এম ওয়াহেদুর রহমান : বঙ্কিম পরবর্তী বাংলা উপন্যাস সাহিত্যের শুস্ক প্রায় স্রোতহীন ধারা কে যিনি বহি: সমুদ্রের স্রোত গতি দান করেছিলেন তিনি অমর কথাশিল্পী বঞ্চিত, লাঞ্চিত, অবহেলিত জীবনের সার্থক রুপকার শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। রবীন্দ্র - সমকালে পাঠক মহলেও বিশেষ করে উপন্যাসের নিরিখে জনপ্রিয়তায় তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কে ও অতিক্রম করেছিলেন। ১৫ সেপ্টেম্বর তাঁর জন্মদিন। স্রষ্টা বেঁচে থাকেন তাঁর সৃষ্টি কর্মের মধ্য দিয়ে। এই কথা শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্পর্কে ও গভীর ভাবে প্রাসঙ্গিক। বাংলা কথাসাহিত্যের আঙিনায় তাঁর আবির্ভাব, অপরাজেয় কথাশিল্পী আখ্যালাভ সর্বোপরি তাঁর সম্পর্কে চর্বিতচর্বন ক্রমশঃ তাঁকে আরোও খ্যাতির আলোয় উদ্ভাসিত করেছে। উপন্যাস সাহিত্যে তাঁর আবির্ভাব কেবলমাত্র বাংলা সাহিত্যে নয় বরং সমগ্ৰ ভারতীয় সাহিত্যেই এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। ভারতীয় সাহিত্যে শরৎচন্দ্রের প্রভাব ও জনপ্রিয়তা তাঁরই অসাধারণ প্রতিভার পরিচায়ক। বাংলা সাহিত্যের জগতে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের আত্মপ্রকাশ ‘বড়দিদি ‘ উপন্যাস টি দিয়ে। ভারতীয় মাসিক পত্রে ১৯০৮ সালে উপন্যাস টি প্রকাশিত হলে পাঠকমহলে বিপুল পরিমাণ সাড়া পড়ে। উপন্যাস টির কাহিনীর অভিনবত্ব পাঠককে ও গভীর ভাবে আকৃষ্ট করেছিল। বড়দিদি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই বাংলা সাহিত্যের জগতে তিনি লেখক হিসেবে স্বীকৃতি পান। তাঁকে আর কোন দিন পিছন ফিরে তাকাতেই হয় নি। বড়দিদির সাফল্যের একে একে বিরাজ বৌ,পরিনীতা, পল্লি সমাজ,পন্ডিত মশাই, শ্রীকান্ত, চরিত্রহীন,দেনা পাওনা, পথের দাবী, দেবদাস ইত্যাদি কালজয়ী বিখ্যাত অসাধারন জনপ্রিয় উপন্যাস গুলো প্রকাশিত হয়েছে। জীবিত কালে অসাধারণ জনপ্রিয়তা তথা সাধারণ মানুষের, পাঠক সমাজের অকুণ্ঠ ভালোবাসা তিনি পেয়েছিলেন। তিনি যে জনপ্রিয় লেখক একথা ইতিহাস সিদ্ধ। কেননা তিনি তাঁর উপন্যাসে কোনো না কোনো সামাজিক সমস্যার ছবি উপস্থাপন করেছেন। তিনি গ্ৰাম - বাংলার ও মফস্বলের পারিবারিক জীবন, ঘরোয়া জীবনের খুঁটিনাটি বিষয় তুলে ধরেছেন। শরৎ সাহিত্য প্রধানতঃ নারী মনের প্রতিচ্ছবি বলে কথিত। সমকালীন সমাজ জীবনের অত্যাচারী জমিদার গোষ্ঠীর শোষণ, দারিদ্র মানুষের অসহায় অবস্থার জ্বালা, সামাজিক ভেদ বিচারের ফলে নিম্ন সম্প্রদায়ের মানুষের প্রতি উপেক্ষা অবজ্ঞা - গ্লানির বাস্তব ছবি তাঁর সাহিত্যে উপস্থাপিত হয়েছে।
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাসের মধ্যে অভিনব দৃষ্টিভঙ্গির সার্থক প্রমান লক্ষ্য করা যায়। তিনি রোমান্টিকতা ত্যাগ করে সমস্যা জর্জরিত জীবনের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরেছেন। ‘ পাপকে ঘৃণা কর, পাপীকে নয় ‘ বাইবেলের এই পবিত্র বাণী শরৎ সাহিত্যে আদর্শ হয়ে উঠেছে। বাস্তব কাহিনী কে অবলম্বন করে শিল্পরস পরিবেশন করাই ছিল তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য। তাই তাঁর লেখনী কিংবা রচনা গুলো পাঠক হৃদয়ে দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে। তিনি খেটে খাওয়া মেহনতি মানুষের দু:খ যন্ত্রণার কাহিনী লেখনীর মাধ্যমে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। তাঁর উপন্যাসে উত্থাপিত সকল সমস্যা সঙ্কুলান বিষয় গুলো হয়তো আজকের দিনে পাঠকের আবেগকে মথিত না করলেও একেবারেই নিস্ফল নয়। পুরোনো মূল্যবোধের প্রতি আজকের সচেতন মানুষ আস্থাহীন হলেও আজকের সময়ে ও শরৎচন্দ্র বাংলা সাহিত্যে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়তে পারে না। কারণ তাঁর সাহিত্যে আছে চিরকালীনত্বের ধর্ম, যা সময়ের মালিণ্যে শেষ হতেই পারে না। তাঁর সাহিত্যের হৃদয়াবেগ ও ভাবাবেগ নিত্য কালের বিষয়। কোনো কালেই মুছে যাওয়ার নয়। আজকের দিনে তাঁর জনপ্রিয়তা এতটুকুও ম্লান হয় নি বরং ক্রমশঃ বৃদ্ধি পেয়েছে। সময়ের প্রেক্ষিতে মানুষের রুচি, জীবনবোধ, জীবনাদর্শন পাল্টালেও মানুষের শোষণ, অবিচার, লাঞ্ছনা, উৎপীড়ন আজ ও চলছে একই ভাবে। হয়তো ধরনটা কেবলমাত্র বদলেছে। তিনি জনপ্রিয়তার দিক থেকে আজও সম্ভত সর্বশ্রেষ্ট ঔপন্যাসিক। যুগ ও রুচির ব্যাপক পরিবর্তন হওয়া সত্ত্বেও জীবদ্দশায় তিনি যে অপরাজেয় কথাশিল্পী খ্যাতি অর্জন করেছিলেন তা আজ ও জনপ্রিয়তার ক্ষেত্রে অপরাজিত। বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতায়,প্রত্যক্ষতায়, বাস্তব অনুভূতির তীব্রতা ও সহমর্মিতায়,তীক্ষ্ণ সমালোচনা ও নারী চরিত্রের আবেগ অনুভূতির গভীর বিশ্লেষণে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাংলা উপন্যাস কে ঐশ্বর্যসমৃদ্ধ করে গেছেন। তিনি মানব জীবনের সুখ - দু: খ ও অশ্রু বেদনা কে সহানুভূতির রসে ডুবিয়ে এমন স্নিগ্ধ মধুর তথা বেদনাবিধুর রুপে উপস্থাপন করেছেন যা ইতিপূর্বে কোনো লেখকই করেন নি। তাই তিনি ও তাঁর সাহিত্যরসের প্রাসঙ্গিকতা আজকের যুগ প্রেক্ষাপটে ও সমভাবে বৃদ্ধি পেয়ে চলছে, যা কখনোই বিন্দুমাত্র ম্লান হয় নি।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct