স্বাধীনতার ৭৬ বছরে পশ্চিম বঙ্গের মসনদে তিনটি দলের উপস্থিতি যথা কংগ্রেস, বামফ্রন্ট ও তৃণমূল এবং রাজনৈতিক অবস্থান গত ভাবে ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক সরকার। কিন্তু দুর্ভাগ্য রাজ্য রাজনীতিতে ও বাস্তবে কোন ধর্মনিরপেক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায়নি। পক্ষপাত মূলক চরিত্র প্রতিফলিত হয় নানা জায়গায় ও কাজকর্মে। জনসংখ্যার নিরিখে বৃহত্তর জনসংখ্যা সংখ্যালঘুদের। অথচ রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ও পদে সংখ্যালঘু মুসলমানদের উপস্থিতি নাম মাত্র এবং বহু জায়গায় ও পদে বসানো হয়নি দীর্ঘ ৭৬বছরের শাসনে। লিখেছেন ড. মুহাম্মদ ইসমাইল।
স্বাধীনতার ৭৬ বছরে পশ্চিম বঙ্গের মসনদে তিনটি দলের উপস্থিতি যথা কংগ্রেস, বামফ্রন্ট ও তৃণমূল এবং রাজনৈতিক অবস্থান গত ভাবে ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক সরকার। কিন্তু দুর্ভাগ্য রাজ্য রাজনীতিতে ও বাস্তবে কোন ধর্মনিরপেক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায়নি। পক্ষপাত মূলক চরিত্র প্রতিফলিত হয় নানা জায়গায় ও কাজকর্মে। জনসংখ্যার নিরিখে বৃহত্তর জনসংখ্যা সংখ্যালঘুদের। অথচ রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ও পদে সংখ্যালঘু মুসলমানদের উপস্থিতি নাম মাত্র এবং বহু জায়গায় ও পদে বসানো হয়নি দীর্ঘ ৭৬বছরের শাসনে। পূর্ণাঙ্গ মেরুকরণের রাজনীতি করা করা হয়েছে সুকৌশলে কিছু সংখ্যালঘুদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে। কি ভাবে সংখ্যালঘুদের বঞ্চিত করা যায় তার লাল, সবুজ নক্শা তৈরি হয়েছে শীতল ঘরে। তাই সংখ্যালঘু এলাকায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে নানা পরিকাঠামো গড়ে তুলা হয়নি তেমনি সংখ্যালঘুদের নানা ক্ষেত্রে বঞ্চিত করা হয়েছে সব আমলে। চাকরি, ব্যবসা বাণিজ্য থেকে প্রশাসনিক সকল স্তরের কাজকর্ম থেকে দুরে রাখা হয়েছে মুসলমানদের এবং কয়েক দশক ধরে সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রচলন ছিল চাকরি পাওয়া যাবেনা পড়াশোনা করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত হলে। রাজনৈতিক পালা বদল হলেও চিত্র নাটকের পটভূমির কোনো পরিবর্তন হয়নি। সমান ভাবে কি ভাবে বঞ্চিত করে রাখা যায় তার নকশার কোন পরিবর্তন না করে লাগাতার বঞ্চনার নকশা ব্যবহার করছে। ফলে কংগ্রেস, বাম ও তৃণমূল আমলে সংখ্যালঘুূূূদের উন্নয়ন হয়নি বরঞ্চ খারাপ থেকে খারাপ হয়েছে। বর্তমান আমলে সরকারি অবস্থান ও সংখ্যালঘুদের নিয়ে ভাঁওতাবাজি চরম মাত্রায়। এই রাজ্যে শুরু হয়েছে মন্দির, মসজিদ, পুরোহিত ও মৌলাভী নিয়ে রাজনীতি। সরকারি টাকায় একদিকে পূজা করানো অন্য দিকে সরকারি টাকায় মন্দির নির্মাণ হচ্ছে অপর পক্ষে বহু দিনের গুচ্ছিত ওয়াকফ্ সম্পত্তি থেকে ইমাম ও মুয়াজ্জিনদের বেতন প্রদান করা হচ্ছে। যা মুসলমানদের সামগ্রিক উন্নয়নে কাজে লাগানো যেত এবং হাজার হাজার একর সম্পত্তি দখল করা হচ্ছে। তা নিয়ে কোন হেল দোল নেই সরকারি তরফে ও দায়িত্বে থাকা চেয়ারম্যান সাহেবের। মেরুদণ্ডহীন সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধি হিসেবে নানা জায়গায় ও নানা কমিটিতে বসানো হয়েছে বহু লোককে এবং কয়েকজন কে প্রতিমন্ত্রী করা হয়েছে। তা সত্ত্বেও বাঙালি মুসলমানের মধ্যে সচেতনতা তৈরি হয়নি বঞ্চনা নিয়ে। অবাক লাগে বাংলার রাজনৈতিক দলের নেতানেত্রীদের অবস্থান দেখে। কারণ আমাদের রাজ্যে কয়েকটি দলের সূচনা হয় চরম মিথ্যা ও নাটকীয় রাজনীতি দিয়ে এবং লক্ষ লক্ষ মানুষের রোজগারের সুযোগকে উপেক্ষা করে। সিঙ্গুরের মত জায়গায় অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি হবে সেখানে বাংলার বুদ্ধিমানেরা বাধা দিবে কল্পনাতীত। শিল্প আকাশে হবেনা, উর্বর হোক বা পরিত্যক্ত জমি দখল নেওয়ার ক্ষেত্রে সকলের একমত হওয়া সম্ভব নয়। ইতিহাস বলছে নানা কৌশলে জমি অধিগ্রহণ করতে হয়। তাই করেছিল তৎকালীন সরকার কিন্তু জমিদাতাদের উস্কানি দেওয়া শুরু হয় পরিকল্পিত ভাবে। তার ফলে বেকার যুবকদের স্বাবলম্বী হওয়ার আশা খতম হয়ে যায় এবং শুধু তাই নয়, শিল্পের উন্নয়ন এবং নতুন শিল্পায়ন চিরস্থায়ী ভাবে ধাক্কা খায়। মিডিয়া ও নেতানেত্রীদের ভ্রান্ত ধারণার ও তার পর নানা ঘটনা প্রবাহ হয়েছে, সারদা, রোজভ্যালি, নারদা, যার মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ অসহায়, গরিব মানুষের টাকা লুট হয়েছে, কত লক্ষ লক্ষ মানুষ সর্বস্ব হারিয়েছে, আপনত্ব হারিয়েছে, যাদের চোখের জলে বাংলার আকাশ অন্ধকারাচ্ছন্ন ও কর্দমাক্ত। বিশ্বাস নামক বিষয়টাই আপাতত প্রশ্ন চিহ্নের মধ্যে সকলের কাছে। তারপর রাজ্যজুড়ে চরম দুর্নীতি, মিথ্যাচার, মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো থেকে শুরু করে সব কিছু নিয়ে সকলেই আতঙ্কিত। তারপর ও বাংলার শুভবুদ্ধি সম্পূর্ণ মানুষেরা দল বেধে সমর্থন করেছে ও দুই হাত তুলে ইদগাহ, মসজিদ ও সংখ্যালঘু প্রতিষ্ঠানে দোয়া হয়েছে মহান আল্লাহ পাকের কাছে। অপর পক্ষে লক্ষ লক্ষ রাজ্যের অশিক্ষিত ও ডিগ্রি ধারী মানুষেরা কাতারে কাতারে শামিল হয়ে দুর্নীতি, রাহাজানির মত নানা বিষয়কে প্রশ্রয় দিয়েছে। অবাক লাগে, আলেম সমাজের ভুমিকায়, মুসলিম বুদ্ধিমান লোকদের ভুমিকায়, ধর্মের অবমাননা দেখেছি ঐ ঈদের নামাজে, খুদবার আসনে নাটকীয় চরিত্রে অভিনয় করতে দেখেছি রেড রোডে রাজ্যের নেতা- মন্ত্রীদের। সাধারণ মানুষদের প্রতিবাদের আওয়াজ হারিয়ে গেছে জোরালো স্লোগানে এবং খেলা হাবের কম্পনে। তারপর ও স্বল্পসংখ্যক মানুষ নিজেদের রক্ষা করে কোনোক্রমেই ভালো আছে। কারণ তারা অন্যায়কে অন্যায় বলেছে এবং অসহায়, বঞ্চিত মানুষের পাশে থেকে নানা আন্দোলনে শামিল হয়েছে, তার জন্য ব্যক্তিগত বঞ্চনার কম স্বীকার হয়নি। অযোগ্যদের নানা জায়গায় রমরমা, অকথ্য গালিগালাজ থেকে আর কত কিছু হজম করতে হচ্ছে। বাংলার লক্ষ লক্ষ মানুষ অসহায়, কর্মসংস্থান নেই, শিল্প নেই, সরকারি নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ, নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি সর্বকালের সীমানা অতিক্রম করেছে যা ভারতীয় ইতিহাসের এক কলঙ্কিত অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। ভাবুন নিয়োগ প্রক্রিয়ায় যুক্ত সকল ব্যক্তিবর্গ ও মন্ত্রী মহাশয় থেকে উচ্চ পদস্থ আধিকারিক তালা ঘরে বন্দী। অযোগ্যদের রমরমা অফিস থেকে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, হসপিটাল, কে স্থায়ী না অস্থায়ী তার পরওয়া নেই। দুর্ভাগ্য, তারপর ও কারো গলার আওয়াজ কেউ পাইনি হেন কর্মের বিরুদ্ধে।
বাংলা বলতে মানুষের কাছে “তোলাবাজি, দুর্নীতি, চরম মাত্রায় ঘুষ, গরু পাচার, কয়লা পাচার, অবৈধভাবে বালি খনন, লক্ষ লক্ষ মানুষের বেকারত্ব, কাজ না পেয়ে বেকারদের দিনের পর দিন আন্দোলন, শিক্ষিত যুবক-যুবতীদের স্বপ্ন ভঙ্গ, দুশ্চিন্তায় ডুবে যাওয়া, জীবন ও যৌবন যুদ্ধের স্বাদ না পাওয়া, কয়েকজন যুবক-যুবতীর ক্ষমতার আস্ফালন, পদচুম্বন, মোদিজীর নতুন নতুন ট্রেনে খেতে না পেয়ে বিভিন্ন রাজ্যে কাজের সন্ধানে ছোটাছুটি, কয়েক শত টাকা মাসিক ভাতা পাওয়ার জন্য স্থানীয় নেতা এবং অফিসে গিয়ে তোষামোদ করা এবং কাজের জন্য কয়েক হাজার ঘুস সালামি হিসেবে দেওয়া ইত্যাদি কে বোঝায়”। বাংলা আজকে ভাতা বাংলা নামে পরিচিত। শুনেছিলাম অক্ষম, প্রতিবন্ধী, বয়স্কদের ভাতা দেওয়া হত, আজকে নানা শ্রী দেওয়া হয় সলককে কাজের পরিবর্তে। অন্যদিকে কর্মচারীরা তাদের ন্যায্য পায়না পেতে কোর্টের দরজায় খটখটায়, এরা নাকি মানে না, কোর্ট-কাচারি, আইনকানুন, পরিবর্তন করতে পারে আইনকানুন জনসমর্থনের জোয়ারে, তার ওপর সমর্থকদের চোখ রাঙানি _ সব কিছু মিলিয়ে ভালো নেই রাজ্য সরকারের কর্মচারীরা। অপর পক্ষে সকল স্তরের নেতাদের জীবনযাপন, পাহাড় সম সম্পদের পরিমাণ, আনন্দ-ফুর্তি, মেয়ে নাচানো থেকে কত কিছু আজ অন্তরালের কথা নয়। আর সংখ্যালঘুদের নিয়ে না বলাই ভালো, হয়ত শুভবুদ্ধি সম্পূর্ণ নেতারাই সুপারি কিলার লাগিয়ে দিবেন, কারণ খুব সস্তায় পাওয়া যায় সংখ্যালঘুদের ভাড়াটিয়া হিসেবে। সকলেই জানেন, ক্ষমতার বিন্দু মাত্র স্বাদ না পেলেও, এই সংখ্যালঘুরাই রাজ্যজুড়ে মিটিং, মিছিল ভরানোর দায়িত্বে ও খুন খারাবির সর্দার। মারল কে, মরল কে খতিয়ান দেখলে বোঝা যায়। অথচ তৃণমূল আমলে সরকারি চাকরি কমেছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে এবং সংরক্ষণ নীতিকে হাতিয়ার করে ও প্রশাসনিক সহযোগিতায় সংখ্যালঘুদের বঞ্চিত করা হচ্ছে সর্বক্ষেত্রে। শিক্ষাক্ষেত্রে অগ্রগতি পুরোপুরি ব্যক্তিগত উদ্যোগে নানা বেসরকারি মিশন স্কুলের সহযোগিতায়। তারপর ও কিছু শুভবুদ্ধি সম্পূর্ণ সংখ্যালঘু অসচেতন মানুষজন ব্যক্তিগত সম্পদের লালসায় ও পরিবার পরিজনদের স্বার্থ রক্ষার জন্য সংখ্যালঘু সমাজে মিথ্যার বোমা ফাটাচ্ছেন যার আওয়াজ ও ধোয়াতে সংখ্যালঘুরা বধির এবং অন্ধে পরিণত হয়েছে। সংখ্যালঘু এলাকায় কর্মসংস্থানের সুযোগ নেই, শিল্প কলকারখানা, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, হসপিটাল, মেডিক্যাল কলেজ থেকে শুরু করে নানা গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর নেই বললেই চলে। শুধু তাই নয়, নানা সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত মুসলমান অর্ধশিত জেলাগুলো। শহর-বাজারে সংখ্যালঘুরা বসবাস করার জন্য জায়গা থেকে ফ্ল্যাট কেনার কোনো সুযোগ নেই হিন্দু এলাকায়। এছাড়া শহর অঞ্চলে ঘর ভাড়া পাওয়া যায় না, হাজার হাজার বাড়ি মালিকদের থেকে শোনা যায় স্থানীয় ক্লাব ও নেতারা পাড়ায় থাকতে দিবেনা মুসলমানদের বাড়ি ভাড়া দিলে। এমনকি দোকান পাট ও করতে দেওয়া হয় না ও নানা গুরুত্বপূর্ণ স্থানে। তাই বলা যায়, বিজেপি সরাসরি ধর্মের নামে বিভাজন সৃষ্টি করলেও সকল রাজনৈতিক দল ধর্মের নামে বিভাজন সৃষ্টিতে মদত দিচ্ছে। তবে ভোটের সময় বহু সংখ্যালঘু নেতারা বঞ্চনার অভিযোগ তুলেছে ভোটে টিকিট না পেয়ে। আসলে তারা নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করার উদ্দেশ্য সাময়িক ভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষের কথা বললেও সামান্য ব্যক্তিগত সুবিধার বিনিময়ে মুখ বন্ধ হয়ে যায়। তবে ব্যক্তি স্বার্থের ওপরে উঠে জাতপাত, বর্ণ, ধর্ম নির্বিশেষে সকলেই হয়ে বাংলার গৌরব পুনরুদ্ধারের দাবিতে নেক উদ্দেশ্য নিয়ে বাংলা বাচানোর দায়িত্ব এগিয়ে আসতে হবে। তবেই বাংলার বঞ্চনা দূর হবে ও সকল সম্প্রদায়, বর্ণ, ধর্ম নির্বিশেষে উন্নয়ন হবে। মনে রাখা উচিত দরিদ্র, ক্ষুধার্ত, অসহায় মানুষের কোনো ধর্ম জাতপাত হয় না। তারা শুধু দু’বেলা দুমুঠো ভাত চায় তার সুব্যবস্থা করা একটি দেশের কর্তব্য।
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
ড. মুহাম্মদ ইসমাইল
অধ্যাপক, দেওয়ান আব্দুল গণি কলেজ, দক্ষিণ দিনাজপুর
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct