নিতাশা কাউল : বছর জি-২০ সম্মেলনের আয়োজক হিসেবে ভারতে যে রাষ্ট্রীয় নৈশভোজের আয়োজন করা হয়েছিল, তাতে আমন্ত্রণকারী হিসেবে আমন্ত্রণপত্রে ‘প্রেসিডেন্ট অব ইন্ডিয়া’ নয়; বরং ‘প্রেসিডেন্ট অব ভারত’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। মোদি সরকারের আনুষ্ঠানিকভাবে দেশের নাম বদলের অভিপ্রায়ের বিষয়ে এই ঘটনা কোনো তাৎপর্য বহন করে কি না, তা নিয়ে ভারতের ভেতরে ও বাইরে পর্যবেক্ষকদের মধ্যে জল্পনা চলছে।অনেকে বলছেন, আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে দুই ডজনের বেশি বিরোধী রাজনৈতিক দল ‘ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টাল ইনক্লুসিভ অ্যালায়েন্স’ (পুরো নামের প্রতিটি শব্দের আদ্যক্ষর নিয়ে যার সংক্ষিপ্ত রূপ ‘ইন্ডিয়া’) নামের যে জোট গঠন করেছে, তার পাল্টা প্রতিক্রিয়া হিসেবে ক্ষমতাসীন বিজেপি ‘ইন্ডিয়া’ বাদ দিয়ে ‘ভারত’ চালু করতে চাইছে।বিজেপি ভারতের আনুষ্ঠানিক নাম ‘ইন্ডিয়া’কে বদলে ফেলে ‘ভারত’ বানানোর যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা নিয়ে অনলাইনে বেশ তর্কবিতর্ক চলছে। হাসিঠাট্টার পাশাপাশি এ নিয়ে সিরিয়াস আলাপ–আলোচনাও চলছে।যেহেতু বিদেশিদের কাছে ভারতের আনুষ্ঠানিক ও প্রচলিত ইংরেজি নাম ‘ইন্ডিয়া’ ব্যবহার করাকে অনেকে ‘ঔপনিবেশিক দাসত্বের’ প্রতীক হিসেবে দেখেন, সেহেতু বিজেপির এমপিদের ওপর এই নাম বদলে ‘ভারত’ চালু করার জন্য ক্রমবর্ধমানভাবে চাপ বাড়ছে।এই নাম পরিবর্তনের আবেদন আগেও জানানো হয়েছিল। তবে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ২০১৬ সালে একবার এবং ২০২০ সালে আরেকবার সে আবেদন খারিজ করে দিয়েছিলেন।জি-২০ নৈশভোজের আমন্ত্রণপত্র বিলি করার মাত্র কয়েক দিন আগেই বিজেপির মূল আদর্শিক অভিভাবক সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) প্রধান মোহন ভগৎ ‘ইন্ডিয়া’ শব্দটি বাদ দিয়ে ‘ভারত’ ব্যবহার করতে জোর দাবি জানান। তিনি বলেন, ‘বিদেশের কে বুঝবে, কে বুঝবে না, তা নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে না। যদি তারা বুঝতে চায়, চেষ্টা করে বুঝবে...এটা আমাদের সমস্যা নয়...বিশ্বের আজ আমাদেরই প্রয়োজন, বিশ্বকে আমাদের প্রয়োজন নেই।’জল্পনাকল্পনার সাম্প্রতিক এই উত্তেজনা পুরোনো বিতর্কগুলোকে আবার উসকে দিয়েছে, যা ১৯৪৯ সালের সেপ্টেম্বরে তৎকালীন গণপরিষদে তোলা হয়েছিল এবং তার ফয়সালাও তখন হয়ে গিয়েছিল। সংবিধানের ১ নম্বর অনুচ্ছেদে দেশের নামের স্থলে বলা আছে, ‘ইন্ডিয়া, দ্যাট ইজ ভারত’ (ইন্ডিয়া, যা কিনা ভারত)। তখন থেকেই এই দেশের নাম ‘ইন্ডিয়া’ এবং ‘ভারত’ যুগপৎভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। সুতরাং শুধু ‘ভারত’ কথাটি রাখার মানে হলো সংবিধান থেকে ‘ইন্ডিয়া’ কথাটিকে বাদ দিতে হবে।১৮ থেকে ২২ সেপ্টেম্বর ভারতের পার্লামেন্টে যে অধিবেশন হবে, সেখানে নাম পরিবর্তনের বিষয়টি তোলা হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে এই নাম পরিবর্তন আসলে একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়ার একটি ধাপ মাত্র। হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা সামাজিক পরিবর্তনের যে বিশদ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে হাঁটছেন, এটি তারই একটি অংশ। উদাহরণ হিসেবে গত এপ্রিলে স্কুলের পাঠ্যবই থেকে ষোড়শ থেকে ঊনবিংশ শতক পর্যন্ত দেশটিতে শাসন করা মুসলিম মোগল শাসকদের রেফারেন্সকে বাদ দেওয়ার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। এই প্রক্রিয়ার একটি পরিণত মুহূর্ত বা মোমেন্টাম তৈরির শুরুটা হয়েছিল ২০১৬ সালে। ওই সময় বিজেপি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘ডিলিটমুঘলসফ্রমহিস্ট্রি’ হ্যাশট্যাগ দিয়ে প্রচারণা শুরু করেছিল। সুতরাং বলা যায়, জি-২০-এর নৈশভোজের নিমন্ত্রণপত্র তারই ধারাবাহিকতার একটি অংশ। এর মধ্য দিয়ে মূলত হিন্দুত্ববাদের উত্থান-ঘোষণাকেই সামনে আনা হয়েছে। বিজেপি মনে করে, ভারতের মুসলিম শাসকেরা ও তাঁদের উত্তরসূরিরা প্রকৃত ভারতীয় নয়। ফলে ‘ইন্ডিয়া’ বাদ দিয়ে ‘ভারত’ চালুর বিষয়টিকে উপনিবেশবিরোধী ভাবার সুযোগ কম। বিজেপি মনে করে, যাঁরা প্রকৃত ভারতীয়, তাঁরা হলেন হিন্দু; তাঁরা কোনোভাবেই মুসলিম নন। আরএসএস এবং বিজেপির প্রচারিত হিন্দুত্ববাদ এমন একটি দর্শন, যেখানে ভারতকে আর দশটি সাধারণ দেশ হিসেবে দেখা হয় না, বরং দেশটিকে হিন্দু নৈতিকতার পীঠস্থান হিসেবে ভাবা হয়। সে কারণে এই নাম পরিবর্তনের উদ্যোগ গভীর তাৎপর্য বহন করে।
সৌ: প্র: আ:
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
নিতাশা কাউল সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অব ডেমোক্রেসির পরিচালক
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct