সারিউল ইসলাম: দ্র মাসের শেষ বৃহস্পতিবার ঐতিহাসিক নবাব নগরী মুর্শিদাবাদে সারারাত ব্যাপী প্রাচীন আলোর উৎসব ‘বেড়া’ ভাসান অনুষ্ঠিত হয়।১৭০৪ সালে নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ জলদেবতা হজরৎ খাজাখিজি সাহেবের উদ্দেশ্যে এই ‘বেড়া’ উৎসবের সূচনা করেন।বেড়া উৎসবের সূত্রপাত ঘটে মূলত মুকাররম খাঁ-র আমলে, তিনি যখন ঢাকায় বাংলার সুবেদার হিসিবে আসেন তখন সেই সময় নদীমাতৃক বাংলায় বন্যা মেকাবিলার জন্য বিশাল নৌবাহিনী রাখা হতো। তাই নদীর দেবতাকে সন্তুষ্ট করার জন্য এক উৎসবের আয়োজন হতো ঢাকায়। সেই থেকে আজও বেড়া উৎসব হয়ে আসছে।‘বেড়া’ একটি পারসি শব্দ। যার অর্থ ‘মহৎ উদ্দেশ্যে নৌপথে যাত্রা।’নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ বাংলা-বিহার-ওড়িশার সুবেদার হিসেবে মুর্শিদাবাদে আসার পর থেকেই প্রতিবছর নিয়ম করে দিল্লীর মসনদে বাৎসরিক কর সংগ্রহ করে পাঠাতেন, মালপত্র বজরায় তুলে নদীপথ দিয়েই যাত্রার শুরু হতো। আর সেই যাত্রাপথ মঙ্গলময় করতেই বেড়া উৎসবের সূচনা। এই বেড়া উৎসবকে কেন্দ্র করে সেজে ওঠে নবাব নগরী তথা মুর্শিদাবাদ শহরের কেল্লা নিজামত চত্বর। ভাগীরথীর বুকে কলা গাছের গুঁড়ি ও বাঁশ দিয়ে ভাসমান এই ভেলাকেই বলা হয় বেড়া। যার আয়তন লম্বা ও চওড়াতে ৩০০ হাত হতো, কিন্তু কালের আবর্তনে বর্তমানে ৭৫ থেকে ৮০ হাত ভেলা বানানো হয় এই বেড়ার ঐতিহ্য ধরে রাখতে আশির দশকে রাজ্য সরকারের বিচার বিভাগ ও এস্টেট এর যৌথ উদ্যোগে পালিত হয়ে আসছে এই বেড়া উৎসব। নবাবী জৌলুসে বেড়া উৎসবে শুধু জেলার নয়, বরং জেলার বাইরে থেকেও হাজার হাজার মানুষ বেড়া উপভোগ করতে ওয়াসিফ মঞ্জিল বা নিউ প্যালেসের সম্মুখ ভাগে উপস্থিত হন। নবাব পরিবারের সদস্যরা এই বেড়া উৎসবের উদ্বোধন করেন। সঙ্গে উপস্থিত থাকেন রাজ্যের মন্ত্রী ও বহু সরকারি আধিকারিকরা। উদ্বোধনের পর রঙিন কাগজে ময়ূরপঙ্খী সুসজ্জিত বিভিন্ন আকৃতির ছোটো নৌকা গুলি ওয়াসিফ মঞ্জিল থেকে শোভাযাত্রার মধ্যে দিয়ে বের হয় ভাসানোর উদ্দেশ্যে।সুসজ্জিত আলোক মালা ও বর্ণাঢ্য শোভা যাত্রার মধ্যে দিয়ে বিভিন্ন আকৃতির জলযান কে নিয়ে যাওয়া হয় হাজার দুয়ারীর সম্মুখ ভাগের ভাগীরথীর তীরে কলাগাছের তৈরি ভেলার কাছে। সেখানে কলা গাছের তৈরি ভেলাকে সাজানো হয় রং বাহারি আলো ও ঝাড় বাতি দিয়ে। ওই ভেলায় প্রতিষ্ঠা করা হয় বিভিন্ন আকৃতির ছোটো নৌকা গুলিকে। কলাগাছের ৮০ হাত লম্বা-চওড়া ভেলার মধ্যে বসানো হয় ‘সোনার’ ও ‘রূপোর’ প্রদীপ। এই প্রদীপ জ্বালিয়ে মনস্কামনা পূরণের জন্য দেবতার উদ্দেশ্যে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। জলদেবতা খাজাখিজি সাহেবের উদ্দেশ্যে ছোট বড়ো বিভিন্ন আকৃতির পাত্রে সিড়নী হিসেবে দেওয়া হয় বিভিন্ন রকম মিষ্টান্ন, ফলমূল। যখন ভাগীরথী নদীর উপর ভেলা সাজানোর কাজ চলে, ওই সময় ভাগীরথী নদীর পশ্চিম পাড়ে শুরু হয় আতসবাজি। হাজারদুয়ারী সংলগ্ন পূর্ব পাড়ে হাজার হাজার মানুষ উপভোগ করেন সেই আতস বাজির রোশনাই। এই ভাবেই রাত গভীর হলে নবাব পরিবার ও প্রশাসনিক কর্তাদের হাত ধরে ভাগীরথীর স্রোতের অণুকুলে ভেসে যায় কলাগাছের তৈরি ‘বেড়া’।সেই বেড়ার পিছু নেয় বেশ কিছু সুসজ্জিত নৌকো। নজরদারির জন্য আগে পরে থাকে পুলিশের নৌকা। আর এভাবেই নবাব নগরী মুর্শিদাবাদের ঐতিহ্যবাহী ৩২০ বছরের পুরনো এই উৎসব পালন করা হয়।তবে ‘এবছর আগের তিন বছরের মতোই মহরম মাসের জন্য বেড়া উৎসব হচ্ছে না’ এমনটাই জানিয়েছেন নবাব পরিবারের সদস্য ছোটে নবাব সৈয়দ রেজা আলী মির্জা।গত তিন বছর একদিকে যেমন করোনার মহামারী অন্যদিকে মহরম মাসের শোক উপলক্ষে ৩২০ বছরের পুরনো এই ঐতিহ্যবাহী উৎসব বন্ধ ছিল। এ বছরও মহরমের ৬৮ দিনের শোক শেষ না হওয়ায় শিয়া সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত নবাব পরিবারের সদস্যরা বেড়া পালন করবেন না।ভাদ্র মাসের শেষ সপ্তাহে কলাগাছ দিয়ে হাজারদুয়ারির পাশে ভাগীরথীর বক্ষে ভেলা গাথা হয়। শেষ সপ্তাহে সেজে ওঠে ‘ওয়াসেফ মানজিল বা নিউ প্যালেস’ সহ কেল্লা নিজামত চত্বর।এবছর ভাদ্র মাসের শেষ বৃহস্পতিবার আজ।কিন্তু এবার বেড়া উৎসব বন্ধ থাকায় ভাদ্র মাসের শেষ সপ্তাহে যেন মুর্শিদাবাদ শহরের মুখ ভারী হয়ে আছে। এ যেন রংবেরঙের আলোয় সেজে ওঠা শহর মুর্শিদাবাদের কেল্লা নিজামত চত্বর আজ অন্ধকারাচ্ছন্ন।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct