যে ছায়ায় আলোর মায়া
আহমদ রাজু
এমনিতে ভয় ভয় লাগছে- তার ওপর এমন নিস্তব্ধতা তার মনকে ভারি করে তোলে। পেছন থেকে দু’জন লোক সাইকেল হাঁকিয়ে তার দিকে এগিয়ে আসতে দেখে সে তাদের দিকে ঘুরে দাঁড়ায়। কিন্তু কী আশ্চর্য, লোক দু’টি তার কাছে আসা মাত্র ভয়ে দুই জন রাস্তার দুই দিকে ক্ষেতের কাদা পানিতে সরাসরি সাইকেল চালিয়ে দেয়। সেখানে পড়ে গড়াগড়ি খেয়ে দু’দিকে দে ছুট। ঘটনাটি দেখে কাকলির হাসি পেলেও মনের মধ্যে বিভিন্ন প্রশ্নের উদয় হয়। এই দুইজনকে চেনা চেনা লাগে। একজন হয়তো তার ছোট কাকা ময়েন অপরজন পাশের বাড়ির রশিদ দাদা। তবে তাদের বয়সে এমন ছাপ এলো কীভাবে? এইতো গতকালই তারা ছিল ইয়ং- একদম সাবলীল। আজ তাদের দু’জনের চেহারায় এত পরিবর্তন কেন? আর ছোট কাকা তো তাকে প্রচণ্ড ভালবাসতো- তবে কেন আজ তাকে দেখে এমন ভয় পেয়ে দৌঁড়ে পালালো?মাঠের শুরুতেই ময়েনদের বাড়ি থাকায় দু’জনে দৌঁড়ে উঠানে যেয়ে বেহুশ হয়ে পড়ে। শরীর জুড়ে কাদাপানিতে ভর্তি। লোকজন দৌঁড়ে এগিয়ে এসে চোখে মুখে পানি ছিটায়- মাথায় তেল-পানি মালিশ করে দেয়। হাত- পা ঠাণ্ডা দেখে সকলে অনুমান করে, নিশ্চয়ই ভয় পেয়েছে। এমনিতে মাঠের মাঝের পথটা বেশি একটা ভাল না, তার ওপর মাঝ দুপুর! দুপুরে অনেকে অনেক কিছু দেখেছে বহুবার। তবে তারা একা থাকা অবস্থায়। দুজন একসাথে কোনদিন কিছু দেখেনি। যে কারণে কেউ পারতোপক্ষে একলা অন্তত দুপুরে ওপথ মাড়ায় না। ময়েন আর রশিদ চোখ খুলে বড় বড় চোখে এদিক ওদিক তাকায়। যে চোখে ভয় আর শঙ্কা উন্মুক্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে সারা বাড়িময়। রশিদ দাঁতে দাঁত কেটে বলল, ‘কাকলি ফিরে এসেছে!’কথাটা ঠিক ভালভাবে বোঝা গেল না। তাইতো হামিদ গাজী তার দিকে ঝুকে পড়ে বলল, ‘কী বললি রশিদ?’রশিদের কথা বলার শক্তি নেই বললেই চলে। মুখ তার ফ্যাকাশে কাঠ হয়ে গেছে। কোন রকম অস্পষ্ট স্বরে বলল, ‘কাকলি ফিরে এসেছে!’হামিদ গাজী মুখে তাচ্ছিল্যের ভাব এনে বলল, ‘ধ্যাৎ, যত্তসব পাগলের দল।’ময়েন তখনও ঘোরের মধ্যে ছিল। সে এতক্ষণ একদৃষ্টে উপরের দিকে তাকিয়ে ছিল। বড় ভাইয়ের কথায় এবার মুখ খুলে কিছু একটা বলতে যেয়েও পারে না। গলা দিয়ে স্বর বের হয় না। বেশ কয়েকবার চেষ্টা করার পর স্বরটা কোন রকম বের হলো। বলল, ‘হ্যা, ভাইজান; রশিদ চাচা একদম ঠিক কথাই বলেছে। তুমি বিশ্বাস করো।’কাকলির কথা শুনে বয়স্ক মানুষগুলো যারা অন্তত কাকলিকে চিনতো-জানতো তারা যেন আকাশ থেকে পড়ে। ভয়ে তাদের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। তারা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকায়। কেউ সামনে-পেছনের গাছের দিকে তাকায়। না জানি কখন কাকলি সেখানে এসে হাজির হয়! মাঝ বয়সীরা কথাটাকে অসম্ভব বলে উড়িয়ে দেয়। তাদের ধারণা, একটা অসম্ভব কথা আর যাই হোক এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে কেউ বিশ্বাস করবে না। তাছাড়া বিশ্বাস হবার কোন কারণ নেই। তাদের সামনেই কবর দেওয়া হয়েছিল; যা এখন অতীত। অনেকেই ভুলে গেছে সে কথা। তরুণ-যুবকরা কাকলির কথা তাদের বাবা মায়ের কাছে শুনেছে। তাকে কারা হত্যা করেছিল- কে তুলে নিয়ে গিয়েছিল- কোথায় লাশ পাওয়া গিয়েছিল সব কিছু। আজ এতবছর পরে এসে এমন একটা কথা শোনার জন্যে মোটেও প্রস্তুত ছিল না কেউ। ইতিমধ্যে চারিদিকে চাউর হয়ে যায়, কাকলি গ্রামে ফিরে এসে ময়েনদের বাড়ি আশ্রয় নিয়েছে। দলে দলে লোক চারিদিক থেকে আসতে শুরু করে ময়েনদের বাড়ি। কয়েক মিনিটের মধ্যে পুরো বাড়ি এলাকার লোকজনের কোলাহলে সরব হয়ে ওঠে। একটা অবিশ্বাস্য ঘটনার সাক্ষী হবার জন্যে গ্রামবাসীর সে কী একাগ্রতা!
অবস্থা বেগতিক দেখে হামিদ গাজী বলল, ‘তোরা কী নাটক শুরু করেছিস বলতো? সারা গ্রামে রটে গেছে কথাটা। আর তোমরাও বাপু; কোথা থেকে কী শুনে এ বাড়িতে এসে জড়ো হয়েছো!’ উপস্থিত লোকজনের উদ্দেশ্যে কথাটি বলে হামিদ গাজী।ময়েন ততক্ষণে নিজেকে একটু সামলে নিয়েছে। বলল, ‘মিয়া ভাই, আপনি জানেন আমি কখনও আপনার সাথে মিথ্যা বলিনি- বলতে পারি না। তাহলে বিশ্বাস করছেন না কেন?’‘চুপ থাক বেকুপ। মিথ্যা বলিস না ঠিক আছে। তাহলে আজ মিথ্যা বলছিস কেন? আর কেনইবা এই আওজালা পরিবেশের সৃষ্টি করলি?’রশিদ উঠানের মাঝে পুতে রাখা বাঁশের খুঁটি ধরে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, ‘ভাইপো, ময়েন মিথ্যা কথা বলছে না। কাকলি অবশ্যই ফিরে এসেছে। বাজার থেকে ফেরার পথে আমাদের সাথে ওর দেখা হয়েছে।’হামিদ গাজী পেটের ভেতর থেকে উঠে আসা হাসি কোনরকম থামিয়ে বলল, ‘তা তোদের কী বললো?’‘বলার সুযোগ কই? তাকে দেখে আমরাতো ক্ষেতের মধ্যে সাইকেল ফেলে দৌঁড়ে কোন রকম জান নিয়ে ফিরে এসেছি।’ বলল ময়েন।হামিদ গাজী আগত লোকজনের উদ্দেশ্যে বলল, ‘আমার ছোট ভাই আর চাচা ভূতের খপ্পরে পড়েছিল। তোমরা যে যার কাজে যাও। আর একটা কথা, এমন আজগুবি কথা শুনে তোমরা আবার যেন সেদিকে দৌঁড়ে যেও না।’সবাই যখন ঘুরে বাড়ির দিকে পা বাড়ায় তখন সামনে এসে দাঁড়ায় কাকলি। সারা মুখে শুকনো মাটির আবরণ থাকলেও তাতে চেহারা লুকাতে পারে না। বিনি বাঁধা চুলে পুরোটাই জটা ধরেছে। সামনে উসকো খুসকো জংধরা কয়েকটা খোলা চুল যত্রতত্র উড়ে বেড়ায়। পরনের পোশাক যেন বহু বছর যুদ্ধ করে কোনমতে টিকে আছে। একটু ছোঁয়া লাগলেই খসে পড়বে সে। জায়গায় জায়গায় পোশাকের আসল রঙ উঁকি মারে তবুও। তেইশ বছর আগে যেদিন লাশটা জঙ্গলে পেয়েছিল সেদিনও এই পোশাক তার পরনে ছিল! দেখে মনে হয় বহুবছর না খেয়ে-না নেয়ে ঘুমিয়ে ছিল। কিছুক্ষণ মাত্র তার ঘুম ভেঙেছে! এমন বিস্ময় সামনে দেখে দুর্বলচিত্তের মানুষগুলো সেখান থেকে পালিয়ে বাড়ি গিয়ে ঘরের খিল এটে বসে থাকে। কেউ কেউ না পালিয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে অবস্থা কী বোঝার জন্যে। হামিদ গাজী ভীড় ঠেলে সামনে আসে। কাকলির দিকে চোখ পড়তেই তার সমস্ত শরীর বিদ্যুতের গতিতে চমকে ওঠে। মুখ থেকে কোন শব্দ বের হয় না। একটা কিছু বলতে যেয়েও পারে না। সব যেন গলার ভেতরেই আটকে যায়। নিজেকে সামলে নিলেও ভয়ে ঠোঁট কাঁপাকে কাঁপাতে বলল, ‘কে তুমি?’
হামিদ গাজীর বয়স হয়েছে। কালো চুল এতদিনে সব সাদা হয়ে গিয়েছে। মুখ ভর্তি লম্বা দাড়ি। সেই জৌলুস না থাকলেও এককালে যে ছিল তা দেখে সহজে বোঝা যায়। নিজের বাবাকে চিনতে মোটেও অসুবিধা হয় না কাকলির। সে দু’পা এগিয়ে বাবার সামনে যেয়ে বলল, ‘এসব আমার সাথে কী হচ্ছে আব্বা! রাতারাতি সব এতটা পাল্টে গেল কীভাবে?’ রাতারাতি! কী বলে ও। হামিদ গাজীতো হতবাক। এ কী কথা! কাকলির ফিরে আসা যতটা বিস্ময়কর ঠিক ততটা বিস্ময়কর কথা এই ‘রাতারাতি’ শব্দটা। হামিদ গাজীতো আর একবার ধাক্কা খায়। একটা কিছু বলতে যেয়েও মুখ থেকে সে কোন শব্দ বের করতে পারে না। বাবার নীরবতা দেখে কাকলি বলল, ‘আব্বা আমার সাথে এসব কী হচ্ছে? আমাকে দেখে সব পালিয়ে যাচ্ছে কেন? আমিতো কিছুই বুঝতে পারছি না!’ কাকলির প্রশ্নের কোন জবাব দিতে পারে না হামিদ গাজী। চেষ্টা করেও তার গলা দিয়ে কোন স্বর বের হয় না। কী হচ্ছে এসব! ইতিমধ্যে সেখানে এসে হাজির হয়েছে হাবলু। হাতে তার হাসুয়া। গ্রামে কাকলির ভূত এসেছে শুনে ভূত মারতে একপ্রকার দৌঁড়ে চলে এসেছে। হাবলুর দুই ছেলে পেছন পেছন ছুটে আসে বাবাকে ঠেকানোর জন্যে। তারা জানে- বাবার মাথা গরম; যে কোন কিছু ঘটিয়ে ফেলতে পারে। তার স্ত্রী তানিয়া আসতে চাইলে হাবলু তাকে ধমক দিয়ে বলেছিল, ‘মেয়ে মানুষ, মেয়ে মানুষের মতো থাকো। যা হয় আমি দেখে এসে বলবো।’ স্বামীর কথায় আর কথা বাড়ায়নি তানিয়া। সে এত বছরে বুঝে গেছে, স্বামীর কথার অবাধ্য হলে কপালে দুঃখ এমন ভাবে নামবে যে আষাঢ়- শ্রাবণকেও হার মানাবে। ‘এই সরো তো কী হয়েছে দেখি।’ বলে হাসুয়া উঁচু করে ভীড় ঠেলে সামনের দিকে আসতে থাকলে তার ভয়ে লোকজন দুইপাশে সরে যায়। সামনে এসে কাকলির চোখে চোখ পড়তেই কোন কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার হাতের হাসুয়া কখনযে নিচে পড়ে যায় সে বুঝতেই পারে না। বাবার মতো তার গলা দিয়েও কোন স্বর বের হয় না। হাবলুর চেহারায় বিস্তর ফারাক হলেও নিজের বড় ভাইকে চিনতে মোটেও ভুল হয় না কাকলির। সে দ্বিধাহীনভাবে বলল, ‘তুমি নিশ্চয় আমার বড় ভাই? এ কী; তোমারও একই অবস্থা!’
হাবলু মুখ দিয়ে স্বর বের না করে শুধু মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি দেয়। যদিও এই সম্মতিসূচক মাথা ঝাঁকাতে সে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। যতটা রাগ নিয়ে ঘর থেকে বের হয়েছিল কাকলির মুখ দেখে ঠিক ততটাই আশ্চর্য হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পরে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘না এ অসম্ভব।’ ‘কী অসম্ভব রে বড়ভাই?’ বলে তার দিকে এগিয়ে যায় কাকলি। কাকলিকে তার কাছে আসতে দেখে ভয়ে সে ক’পা পিছিয়ে যায়। ইতিমধ্যে কাকন এসে দাঁড়িয়েছে সেখানে। যে কিনা কাকলির ছোট ভাই হলেও ছিল তার খেলার সাথী। সবার মতো সেও বিস্মিত। ছেলেবেলার কাকলির মৃতদেহ দেখার স্মৃতি মানসপটে তার আজো জলজল করে। পোস্টমর্ডেম শেষে লাশ যখন বাড়ির উঠানে নিয়ে আসে তখন চাটই থেকে কাফনের কাপড়ের ওপর নিতে যেয়ে মাথাটা একটু কাত হতেই বাম কান দিয়ে গলগল করে রক্ত পড়েছিল যা কোনদিন ভুলতে পারেনি কাকন। কাকলির মৃত্যুতে সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়ে কেঁদেছিল সে। কাকলি বড় বোন হলেও খুব বেশি বড় নয়- বরং তার সবচেয়ে ভাল খেলার সাথী ছিল। আজ এত বছর পরে কাকলিকে দেখে সব কথা মনে পড়ে যায়। সেদিন বৌচি খেলার মাঝে কাকলি তাকে উদ্দেশ্য করে বলেছিল, ‘তোরা খেলতে থাক, আমি যাবো আর আসবো।’ সেই যে গেল, পনের দিন পরে ফিরেছিল লাশ হয়ে। কাকন শিক্ষিত ছেলে। এই গ্রামের ভেতরে তার শিক্ষা সবচেয়ে বেশি এটা এক বাক্যে স্বীকার করবে সবাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নে মাস্টার্স করে বাংলাদেশের মাটি ও প্রকৃতি নিয়ে কাজ করছে। গত সপ্তায় সাত দিনের ছুটি নিয়ে গ্রামে এসেছে। বিয়ে থা এখনও করেনি। নিজেকে পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত না করা পর্যন্ত ও ব্যাপারে ভাবার অবকাশ নেই তার। মনে তার ভয়-শঙ্কা থাকলেও সাহস করে কৌতুহলবসতঃ কাকলির সামনে যেয়ে দাঁড়ায়। বলল, ‘আমাকে কী চিনতে পারছো?’ কাকলি ভাল করে তার আপাদ মস্তক দেখে বলল, ‘না, ঠিক চিনতে পারছি না।’‘আমি কাকন।’কাকনকে দেখে যতটা উৎফুল্ল হবার কথা ছিল তার কিছুই হলো না। কেমন যেন হতাশা ভাব তার চোখে মুখে স্পষ্ট। বলল, ‘তোরও তো একই অবস্থা কাকন! গ্রামের ওপর দিয়ে কিছু গিয়েছে নাকি?’‘তুমি আমাকে সত্যিই চিনতে পেরেছো?’ প্রশ্ন করলো কাকন।‘কী সব আজগুবি কথা বলিস? তোকে চিনবো না কেন? তুইতো আমার ছোট ভাই। আচ্ছা, গতকাল রাতে গ্রামের ওপর দিয়ে কিছু কী গিয়েছে?’‘বুঝলাম না।’ ‘বলছি একরাতে সব পরিবর্তন হয়ে গেল কীভাবে? সবকিছু দেখে মনে হয় দুই যুগ পার হয়ে গিয়েছে। তুই নিজেকে আয়নায় দেখ, একদিনের ব্যবধানে বয়স তোর ত্রিশ পার হয়ে গেছে!’ কাকন সঠিকভাবে মেলাতে পারে না বর্তমান পরিস্থিতি। এ কি সত্যিই তার কাকলি আপু? যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে বয়স? একটা মানুষের বয়স কীভাবে তেইশ বছর এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে! অনেক বই জীবনে পড়েছে- কিন্তু এমন আজগুবি কথা আর যাই হোক বিজ্ঞান বিশ্বাস করবে না। বিজ্ঞান যদি বিশ্বাস না-ই করে তাহলে নিজের সামনে যেটা ঘটছে সেটা কী? দ্বিধাদ্বন্দ্ব মনে আবারো প্রশ্ন করে, ‘তুমি নিশ্চয় আমাদের বোকা বানাচ্ছো? কে তুমি, সত্যি করে বলো।’
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct