরই জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে যাদবপুরে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সুযোগ পান। আর সেখানেই সম্পন্ন করেন ইনফরমেশন টেকনলজি কোর্স। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসিংয়ে পেয়ে যান চাকরি। আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি৷
২০০৮ সাল থেকে দু’বছর অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে থাকার পর আক্তার চলে যান সৌদি আরবে। ২০১৫ সাল পর্যন্ত সৌদি আরবে সফটওয়্যার কনসাল্ট্যান্ট হিসেবে চাকরি করেন। ২০১৫-র পর ওই পদেই ওমানের পেট্রোলিয়াম ডেভেলপয়েন্ট ওমান কোম্পানিতে যোগ দেন। আজও তিনি সেখানেই কর্মরত রয়েছেন। এতকিছুর মধ্যেও কখনো ভুলে যাননি নিজ ধর্মকে, মুখে চাপ দাড়ি, নামাজ-রোজায় নিবেদিত প্রাণ, পাশাপাশি দ্বীনের দাওয়াত দিতে পছন্দ করেন সর্বদা ৷ আক্তারের ব্যতিক্রমী এই অভ্যাস মুগ্ধ করে সকলকেই ৷এই কয়েক বছরে সৈয়দ আক্তার আলি তিন বোনের বিয়ে দিয়েছেন এবং দুই ভাই এর পড়াশুনা সম্পন্ন করিয়েছেন। তাঁর দুই ছোট ভাই ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া শেষ করে কলকাতায় কর্মরত। তবে তার জীবন এখানেই শেষ নয়। সৌদিতে থাকাকালীনই ইসলাম শিক্ষা নিয়ে ইন্টারন্যাশনাল ওপেন ইউনিভার্সিটি থেকে শারিয়াহ কোর্সে চার বছরের ব্যাচেলর ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। তবে কর্মব্যস্ততার জন্য শারিয়াহ কোর্সে মাস্টার ডিগ্রিটি মাঝপথেই থেমে যায়। কিন্তু ইসলাম নিয়ে গবেষণা থেমে থাকেনি। এখনও গবেষণার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। ইসলামি আদর্শে বড় হওয়া এই আক্তারের লক্ষ্য কী করে বাংলার সংখ্যালঘু মুসলিমদের উন্নয়ন করা যায়। সেই লক্ষ্যেই বৃহত্তর স্বার্থে ২০১০ সালে এলাকার ছাত্রছাত্রীদের উন্নয়নের জন্য তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ন্যাশনাল ইসলামিক স্কুল, যা সাফল্যের সঙ্গে আজও এগিয়ে চলেছে পাশাপাশি সাম্প্রতিক সময়ে আক্তার গড়ে তুলেছেন হামদান মিশন। ২০২৩ শিক্ষাবর্ষ থেকে হামদান মিশনের পথ চলা শুরু হয়েছে। কোটি কোটি টাকা খরচ করে মিশনের বিশাল ভবন নির্মাণ করেছেন তিনি ৷ ২০২৪ শিক্ষাবর্ষের জন্য ভর্তি প্রক্রিয়া ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে। হার না মানা জীবনের গল্প তুলে ধরতে গিয়ে এ দিন সৈয়দ আক্তার আলি আল-আমীন মিশনের সম্পাদক নুরুল ইসলামের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন ৷ আলামিন মিশন কর্তৃপক্ষ আক্তারকে একাদশ এবং দ্বাদশ শ্রেণিতে সম্পূর্ণ বিনা খরচে পড়াশোনা সুযোগ দিয়েছিল। সে কথা তুলে ধরে আক্তার বলেন, ‘আল-আমীন মিশনের পড়াশোনা চলাকালীন একটি বিষয় উপলব্ধি করেছিলাম। আমরা কি প্রকৃত মুসলিম হয়ে উঠতে পারছি ? আর সেই ভাবনা আরও প্রকট হয় ইসলাম শিক্ষা নিয়ে ডিগ্রি সম্পন্ন করার পর। সেই চিন্তাভাবনা থেকেই হামদান মিশন তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। হামদান মিশনকে দ্বীন ও দুনিয়া শিক্ষার আদর্শ পীঠস্থান হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। আর সেই লক্ষ্যেই মিশনের যাবতীয় কাজকর্ম চলছে, একদিকে আধুনিক শিক্ষা এবং অন্যদিকে দ্বীনি শিক্ষা দিয়ে পড়ুয়াদের আদর্শ নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে চাই।’ হামদান মিশনে প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক হিসাবে সৈয়দ আক্তার আলি আরও বলেন, ‘’আমরা সকলেই আমাদের প্রিয় নবী (সাঃ) এর সুপরিচিত হাদিস জানি যে - ‘জ্ঞান অন্বেষণ করা প্রত্যেক মুসলমানের (নারী ও পুরুষ) উপর ফরজ।’ তাই আমাদের সন্তানদেরকে ইসলামী শিক্ষা দেওয়া আমাদের জন্য আবশ্যক, যাতে তারা ইসলামী মূল্যবোধে বড় হয় এবং ছাত্রাবস্থায় দ্বীন ইসলাম সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান অর্জন করে। কিন্তু আমাদের সমাজে বেশিরভাগ মুসলিম ছাত্রছাত্রীরা সাধারণ স্কুলে যায়, যেখানে তাদের একেবারেই ইসলামী শিক্ষা দেওয়া হয় না, বরং তারা শির্ক পূর্ণ প্রার্থনা দিয়ে তাদের দিন শুরু করে। ঘোষণা থাকলেও মুসলিম পরিচালিত মিশনগুলোতেও ইসলামী শিক্ষার উপর জোর দেওয়া হয় না। যার ফলে আমরা দেখতে পায় যে অনেক মুসলিম উচ্চশিক্ষা অর্জন করে প্রতিষ্ঠীত হয়েছেন, কিন্তু মুসলিম হিসাবে তারা দ্বীন ইসলাম থেকে অনেক দূরে। তারা দুনিয়াতে সফল, কিন্তু আখেরাতে ক্ষতিগ্রস্ত। একথা অনস্বীকার্য যে আমাদের সমাজে উপযুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভাব রয়েছে যেখানে মুসলিম শিক্ষার্থীরা উপযুক্ত সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি সঠিক ইসলামী শিক্ষা পাবে। হামদান মিশন সাধারণ শিক্ষার সঙ্গে সমান গুরুত্বসহকারে ইসলামী শিক্ষা প্রদান করবে যাতে তারা দ্বীন ও দুনিয়া উভয় স্থানেই সফল হবে ইন শা আল্লাহ।’’ উজ্জল প্রজন্ম গড়ে তোলার প্রত্যাশা নিয়ে সকলকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান হার না মানা সৈয়দ আক্তার আলি ৷
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct