সনাতন পাল : “ শরতে আজ মেতেছে ভুবন মিষ্টি রঙের খেলায় সূর্যের তীর্যক ছটা পড়েছে গাছের পাতায়। দূরে ঐ নীল আকাশে রামধনু উঠেছে দিগন্তে সবুজের শোভায় মন হারিয়েছে সুদূর প্রান্তে।”
বাংলার শরৎ আর প্রবাসে শরৎ, প্রকৃতির দুই ভিন্ন রূপ। দুদেশেই শরৎ প্রকৃতির ছোঁয়া হৃদয়ের নীল দিগন্তে আলাদা অনুভূতি ডানা মেলে দেয়। আমেরিকা ফেরৎ কমলেশের মুখে শোনা বলে, “ আমেরিকায় গ্রীষ্ম,শীত, শরৎ এবং বসন্ত এই চারটি ঋতুই দেখা যায়। আমেরিকায় শরৎকালকে বলা হয় ফল সেশন। যা শুরু হয় সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সোমবার থেকে। ফল সেশনে গাছের পাতার রং বদলায়। এই জন্য আমেরিকাতে এই সময়কে ফল কালার্স বলে। ফল কালার্স এর পূর্ণ বিকাশ দেখা যায় অক্টোবর মাসে। যদিও ফল সেশন শুরু হয়ে যায় সেপ্টেম্বর মাস থেকেই। আমেরিকায় শরৎ মানেই গাছের পাতা ঝোড়ে পড়ার পালা।” আমি বললাম, “ বাংলায় শরৎ মানেই নীল আকাশের বুকে সাদা মেঘের ভেলা ভেসে বেড়ানো, মৃদু ঠান্ডায় ভোরে হাল্কা উত্তুরে হাওয়া দূর থেকে ধেয়ে আসা। শরৎ মানেই দেবীর আগমন আর উৎসবের মেজাজে মেতে ওঠা। চারদিকে কাশফুলের মেলা, নদীর পাড়ে হাল্কা হাওয়ায় দুলে দুলে নাড়ে মাথা। শিশির ভেজা ভোরের ফোটা শিউলির ঘ্রাণে গ্রীষ্মের তক্ত শরীরকে একটু জিরিয়ে নেওয়া। হাঁসনোহানা আর কামিনীর সুবাসে আপন মনের সকল বেদনা ভুলে যাওয়া আর গাছের সবুজ পাতায় তীর্যক রোদ্দুরের ফাঁকে আপন খেয়ালে ফিক করে এক গাল হেসে দেওয়া। গ্রাম বাংলার শরৎ মানেই সবুজ ধানে ভরা খেতের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া হাল্কা শীতল হাওয়ায় ধান গাছের দুলে দুলে মাথা নাড়া।”
পাশ থেকে কমলেশ বলল, “ আমেরিকায় এসময় হালকা শীতের আমেজ এবং কিছুটা গ্রীষ্মের উষ্ণতার মাঝে শরতের আগমন। শরতে আমেরিকার বেশ কয়েকটা রাজ্যে ফল কালার্স লক্ষ্য করা যায়। বিশেষ করে আমেরিকার উত্তরের রাজ্যগুলোতে দেখা যায় গাছের পাতা কমলা লাল-হলুদ-সবুজ সব মিলিয়ে বিচিত্র রঙে সেজে উঠেছে। ঘরের জানলা খুললেই দেখা যায় প্রকৃতির এই অপরূপ রূপ দৃশ্য। এই সময় অনেকেই বনভোজনে যায় কিংবা ভ্রমণেও যান। বিশেষ করে পাহাড়ি অঞ্চল গুলোয় পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে রং বেরঙের গাছের পাতা দেখার মজাই আলাদা। আমেরিকায় শরৎকালের যেটা বিশেষ আকর্ষণ, সেটা হল ম্যাপেল গাছ। ম্যাপেল গাছের পাতার রং হলুদ-কমলা-লাল হয়ে চারিদিক ভরে যায়। কিছু পাতা আবার ঝোড়ে পড়তেও দেখা যায়। সব মিলিয়ে প্রকৃতিকে মনে হয় যেন বিধাতা নিজের হাতে তুলি দিয়ে এঁকে রেখেছেন। মিশিগানের ফল কালার্স দেখার মত। মিশিগানের রাস্তায় গাড়ি নিয়ে গেলে দেখা যাবে রাস্তার দুই ধারে সারি সারি গাছ সব রঙের খেলায় মেতে উঠেছে। ঠিক যেমন শান্তিনিকেতনে বসন্তকালে পলাশ ফুলের রঙে ছেয়ে যায় চারিদিক সেইরকম এখানেও শরতে গাছের পাতায় আবির ঢেলে রেখে দিয়েছে প্রকৃতি। বিশেষ করে কোন লেক বা নদীর ধারে গেলে দেখা যায় গাছের রঙিন পাতার ছায়া পড়ছে জলের উপর, কি সেই অপূর্ব দৃশ্য না দেখলে সত্যিই বোঝা ভীষণ কঠিন। ম্যাপেল গাছের পাতা নিয়ে প্রবাসীরা একটু বেশি ইমোশনাল। কারণ এই ম্যাপেল গাছের পাতা সাধারণত বলিউড কিংবা হলিউড সিনেমায় দেখতে পাওয়া যায়। তাই প্রবাসীরা ম্যাপেল গাছের পাতা দেখলেই ক্যামেরা নিয়ে ছবি তুলতে শুরু করে। আমেরিকা বাসী যেহেতু জন্ম থেকেই এই ফল কালার্স দেখতে অভ্যস্ত সেজন্য তাদের মধ্যে খুব একটা মাতামাতি দেখা যায় না। তারপরও বেশকিছু বিদেশি আছে যারা প্রকৃতিকে ভালোবাসেন। এখনো ফল কালার্স এলে তাঁরা ভ্রমণে বেরিয়ে পড়েন। আমরা যেমন ভ্রমণে যেতে ভালোবাসি আবার প্রকৃতিকে উপভোগ করতেও পছন্দ করি। তেমনি আমেরিকাতেও শরতে ভ্রমণ পিপাসুরা ছুটে চলে এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে।”আমেরিকায় শরতের প্রকৃতি যেন বাংলার বসন্ত বিলাপ আর বাংলার শরৎ মানেই মাথার উপর নীল আকাশে ভেসে যাওয়া সাদা মেঘের ভেলা আর নীচে নদীর পাড়ে সাদা কাশবন,গাছে গাছে ফুটন্ত শিউলি, উৎসবের আগমনী। সবুজ বসনাবৃত রহস্য ময় প্রকৃতি। রহস্য যেখানে থাকে সেখানেই তো আমাদের মন কাড়ে তাই তো শরতে বাঙালির মুখে ভুবনমোহন হাসি আর মনের স্নিগ্ধতার সাথে প্রকৃতিকে জানার অধীর আগ্রহ।
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct